মূল ফটকের ওপরে বড় একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতাল’। কিন্তু ওই হাসপাতালে প্রবেশের কোনো পথ নেই, সাইনবোর্ড পেরিয়ে ভবনের দিকে যেতেই প্রবেশপথের ওপর গড়ে উঠেছে টিন ও বাঁশের তৈরি একটি অস্থায়ী ঘর। ভেতরে রয়েছে তিনটি কাঠের টেবিলসহ কয়েকটা চেয়ারও। আর ভবনের সামনেই পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে দুটি অ্যাম্বুলেন্সসহ ছয়টি গাড়ি। অন্যদিকে, লতাগুল্মে আচ্ছাদিত পুরো ভবনের অধিকাংশ জানালার কাচ ভেঙে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি ঢুকে নষ্ট হচ্ছে হাসপাতালের মূল্যবান চিকিৎসা-যন্ত্রপাতি ও আসবাব।
ফ্রান্স সরকারের আর্থিক সহায়তায় রাজধানীর মিরপুরে চিড়িয়াখানা রোডে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য নির্মিত আধুনিক হাসপাতালের বর্তমান চিত্র এটি। ২০ বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণ ও কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অবহেলায় পাঁচতলা এই হাসপাতাল ভবনটিতে এখন দিনের বেলাও বিরাজ করছে ভুতুড়ে অবস্থা। অথচ রাজধানীসহ দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্দিষ্ট করে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবাও ভালোভাবে নিশ্চিত করা হয়নি।
মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ থাকলেও তা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে ব্যয় করা হয়। এ জন্য এখনও কোনো নীতিমালা করা হয়নি। যার ফলে শহরাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে চিকিৎসার জন্য সরকারি সহায়তা পেলেও তৃণমূল পর্যায়ে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধারা এখনও বঞ্চিত।
মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি কিছু বেড সংরক্ষণ করা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এ জন্য প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধাদের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা নিতে যেতে হয়, এ জন্য চিকিৎসা ব্যয়ও অনেক বেড়ে গেছে। এ ছাড়া যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল না থাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেক সমস্যায়ও পড়তে হয় বলে জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল হক বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষায়িত কোনো হাসপাতাল নেই। ফ্রান্স সরকারের আর্থিক সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দেশে প্রথমবারের মতো ১৯৯১ সালে ১০০ শয্যার এই হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়। কিন্তু চালু হওয়ার পর কয়েক বছর না যেতেই হাসপাতালটি বন্ধ করে লুটেপুটে খেয়েছে অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। বর্তমান সরকার কয়েক দফা হাসপাতালটি চালুর উদ্যোগ নিলেও অজ্ঞাত কারণে তা-ও বাস্তবায়ন হয়নি। আর এখন এই হাসপাতাল ঘিরে দিনে বখাটেদের আড্ডা হচ্ছে, আর রাত হলে চলে মাদক সেবন ও বিক্রির ব্যবসা। অথচ হাসপাতালটি চালু থাকলে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি এলাকাবাসীও পেতে পারতেন মানসম্মত চিকিৎসাসেবা।
ট্রাস্ট হাসপাতাল চালুর দাবি জানিয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের স্থানীয় ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী টিপু সুলতান সমকালকে বলেন, হাসপাতালটি বন্ধ থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি এলাকাবাসী স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কয়েক দফা হাসপাতালটি চালুর জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি; বরং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ স্থানীয় কিছু লোকজন হাসপাতাল ঘিরে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে ভোগদখল করছে।
টিপু সুলতান আরও বলেন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে এরই মধ্যে সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। মেয়র আনিসুল হক অসুস্থতার জন্য বিদেশ থাকায় উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত এখনও পাওয়া যায়নি। সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দ্রুত এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে বলেও জানান তিনি।
টিপু সুলতান আরও বলেন, ‘এই ওয়ার্ডে চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বিসিআইসি কলেজসহ মুক্তিযোদ্ধা পল্লী ও কল্যাণ ট্রাস্টের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অথচ এখানে একটি সরকারি হাসাপাতাল নেই। এটি দুঃখজনক।’
সরেজমিনে হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা গেছে, সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় আসবাব। ভবনের সামনের দু’দিকে পড়ে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকারও বেশি মূল্যের দুটি অত্যাধুনিক ভ্রাম্যমাণ ‘ইউনিট অ্যাম্বুলেন্স’, একটি সাধারণ অ্যাম্বুলেন্স, একটি মাইক্রোবাস, একটি প্রাইভেটকার ও একটি পিকআপভ্যান। পাঁচতলায় গিয়ে দেখা যায়, ছাদের একাংশ ভাঙা। ফ্লোরজুড়ে রয়েছে চেয়ার-টেবিলের ভাঙা অংশ, ছয়-আট ফুট উচ্চতার বিভিন্ন প্রজাতির আগাছাও। অন্য ফ্লোরগুলোতে দেখা যায়, পরিপাটি করে সাজানো। চিকিৎসকের নাম, রোগীদের জন্য নির্দেশিকা এমনভাবে রয়েছে যেন এখনই চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু হবে। তবে কক্ষগুলো সিলগালা করে রাখা।
হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মী মো. সাইফুর সমকালকে জানান, হাসপাতালটি বন্ধের পর থেকে একটি বেসরকারি কোম্পানির হয়ে তিনজন নিরাপত্তাকর্মী পাহাড়া দিচ্ছেন। মাঝেমধ্যে কল্যাণ ট্রাস্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসে খোঁজখবর নিয়ে যান। প্রবেশপথ বা ভবনের সামনে অবৈধ দখলের বিষয়ে সাইফুর বলেন, ‘দখলদাররা সবাই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমরা ভবনের ভেতরে নিরাপত্তা দিচ্ছি। দখলদারদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।’
দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সহযোগী প্রতিষ্ঠান তাবানী বেভারেজের উপমহাব্যবস্থাপক কাজী ইকবাল বাহার সমকালকে বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। দখলদারদের নেপথ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরাও রয়েছে। তা ছাড়া হাসপাতালের সামনের জায়গাও সিটি করপোরেশনের। এ জন্য সিটি করপোরেশনকে ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন সময় তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তারা উদ্যোগ নিলে কল্যাণ ট্রাস্ট সহায়তা করবে।
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নত চিকিৎসাসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে এরশাদ সরকারের আমলে ফ্রান্সের আর্থিক সহায়তায় ১০০ শয্যার এই আধুনিক হাসপাতালের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৯৯১ সালের ১ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া হাসপাতালটির কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ১৯৯৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) মজিবুর রহমান ইসলামী উম্মাহ করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে হাসপাতালটি পরিচালনার জন্য ইজারা দেন। ওই প্রতিষ্ঠান ইসলামী উম্মাহ মেডিকেল কলেজ নাম দিয়ে হাসপাতালটি পরিচালনা শুরু করে। ২০০ ছাত্রছাত্রীও ভর্তি করে তারা। কিন্তু ১৯৯৭ সালের মার্চে ওই প্রতিষ্ঠান কল্যাণ ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হাসপাতালটি বুঝিয়ে না দিয়েই মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও আসবাব নিয়ে সটকে পড়ে। এর পর হাসপাতালটি সিলগালা করে বন্ধ করে দেয় তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কল্যাণ বিভাগ।
এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আজাহারুল হক সমকালকে জানান, হাসপাতালটি চালুর পর বিএনপি সরকারের আমলে যাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেওয়া হয়েছিল, তাদের অব্যবস্থাপনার কারণে হাসপাতালটি ধ্বংসের মুখে পড়েছে। তবে কল্যাণ ট্রাস্টে যোগ দেওয়ার পর তিনি হাসপাতালটি চালুর জন্য একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তারা যদি হাসপাতালটির দায়িত্ব নেয়, তাহলে এটি ফের চালু হতে পারে। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ প্রয়োজন। কারণ, হাসপাতালটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনেক আগেই একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সমকালকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে কমিটির সঙ্গে আলাপ করব। হাসপাতালটি যদি চালু করার মতো পর্যায়ে থাকে, তাহলে শিগগিরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নয়তো আমরা হাসপাতালটিকে সংস্কার করে পুনরায় চালু করব।’