ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি থেকে এস. আলম গ্রুপের ৫১ হাজার কোটি টাকা লুটপাট

0
175

মোহাম্মদ মোশাররাফ হোছাইন খানঃ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের অর্থিক খাতে সবচেয়ে বড় অর্জন ইসলামী বাংলাদেশ পিএলসি । দক্ষিণ এশিয়ার সর্ব প্রথম ইসলামি শরিয়া-ভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৩ সালে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গতানুগতিক সুদ-ভিত্তিক ব্যাংকিং-এর বিপরীতে শরিয়া-ভিত্তিক বিকল্প হিসেবে ব্যাংকটি পরিচালিত হতে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম-অধ্যুষিত বাংলাদেশে ব্যাংকটি খুব অল্প সময়ে আর্থিক খাতে শীর্ষস্থান দখল আজকের এ পর্যায়ে আসতে স্বক্ষম হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি একটি অনুকরণীয় মডেলে পরিণত হয় প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যেই। এই সাফল্যে একে একে আরও দশটি এই ঘরানার ব্যাংক বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বেশ কয়েকটি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো এবং শাখা ব্যাংকিং চালু করেছে এবং কাংখিত সফলতাও পেয়েছে।

Advertisement

ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের অধিকাংশ ছিলো ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী ও সমমনা। এছাড়া, ব্যাংকটির একদল চরিত্রবান, ন্যায়নিষ্ঠ নিবেদিত কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রমের বদৌলতে ধারাবাহিক ভাবে কাংখিত উন্নতির ধারায় অগ্রসর হতে থাকলে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও সমমনা বাম দল সমূহ এবং সমমনা বুদ্ধিজীবীদের গাত্রদাহ হতে থাকে। তারা ব্যাংকটির বিরুদ্ধে বারবার জংগীবাদের অর্থায়নের তকমা লাগানোর চেষ্টা করে। এর সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিতা মূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারনে তারা এ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়। ইসলামী ব্যাংক জংগী অর্থায়নে জড়িত এটি কখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে প্রমানিত হয় নি।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তন ও ব্যাংকটির সাফল্য নস্যাৎ করতে বিশেষ চক্রান্তে মাঠে নামে। এ নিয়ে প্রথম দৃশ্যমান সরকারি পদক্ষেপ দেখা যায় ২০১০ সালে। ওই সময় পরিচালক পদমর্দাযায় একজন সরকারি কর্মকর্তাকে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর এই উদ্যোগের পরিপূর্ণ গতি পায়। বিযয়টি টের পেয়ে ঠিক এক বছর পরই ব্যাংকটিতে বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি পাঠায় মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক বিনিয়োগকারীরা ।

এসব উদ্বেগকে উপেক্ষা করে একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে ব্যাংকটিকে পরিবর্তন আনা হয়। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় “এস. আলম গ্রুপে”র। ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের আগে থেকেই ব্যাংকের চট্টগ্রামস্থ খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক ছিল এস. আলম গ্রুপ। তবে মালিকানা পরিবর্তনের পর এই ঋণ গ্রহণের মাত্রা বাড়তে থাকে নাটকীয়ভাবে। তাদের নামি-বেনামি ঋণ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের উত্তরবঙ্গের শাখাতেও।

ইসলামী ব্যাংকের ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ এস. আলম গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান ছিল ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার তালিকায়। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান হলো এস. আলম স্টিলস অ্যান্ড রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, এস. আলম ভেজিটেবলস ওয়েল  এবং এস. আলম সুপার এডিবল ওয়েল। ওই সময় এই তিন প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ছিল ৩,১০৮ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ — অর্থাৎ মালিকানা পরিবর্তনের ঠিক আগে এই ঋণ কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩,০০৮ কোটি টাকায়।

কিন্তু মালিকানা পরিবর্তনের পর হু হু করে বাড়তে থাকে এই ঋণের অংক। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ এস. আলম গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট দুইটি নতুন প্রতিষ্ঠান শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের তালিকায় যুক্ত হয়। আর ২০২১ সালের শেষ নাগাদ যুক্ত হয় নতুন আরও চারটি প্রতিষ্ঠান। এভাবে ২০২১ সালের শীর্ষ ঋণ গ্রহীতাদের তালিকায় এস. আলম গ্রুপ ও গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের আত্মীয়দের মোট নয়টি প্রতিষ্ঠান জায়গা করে নেয়।

২০২১ সালে এস. আলম স্টিলের ঋণ ছিল ৩,২২৪ কোটি টাকা, এস. আলম ভেজিটেবলের ৩,৮৫০ কোটি টাকা, এস. আলম সুপার এডিবেল ওয়েলের ৪,১৫৩ কোটি টাকা এবং এস. আলম কোল্ড রোল স্টিলের ১,৪৭৬ কোটি টাকা। এস. আলম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান শেমন ইস্পাত লি.-এর ঋণ ছিল ১,৪৪০ কোটি টাকা।

আর গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলমের মালিকানাধীন ইনফিনিয়া সিআর স্ট্রিপসের ঋণ ছিল ১,৪১৮ কোটি টাকা। সাইফুল আলমের মেয়ের জামাই বেলাল আহমেদের নিয়ন্ত্রণাধীন ইউনিটেক্স এলপি গ্যাসের ঋণ ছিল ১,০১৫ কোটি টাকা। সাইফুল আলমের ভাগনে মোস্তান বিল্লাহ আদিলের আদিল করপোরেশনের ঋণ ছিল ১,০৬৭ কোটি টাকা। আদিলের স্ত্রী সাদিয়া জামিলের সাদিয়া ট্রেডার্সের ঋণ ছিল ১,০৭২ কোটি টাকা। মোস্তান বিল্লাহ আদিল আবার এস. আলম গ্রুপের মালিকানাধীন গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক ও আহসানুল আলমের ইনফিনিয়া স্পিনিং মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

এই নয় প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে ইসলামী ব্যাংকে এস. আলম গ্রুপের ঋণ বেড়েছে ছয় গুনেরও বেশি। ওই বছর অবধি ইসলামী ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ১৬.৫৫% ঋণই নিয়েছিল এস. আলম গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়-২০২৪ সালের সর্ব শেষ হিসাব অনুযায়ী এস আলমের মোট ২৯ টি প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকটির মোট পাওনা টাকার পরিমাণ ৫১৪৪৬ কোটি ৩৪ লাখ ১৭ হাজার ৭ শত ৫৯.০২ টাকা। এই অবাধ লুটপাটের সুযোগ তৈরী করে দেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি এর বর্তমান ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মুহাম্মদ মনিরুল মাওলা, অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডাইরেক্টর জেকিউএম হাবিবুল্লাহ, মো. আলতাফ হুসাইন,

ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. আকিজ উদ্দিন, মো. মিফতাহ উদ্দিন, মো. সাব্বির, কাজী মো. রেজাউল করিম, মো. আব্দুল্লাহ আল-মামুন, আ.ফ.ম কামাল উদ্দিন, ক্যামেলকো তাহের আহমেদ চৌধুরীসহ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে এস. আলম কতৃক নিয়োজিত কয়েক জন কর্মকর্তা। এমনই অভিযোগ উঠেছে ব্যাংকটির ভিতর ও বাহিরের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়,

এই টাকা লুটপাট ও পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার হয়  খাতুন গন্জ, ও আর নিজাম রোড, ছকবাজার, চাকতাই, রাজশাহী, রাজশাহী নিউ মার্কেট শাখা, অন্ধরকিল্লা, জুবিলী রোড, গুলশান সার্কেল ১ ও ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখা।  মোট ২৯ টি প্রতিষ্ঠানের নামে বিশাল অংকের এই টাকা লুটপাট করা  হয়েছে। লুটপাট কৃত  প্রতিষ্ঠান ও টাকার অংক হলো -এস আলম ভেজিটেবল ওয়ল লিমিটেড এর নামে ১৫৫০৯৪২৩১৮২ টাক, এস আলমে স্টীল লিমিটেড নামে  ৭০০৩৭৫৯২৩ টাকা, এস আলম সুপার এডিবল ওয়েল লিমিটেড এর নামে ৩২৩১৯৫৭৮০১৩.৬৪ টাকা ,

এস আলম রিপাইনড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর নামে ৩৬০৮৬৭১৮১৪৫.২৫ টাকা, চেমন ইস্পাত লিমিটেড এর নামে ৩৩৩৭৬৫৫৫৬৮৭.০০  ইনফিনিট সিআর স্ট্রীপস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর নামে ২২৮১০৮৪৭৬২৯ টাকা, সেন্সুরী ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড এর নামে ৯১৮২৪৮৬৮৩৯ টাক মাসুদ প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ১৯৬০২,৯১,৭১,৬৮৮.২৬ টাকা, গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের নামে ৯৭৫২৬৫১২৮০ টাকা  সোনালী ট্রেডার্স এর নামে ৩৪৭০১২৬৮২০ ইউনিটেক্স কম্পোজিট মিলস লিমিটেডের নামে ২১৫২৫৩১৫৮৬.৮৭ টাকা,

ইউনিটেক্স এলপি গ্যাস লিমিটেডের নামে ২৩৯৫৭৬০৭০৯ টাকা, আইডিয়াল ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেড ১০৪২১৭২৮৪০৫ টাকা ইন্টারনেট ট্রেডিং এন্ড ইম্পেক্স লিমিটেডের নামে ১৩৮০৬৯৫৮১৬২ টাকা মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজ এর নামে ১০৯২৪৬৩০০৭৮ টাকা, শিমুল এন্টারপ্রাইজ এর নামে ৮০৯২০৭০৯২৮ টাকা , মেসার্স এ জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এর নামে ১১৪৩৯৪০২০৮১ টাকা ,আনোয়ার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এর নামে ৬৭২২৯২৩০৪৫ নাবা ফার্ম লিমিটেড এর নামে ৫৪৫৪২৭৭১৬৪ টাকা ,নাবিল নাবা ফুড লিমিটেডের নামে ৭২৪৫৭৬৪০৫২ টাকা, নাবিল অটো রাইস মিল ৩৫৮১৫২২৪১ টাকা,  নাবিল অটো ফ্লাওয়ার মিল ৩৮৬০৭০০০০ টাকা , আনোয়ার ফিড মিল ১২৬৮১০৩৮৪০৭

ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাক্ট প্যালেস এর নামে ১১২২৬৫২৪২৪৮ টাকা মেসার্স এ জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এর নামে ১১৪৩৯৪০২০৮১ টাকা সুলতান এসোসিয়েট এর নামে ৩৮০৯০৮৭৮৬৮ টাকা , সিলভার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ এর নামে ১০৪২৫৭১১৫২৯ টাকা, ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্স এর নামে ১১১৩৯৩৬৩৭৭৯ টাকা ,মার্কেট মাস্টার এনালাইজার লিঃ এর নামে ১০৯০৭৭২৯৪২৫ টাকা,দেশবন্ধু সুগার মিলস লিঃ এর নামে ৪১৯৬৭৫৬৭৬৩ । টাকা সর্ব মোট লুটপাটকৃত টাকার পরিমাণ ৫১৪৪৬ কোটি ৩৪ লাখ ১৭ হাজার ৭ শত ৫৯.০২ টাকা।উল্লেখ্য, শুধু ২০২৩ সালে ব্যাংকটি থেকে কোর কোন বিনিয়োগ না করে এস. আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে তুলে দেয়া হয়েছে ১৩২ বিলিয়ন টাকা।

এ সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাংকটি ব্যবস্হাপনা পরিচালক ও সিইও মুহাম্মদ মনিরুল মাওলাকে মোবাইলে ও হোয়াটস এপে কল করা হলে তিনি কল ধরেন নি।

Advertisement

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here