অপরাধ বিচিত্রা রিপোর্টঃ
দুর্নীতিবাজরা অতি সক্রিয় হওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বড় বড় দুর্নীতিবাজদের ধরতে পারছে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অর্থ লেনদেনের নামে ‘লুটপাট ও ডাকাতি’ হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি। অপরদিকে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে মানুষকে হয়রানি না করতে ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিটি অনুসন্ধান এবং তদন্ত আইন ও বিধি অনুসারে সুন্দরভাবে কমিশনে উপস্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। মঙ্গলবার সকালে দুদকের ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে সংস্থা আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ও সভাপতির দেয়া পৃথক বক্তব্যে তারা এসব কথা বলেন। এর আগে সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দুদকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন দুদক চেয়ারম্যান। সভায় অন্যান্যের মধ্যে কমিশনের দুই কমিশনার ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ ও এ এফ এম আমিনুল ইসলাম ও সচিব শামসুল আরেফিন বক্তব্য দেন।
প্রধান অতিথি মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা লেনদেনে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, অর্থ লেনদেনের এই পদ্ধতিতে ‘লুটপাট ও ডাকাতি’ হচ্ছে। মূলত এর নিয়ামক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেটরি ফ্রেম ওয়ার্ক না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, বগুড়ায় আমার এক শিক্ষককে কিছু টাকা পাঠাতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে গুনে গুনে ২ শতাংশ কেটে রেখেছে। তারপর টাকা তুলতে গেলে শিক্ষকের কাছ থেকেও টাকা কেটে নিয়েছে। এই রকম লুটপাট ও ডাকাতি করছে। অথচ ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে শূন্য দশমিক ৫ পয়সা শতাংশ হারে কাটা হয়। যেহেতু কোন নিয়ামক পরিমল নেই, তাই কাউকে ধরা যাচ্ছে না। রেগুলেটরি ফ্রেম ওয়ার্ক ছাড়া বাজার অর্থনীতি চলছে এবং এতে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও তা আশানুরূপ হবে না। ফরাসউদ্দীন বলেন, বাজার অর্থনীতিতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিবাজ-লুটেরারা অনেক বেশি সক্রিয় হয়েছে। কারণ যদি রেগুলেটরি ফ্রেম ওয়ার্ক ছাড়া টেকনোলজিক্যাল এ্যাডভান্সমেন্টে চলে যান… এই যে মোবাইল ফান্ড ট্রান্সফার, বলে মোবাইল ব্যাংকিং, আমি তীব্র ভাষায় নিন্দা করি, ধিক্কার জানাই। দেশে ই-কমার্সে কেনাকাটায় কর না থাকার সমালোচনা করে সাবেক এ গবর্নর ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘সেখানে ট্যাক্স বসানোর জন্য পাঁচ বছর ধরে বলছি, কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। ব্যক্তি পর্যায়ে বিদেশ থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগেরও সমালোচনা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে ৩৩ বিলিয়ন ডলার পড়ে আছে, বাংলাদেশের মুদ্রা অবমূল্যায়ন হতে বাধ্য। যখন অবমূল্যায়ন হবে তখন স্বল্প সুদেও হবে না, অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। সুনির্দিষ্ট নিয়ামক না থাকায় আগে বিদেশ থেকে যারা ঋণ এনেছিলেন তাদের ৯০ শতাংশই নানা কৌশলে অর্থ পাচার করেছে বলেও অভিযোগ করেন ফরাসউদ্দিন। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে বাংলাদেশ থেকে ছয় হাজার ৫০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। দেশের ভেতরে বিনিয়োগে কিছু সমস্যা আছে, থাকতেই পারে। তাহলে কী দেশের বাইরে টাকা পাঠিয়ে দেবেন ? তাই শুধু বিচার-আচারের মাধ্যমে দুর্নীত দমন সম্ভব নয়। এজন্য সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফরাস উদ্দিন আরও বলেন, দুর্নীতিবাজরা আগের চেয়ে বেশি সক্রিয়। কিন্তু দুদক বড় বড় দুর্নীতিবাজদের ধরতে পারেনি। তবে সমাজের বড় একটি অংশ দুর্নীতিবাজ হলে একা দুদকের পক্ষে সেটা দমন করাও সম্ভব নয়। দুর্নীতি ভাল কাজ নয়, তারপরও মানুষ এটি করছে। এজন্য আরও বেশি সচেতনতা বাড়ানো উচিত। তিনি আরও বলেন, ২০০৮-০৯ সালে বাজেটের আকার ছিল ৯৯ হাজার কোটি টাকা আর এখন সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা। এখানেই বুঝতে হবে, আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে। অন্যদিকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লুটপাট হচ্ছে। এ বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও বেশি তদন্ত করা দরকার। তবে আশঙ্কার কথা হচ্ছে, গত ১১ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০১৩ সালে ৫৬ বিলিয়ন ডলার ও ২০০৯ সালে ৯ বিলিয়ন ডলার। কাজেই দুদককে আরও বেশি শক্তিশালী হতে হবে। সভায় দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমরা এখনও অনেক বড় দুর্নীতিবাজের কাছে যেতে পারিনি। তবে এই যে পারিনি, তা স্বীকার করার সাহস আমাদের আছে। আমরা শুরু করলে শেষ করব, মাঝপথ থেকে ফিরে আসব না। রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কগুলো যদি ঠিক থাকে তাহলে উন্নয়ন হবে ঠিকই, প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত কাজে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরাও যাবে। তাহলে জনগণের উন্নয়নের জন্য যে অর্থনৈতিক উন্নতি দরকার সেটা করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, সম্পদের অসমতা থাকলেও আমরা ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাচ্ছি। এই উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতির গতিকে টেনে ধরাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, আমরা এমন কোন কাজ করতে চাই না, যে কাজ আমরা হাত দিয়ে শেষ করতে পারব না। অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য আমাদের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। মানুষকে হয়রানি করা যাবে না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিটি অনুসন্ধান ও তদন্ত আইন ও বিধি অনুসারে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এছাড়া যে মামলা আদালতে প্রমাণ করা যাবে না, সেই মামলা আমরা করতে চাই না, এ কথা উল্লেখ করে ইকবাল মাহমুদ বলেন, এ কারণে কমিশনের মামলার পরিমাণ কমে গেছে, তবে গুণগত মান বেড়েছে। শাস্তির হার বেড়েছে। তবে আমরা কখনই বলব না যে, আমরা শতভাগ সফল হয়েছি। আমাদের ব্যর্থতা আছে। ব্যর্থতাকে আলিঙ্গন করা একটা জরুরী ব্যাপার। আপনারা কাজ করছেন, তবে কাজে যেন গাফিলতি না হয়। ইকবাল মাহমুদ বলেন, উন্নয়ন ও দুর্নীতি যমজ ভাই। তাই এটি একইসঙ্গে চলতে থাকে। তবে আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা। এজন্য এমন কিছু করতে চাই না, যা শুরু করে শেষ করতে পারব না। তাই মামলায় জয়লাভ করা যায়, এমন মামলাগুলোই এখন শুধু আমরা করে থাকি। তবে মামলার হার কমলেও তদন্তের গুণগতমান বেড়েছে। তবে আমাদের কিন্তু সাহস আছে। এজন্য সমাজের পরিবেশ ও পরিস্থিতি বুঝে কাজ করতে হবে। দুদক জনগণের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি বলেও স্বীকার করেন চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, দুদকের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াতে হবে। জনগণের আস্থা যদি না থাকে তাহলে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটি যে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান সেই আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারিনি। তাই দুদকের প্রতি সবার আস্থা প্রতিষ্ঠায় আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে।