বিশেষ প্রতিনিধি ঃ
উচ্চ শিক্ষার বিপুল চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এ দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। দেশে বর্তমানে ৯৫টি বেসরকারি ও ৩৯ টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে মোট ১৩৪ টি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শিক্ষা প্রদানে কাজ করে যাচ্ছে। সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হলেন মহামাণ্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেট। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তাঁকে এসব প্রতিষ্ঠানের দেখ-ভালের দায়িত্ব পালন করতে হয়। কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে কমভোকেশনের মাধ্যমে আইনানুগ ভাবে সনদ বিতরণের দায়িত্বও তাঁর ওপর বর্তায়। সংশ্লিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনানুগ ভাইস চ্যান্সেলরের লিখিত আবেদনের প্রেক্ষীতে প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কোন নির্দিষ্ট তারিখে কোন নির্দিষ্ট স্থানে তিনি স্বয়ং উপস্থিত থেকে অথবা তাঁর কোন প্রতিনিধির (সাধারণত শিক্ষামন্ত্রী) মাধ্যমে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সনদ বিতরণের ব্যবস্থা করেণ তিনি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন (সংশোধিত) ২০১০ এর ধারা ৩১ এর উপধারা ১ এ বলা হয়েছে-“চ্যান্সেলর কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ কর্তৃক প্রস্তাবিত কোন ব্যক্তিকে ৪ (চার) বৎসর মেয়াদের জন্য উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর নিযুক্ত করিবেন”।
আবেদনের নিয়ম হলো-সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ট্রাস্টি বোর্ড থাকবে, যা জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ এন্ড ফার্মস এর মাধ্যমে নিবন্ধিত হবে। সেই ট্রাস্টি বোর্ড ৩ জন যোগ্য শিক্ষাবিদের নাম নিয়ম মোতাবেক ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মহামাণ্য রাষ্ট্রপতি তথা চ্যান্সেলরের বরাবর পাঠাবে। চ্যান্সেলর যোগ্যতম ব্যক্তিকে ৪ (চার) বছর মেয়াদের জন্য ভাইস-চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ দেবেন।
একই ভাবে তিনি আইনটির অন্যান্য সুনির্দিষ্ট ধারার ক্ষমতা বলে ৪ (চার) বৎসর মেয়াদের জন্য প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর এবং ট্রেজারার নিয়োগদান করেন। আইনটির ধারা ৩১ এর উপধারা ৬ এ বলা হয়েছে, যদি ভাইস-চ্যান্সেলর না থাকেন কিংবা দায়িত্ব পালনে যদি অপারগ হন তাহলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর নিয়ম মোতাবেক সাময়িক ভাবে ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করবেন। তিনিও কোন কারণে দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে বৈধ ট্রেজারার সাময়িক ভাবে ভাইস-চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করবেন। এই সাময়িক সময়ের মধ্যে ভাইস-চ্যান্সেলর নিয়োগের যাবতীয় কার্যাদি সমাধা করতে হবে। ভারপ্রাপ্ত ভাইস-চ্যান্সেলরের কোন সুযোগ আইনটিতে নেই।
গত ১৭ নভেম্বর ২০১৬ তারিখ ইউজিসি এক দাপ্তরিক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, মোট ১৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ কোন ভাইস চ্যান্সেলর নাই। তার মধ্যে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ১ নম্বর স্থান দখল করার কৃতিত্ব অর্জন করেছে। ইউজিসি বলছে, প্রতিষ্ঠানটিতে বৈধ কোন ভিসি নাই ২০০৯ সাল থেকে। মজার বিষয় হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ কোন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ২০০৮ সাল থেকে নাই, তদ্রুপ বৈধ কোন ট্রেজারার নাই ২০০০ সাল থেকে। ১৯৯৬ সালে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেই যে ড. আবুল হাসান মোহাম্মদ সাদেক প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চ্যান্সেলর হিসাবে বসেছেন, সেখান থেকে কেউ তাকে আর টলাতে পারে নাই। ভিসি পদে, থাকা ড. সাদেক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি-কাউকেই কোন তোয়াক্কা না করে একাধারে ভিসি, প্রো-ভিসি এবং ট্রেজারারের পদ দখল করে আছেন। পুরোপুরি একনায়কতান্ত্রিক ভাবে তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি চালাচ্ছেন।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটির অফিস সূত্র, ফেইসবুক এবং বিভন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, ড. সাদেক তার প্রতিষ্ঠানের কনভোকেশন আগামী ১০ ডিসেন্মর ২০১৭ তারিখ আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো এ তারিখ তাকে কে দিল?
এই প্রতিবেদকের নিবিড় অনুসন্ধানে জানা যায় জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ এন্ড ফার্মস এ নিবন্ধিত বৈধ কোন ট্রাস্টি বোর্ড এশিয়ান ইউনিভার্সিটির নাই। ড. সাদেক যখন খুশি যেমন খুশি নিজে নিজেই ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন আবার ভেঙ্গে ফেলেন। ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনি বার ট্রাস্টি বোর্ড নিজের মতো করে পরিবর্তন করে আবার সাজিয়েছেন। নিয়ম মোতাবেক জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ এন্ড ফার্মস (কাওরান বাজার) কে জানানো বা নিবন্ধন নেওয়ার কোন প্রয়োজন মনে করেন নাই। তুঘলকী কায় কারবার আর কি। বাস্তবতা হলো ড. সাদেক কাউকে পাত্তা দেন না। বর্তমানে ১২ সদস্য বিশিষ্ট যে ট্রাস্টি বোর্ডটি তিনি দেখাচ্ছেন তার চেয়ারম্যান হলেন তার পুত্র জাফর সাদেক এবং ভাইস চেয়ারম্যান তিনি নিজে।
বৈধ ট্রাস্টি বোর্ড নাই, বৈধ ট্রাস্টি বোর্ডের আবেদনের মাধ্যমে নিয়ম মোতাবেক মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্ত বৈধ কোন ভাইস চ্যান্সেলর নাই। অথচ ড. সাদেক রাস্ট্রপতির সংবিধানিক প্রোগ্রাম কনভোকেশনের তারিখ ঘোষণা করে দিয়েছেন। বুকের পাটা আছে বলতে হবে তার।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ড. সাদেক ২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর এশিয়া ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য ৩ জনের নাম সম্বলিত প্যানেলের শীর্ষে নিজের নাম প্রস্তাব করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চ্যান্সেলর তথ্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর পেশ করেছেন। ড. সাদেকের অতিত ইতিহাস বিশ্লেষন করলে নিশ্চিত বলা যায় মহামাণ্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা তার নাই। বরং এখন পর্যন্ত নিয়োগ পেতে ব্যর্থ আছেন।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি এ পর্যন্ত নিয়ম মাফিক ৪ বার কনভোকেশন করতে পেরেছে। নিয়ম নীতি অনুসরণ করার কারণে তৎকালিন রাষ্ট্রপতি মহোদয়গণ উক্ত অনুষ্ঠান সমূহে যথারীতি উপস্থিত থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মাঝে সনদ বিতরণ করে গেছেন। ১ম ও ২য় কনভোকেশন অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ৮ এপ্রিল ২০০২ এবং ৩০ জুলাই ২০০৩ সালে, যেখানে তৎকালিন রাষ্ট্রপতি ড. এ কি এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী স্বয়ং উপস্থিত থেকে উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সনদ বিতরণ করেছিলেন। ৩য় ও ৪র্থ কনভোকেশন অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ১ জুন ২০০৪ এং ৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে, যেখানে তৎকালিন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজুদ্দিন আহমেদ যথারীতি উপস্থিত থেকে উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সনদ বিতরণ করে গেছেন।
৫ম কনভোকেশন ২৭ জুলাই ২০০৯ এবং ১৬ মার্চ ২০১১ সালে মোট ২ বার আয়োজনের চেষ্টা করেও পরবর্তীতে আইগত জটিলতার কারণে স্থগীত করতে বাধ্য হন ড. সাদেক। উক্ত কনভোকেশনের ১ম আয়োজনে ৯৩০ জন শিক্ষার্থী ২০০০ টাকা হারে মোট ১৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং ২য় আয়োজনে ১৫৯৫ জন শিক্ষার্থী ৩০০০ টাকা হারে মোট ৪৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডে জমা দিয়ে রিজিস্ট্রেশন আয়োজনে ২ বারই ব্যর্থ হন সেহেতু ছাত্র-ছাত্রীদের টাকাগুলো ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তিনি ১ টাকাও কাউকে ফেরত দেন নাই।
তৎকালে মহামাণ্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এবং ইউজিসি’র চেয়ারম্যান কেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটির কনভোকেশনে হাজির হন নাই, তা নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা যেমন (১) দৈনিক প্রথম আলো ২৭ জুলাই ২০০৯ (২) সপ্তাহের বাংলাদেশ সাপ্তাহিক ১৩ আগষ্ট ও ২০ জুলাই ২০০৯ এবং (৩) দৈনিক আমাদের অর্থনীতি ০৯ আগষ্ঠ ২০১১ তারিখ বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। রিপোর্টগুলোতে যা বলা হয়েছিল (১) ড. সাদেক এর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে (২) অননুমোদিত কোর্স/প্রোগ্রাম চালু রাখা (৩) স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে না পারা (৪) বেশীর ভাগ অনুপযুক্ত শিক্ষক (৫) সনদ বাণিজ্য (৬) অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী দেখিয়ে বহুগুন বেশী শিক্ষার্থীকে সনদ প্রদানের ষড়যন্ত্র করা (৭) বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ নিজ (সাদেকের) একাউন্টে স্থানন্তর করা ইত্যাদি।
উপরোক্ত অভিযোগগুলো ড. সাদেকের বিরুদ্ধে এখনও বহাল আছে। তারপরও তিনি স্থগিত হয়ে যাওয়া অনুষ্ঠান পূনরায় করার ঘোষণা দিয়েছেন। কনভোকেশনটি কততম তা নিয়ে এক ধুম্রজালের সৃষ্টি করেছেন ফেসবুক এক্টিভিস্ট ড. সাদেক। ৫ম কনভোকেশন অনুষ্ঠিত হতে পারি নাই, অথচ তার ঘোষিত ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য কনভোকেশনকে তিনি ফেসবুকে বলে চলেছেন ৬ষ্ঠ তম।কিন্তু পত্র পত্রিকার বিজ্ঞাপনে শুধু “কনভোকেশন ২০১৭” কলে উল্লেখ করছেন। এ এক বিচিত্র খেলা সাদেক সাহেবের। ডালমে কুছ কালা হায়। অতএব সাধু সাবধান।
স্থগিত হয়ে যাওয়া কনভোকেশন পূনরায় করার ক্ষেত্রে তিনি শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রশন ফি ধার্য করেছেন ৭০০০ টাকা জন প্রতি। টাকা যেন গাছের পাতা ঝাড়া দিলে পড়বে, আর শিক্ষার্থীরা তা কুড়িয়ে নিয়ে ড. সাদেকের একাউন্টে জমা করবে। পূর্ব বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রধান আমিরুল ইসলাম এই ফি ধার্য করার ক্ষেত্রে অগ্রণি ভূমিকা পালন করেন। নাই কোন বৈধ ট্রাস্টি বোর্ড, নাই কোন বৈধ ভিসি কিংবা প্রো-ভিসি কিংবা ট্রেজারার। তাহলে কনভোকেশনের অনুমতি এবং নির্দিষ্ট তারিখ ড. সাদেক মহামাণ্য রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পেলেন কি ভাবে?
বিশ্ববিধ্যালয়টির এবং তার পারিবারিক সূত্র বলছে ড. সাদেক ভালো করেই জানেন তিনি কনভোকেশন করতে পারবেন না। তিনি আসলে আয়োজন করতে যাচ্ছেন একটি “গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনি”। যেখানে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা, ইউজিসি’র একজন ঐ পর্যায়ের কর্মকর্তা, রোটারি ক্লাবের কয়েকজন হোমড়া-চোমড়া, নিজ পরিবারের কিছু সদস্য এবং যদি সম্ভব হয় স্থানীয় এম পি কে হাজির করে অনেকটা পিকনিকের মতো করে কার্য সমাধা করবেন।
তবে ইউজিসি সূত্র বলছে, শেষ মূহুর্তে ড. সাদেক অথবা তার মনোনিত কোন ব্যক্তি যদি ভাইস চ্যান্সেলর হিসাবে নিয়াগ পেয়েও যায় তা হলেও বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। নিয়োগ প্রাপ্ত ব্যক্তি নিয়োগের তারিখ থেকে পরবর্তী ৪ (চার) বৎসরের জন্য দাপ্তরিক কার্য সমাধানের বৈধতা পাবেন। মহামাণ্য রাষ্ট্রপতি বেকডেটে কাউকে নিয়োগ নিশ্চয়ই দেবেন না। সে ক্ষেত্রে সেপ্টেম্বর ২০০৭ সাল থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৭ সাল পর্যন্ত যে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী পাশ করে গেল তাদের সনদ নিয়ে জটিলতা থেকেই যাবে। আর ফাঁক থেকে ড. সাদেক বেশ বড় অংকের টু-পাইস কামিয়ে নেবেন।