দেশি-বিদেশি চাপে অবশেষে পোশাকশ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে রাজি হয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। গত সপ্তাহে ভারপ্রাপ্ত শ্রমসচিব আফরোজা খানকে লিখিত চিঠি দিয়ে পোশাকশ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করার অনুরোধ করেছে সংগঠনটি।
বিজিএমইএ সেই চিঠিতে বলেছে, প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও দেশে-বিদেশে ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে ও শ্রম আইনের বিধান অনুযায়ী পাঁচ বছর অন্তর নিম্নতম মজুরি পুনর্নির্ধারণের বিষয় বিবেচনায় রেখে পোশাকশিল্পের জন্য নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করা প্রয়োজন।
২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর সর্বশেষ তৈরি পোশাকশিল্পে নিম্নতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা কার্যকর হয়। এর মধ্যে মূল মজুরি ৩ হাজার টাকা, বাড়িভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা এবং চিকিৎসা, যাতায়াত ও খাদ্য ভাতা ১ হাজার ১০০ টাকা। ওই বছরের ডিসেম্বরের আগে পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ছিল ৩ হাজার টাকা। একেকটি মজুরিকাঠামো পাঁচ বছরের জন্য নির্ধারণ করা হয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘বৈশ্বিক পোশাক খাতে নিম্নতম মজুরি-২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি এখন ৬৮ মার্কিন ডলার। ভারতে ৭৮, ইন্দোনেশিয়ায় ৯২, পাকিস্তানে ৯৯, কম্বোডিয়ায় ১২৮ এবং মালয়েশিয়ায় ২২৫ ডলার। প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকেরা কম মজুরি পান। তবে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘অতীতে আমরা দেখেছি মজুরি বোর্ড গঠনের আগে একটি স্বার্থান্বেষী মহল শ্রমিকদের উসকে দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। সে রকম কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য আমরা সরকারকে মজুরি বোর্ড গঠনের অনুরোধ জানিয়েছি।’ কোনো ধরনের চাপ ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেউ চাপ দেয়নি। তবে ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল ও তিনটি ফেডারেশন মজুরি বৃদ্ধির জন্য লিখিত আহ্বান জানায়।’
অবশ্য একাধিক শ্রমিক সংগঠনের নেতা বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শ্রমিকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। শিগগিরই মজুরি না বাড়ানো হলে যেকোনো সময় বড় ধরনের শ্রম অসন্তোষের ঘটনা ঘটতে পারে। তা ছাড়া দেশি-বিদেশি শ্রমিক সংগঠনগুলো গত ডিসেম্বর থেকেই মজুরি বাড়ানোর চাপ দিয়ে আসছে। এসব কারণেই মজুরি বাড়ানোর বিষয়ে ইতিবাচক হতে বাধ্য হয়েছে বিজিএমইএ।
গত ডিসেম্বরে আশুলিয়ায় মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকেরা আন্দোলনে নামে। আন্দোলন থামাতে ৫৯ কারখানা বন্ধ করে দেন মালিকেরা। দেড় হাজার শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়। নয়টি মামলা করেন কয়েকজন কারখানা মালিক। এসব মামলায় শ্রমিকনেতাসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দমন-নিপীড়নে আন্দোলন থামলেও দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের চাপে এইচঅ্যান্ডএম, গ্যাপ, ইন্ডিটেক্সসহ ২০টি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি মজুরি পর্যালোচনার অনুরোধ জানায়।
আশুলিয়ার ঘটনার পরপরই ১২টি শ্রমিক সংগঠনের জোট গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের নেতারা শ্রম প্রতিমন্ত্রীকে সাত দফা দাবি আদায়ে স্মারকলিপি দেন। সেখানে তাঁরা দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিচার করে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার (মূল মজুরি ১০ হাজার) টাকা করার দাবি জানান। এদিকে গত মাসে ২২টি শ্রমিক ফেডারেশনের জোট ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল বিজিএমইএর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে। সেখানে শ্রমিকনেতারা মজুরি বাড়াতে বিজিএমইএকে উদ্যোগী হওয়ার অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে তাঁরা বলেন, মজুরি বোর্ড গঠনের জন্য শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া না হলে যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটতে পারে। পরে সংগঠনটি বিজিএমইএকে লিখিতভাবে এ অনুরোধ জানায়।
জানতে চাইলে ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘মজুরি বৃদ্ধি শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি। তাই মজুরি বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করতে বিজিএমইএর চিঠিকে আমরা স্বাগত জানাই।’ তিনি আরও বলেন, মজুরি বোর্ড নিয়ে যাতে কোনো প্রশ্ন না ওঠে, সে বিষয়ে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। শ্রমিক প্রতিনিধি নির্বাচন যেন কারও ইচ্ছামাফিক না হয়।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী ও ভারপ্রাপ্ত শ্রমসচিব দেশের বাইরে থাকায় তাঁদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তবে যুগ্ম সচিব আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী দেশে ফিরলেই পোশাকশিল্পের নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করা হবে।’ সেটি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেও হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জানতে চাইলে গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার গত রাতে বলেন, ‘বর্তমানে ৬০-৬৫ টাকা কেজি দরে চাল কিনতে হচ্ছে। বছর শেষ হলেই বাড়িভাড়া বাড়ে। শ্রমিকদের জীবনধারণ দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। সে জন্যই গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই আমরা মজুরি বাড়ানোর দাবি করে আসছিলাম। আশা করছি, শিগগিরই মজুরি বোর্ড গঠন হবে।’