বগুড়ায় শ্রমিক লীগ নেতা তুফানের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে এবার নীলফামারীর ডিমলায় ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, নির্যাতনকারীদের হুমকিতে প্রকাশ্যে চিকিৎসাও নিতে পারছেন না ওই গৃহবধূ। শনিবার সকালে জেলার বাইরের একটি হাসপাতালে গোপনে গিয়ে ভর্তি হন তিনি। সেখানেই গণমাধ্যমকর্মীরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
নির্যাতনের শিকার গৃহবধূর নাম শেফালী বেগম (৩২)। তিনি ডিমলা উপজেলার খালিশা চাঁপানী ইউনিয়নের বাইশপুকুর কোলন ঝাড় গ্রামের লালন মিয়ার স্ত্রী। শেফালী জানান, ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন ওই প্রভাবশালী নেতারা। তারা তাকে গরু চুরির মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ প্রকৃত ঘটনা জেনে তাকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়ে চলে যায়।
জানা যায়, জমিজমা সংক্রান্ত এক বিবাদে শেফালীর বাবা মবিয়ার রহমানকে ২০১২ সালের ২৯ জুলাই কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। এ হত্যা মামলায় এলাকার ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। মামলাটি বর্তমানে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। আগামী ২২ আগস্ট এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। প্রভাবশালীরা শেফালীকে ওই মামলা মীমাংসার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। এতে আপস না করায় সম্প্রতি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাও ঠুকে দেয় প্রতিপক্ষ। ফলে শেফালীর একমাত্র ভাই রমজান পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এলাকাবাসী জানান, শেফালী বেগমের দুই ছেলেমেয়ে। তার স্বামী ঢাকায় রিকশা চালান। ঘটনার দিন শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে একই গ্রামে বসবাসকারী তার বড় বোন আকলিমার সঙ্গে তার (আকলিমা) স্বামী রফিকুল ইসলামের ঝগড়া হয়। ঝগড়া থামাতে যান শেফালী। এ নিয়ে ধাক্কাধাক্কি হলে শেফালীর বড় বোনের স্বামী সামান্য আহত হন। আর এ ঘটনাকে পুঁজি করে হত্যা মামলায় জামিনে থাকা আসামিরা গ্রাম্য মাতব্বরদের সহযোগিতায় শেফালীকে গরু চুরির মিথ্যে ঘটনা সাজিয়ে গাছে বেঁধে নির্যাতন করে।
অভিযোগে জানা যায়, খালিশা চাঁপানী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কাদের, তার ছেলে ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সেক্রেটারি শিমুল ইসলাম, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তানজিদার রহমান, সদ্য বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী মোসলেম উদ্দিনের ছেলে আশরাফুল ইসলাম, সামছুলের ছেলে মজনুর রহমান মঞ্জু এবং এলাকার দেবারু ও দবিরুল গৃহবধূ শেফালীকে নির্যাতন করেন। অভিযুক্তদের উপস্থিতিতে নির্যাতনের একটি ভিডিওচিত্র যুগান্তরের হাতে এসেছে।
মারধরের সময় শেফালী নির্যাতনকারীদের বেশ কয়েকজনের হাতে কামড় দেন। এতে তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা গরু চুরির অভিযোগ ও মাদকসহ শেফালীকে ধরিয়ে দিতে ডিমলা থানা পুলিশকে খবর দেয়। এ জন্য শেফালীর বড় বোনের স্বামী রফিকুলকে দিয়ে থানায় লিখিত অভিযোগও করায়।
ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ সর্দার ও চার নম্বর ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ রশিদুল সর্দার বলেন, ঘটনার দিন দুপুর ১২টার দিকে গৃহবধূ শেফালীকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের ঘটনা দেখতে পেয়ে ডিমলা থানায় জানাই এবং শেফালীর বাঁধন খুলে দিই।
বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ডিমলা থানার এসআই ফিরোজ, দু’জন নারী পুলিশসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে আসেন। তারা প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে শেফালীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে চলে যান।
এদিকে গোপনে চিকিৎসাধীন গৃহবধূ শেফালীর সঙ্গে কথা হয় সাংবাদিকদের। শেফালী জানান, পুলিশ চলে যাওয়ার পর তার পরিবারের লোকজন তাকে ডিমলা হাসপাতালে নিতে চাইলে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তানজিদার রহমান এসে হুমকি দেন। বলেন, শেফালীকে হাসপাতালে ভর্তি করলে ফেনসিডিল দিয়ে তাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়া হবে। রাতে স্থানীয় একজন চিকিৎসক এসে তাকে বাড়িতে স্যালাইন দিয়ে যান। শনিবার ভোরে জেলার বাইরে পালিয়ে গিয়ে একটি হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।
এ ব্যাপারে খালিশা চাঁপানী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তার ছেলে ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক শিমুল ইসলাম বলেন, কারা কেন ওই গৃহবধূকে গাছে বেঁধে নির্যাতন করেছে আমাদের জানা নেই। পুলিশের সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম আমি। এ ছাড়া আর কিছুই জানি না।
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহরাব হোসেন বলেন, শেফালী বেগম নামের এক গৃহবধূকে গাছে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে বলে শুনেছি। তবে এ ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী জড়িত নয়।
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তানজিদার রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বিকালে পুলিশের সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। শুনেছি ওই মহিলা নাকি ভালো না। আর কিছু জানি না।
ডিমলা থানার এসআই ফিরোজ বলেন, দিন-দুপুরে গরু চুরির ঘটনাটি তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া যায়নি।
ডিমলা থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ওই নারীর নামে গরু চুরি ও মানুষজনের হাতে কামড় দেয়ার অভিযোগ এসেছিল। এ বিষয়ে থানায় কোনো মামলা হয়নি। দিনভর গাছে বেঁধে নির্যাতনের বিষয়টি আমার জানা নেই।