দুদকের তালিকায় ১১১ শিক্ষক কোচিং বাণিজ্য বন্ধে আইন প্রণয়ন ও জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ

0
885

কোচিং বাণিজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে রাজধানীর ৯টি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১১১ জন শিক্ষকের তালিকা চূড়ান্ত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান টিম। এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং কোচিং বন্ধে আইন প্রণয়নের সুপারিশসহ তালিকাটি প্রতিবেদন আকারে মঙ্গলবার কমিশনের কাছে দাখিল করেছে অনুসন্ধান টিম। দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম, সহকারী পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. আবদুল ওয়াদুদ, মনিরুল ইসলাম, ফজলুল বারী ও উপ-সহকারী পরিচালক আতাউর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ৬ সদস্যের অনুসন্ধান টিম প্রায় আট মাস অনুসন্ধান শেষে শিক্ষকদের এ তালিকা তৈরি করে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অনুসন্ধান টিমের প্রধান দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, আমরা কোচিংয়ের বিষয়ে নীতিমালা পর্যালোচনা করে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রয়োজনীয় সুপারিশ করেছি। তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী কোচিংয়ে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সরাসরি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব না হওয়ায় কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কমিশন পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। অনুসন্ধান টিমের আরেকজন সদস্য বলেন, আমাদের আরও অনুসন্ধানের সুযোগ রয়েছে। কারণ এখনও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুসন্ধানের বাইরে রয়েছে। জানা গেছে, তালিকায় স্থান পাওয়া ১১১ শিক্ষকের মধ্যে রয়েছে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতিঝিল শাখার ৩২ জন ও বনশ্রী শাখার ৪ জনসহ মোট ৩৬ জন, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২৪ জন, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১ জন, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ১২ জন, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪ জন, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৭ জন, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ১৪, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ৮ জন এবং রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৫ জন। এর আগে অনুসন্ধান টিমের প্রথম দফায় কমিশনে দাখিল করা প্রতিবেদনে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ১০২ জন শিক্ষকের নাম ছিল। পরে কমিশনের সিদ্ধান্তে বর্ধিত তদন্তে আরও ৯ জন কোচিংবাজ শিক্ষকের নাম যুক্ত হয়।
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কোচিং বাণিজ্যে যুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ করলেও কোচিং বন্ধে কোনো আইন হয়নি। সুনির্দিষ্ট আইনের আলোকে শাস্তির বিধান না রাখলে চূড়ান্তভাবে কোচিং বন্ধ করা কঠিন। ফলে সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান রেখে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে কোচিং বাণিজ্য রোধে এর সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী এক বিদ্যালয় থেকে অন্য বিদ্যালয়ে, এক শাখা থেকে অন্য শাখায়, দিবা শিফট থেকে প্রভাতি শিফটে বা প্রভাতি শিফট থেকে দিবা শিফটে নির্দিষ্ট সময় অন্তর বদলির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা যেতে পারে। ২০১২ সালের ২০ জুন কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে নীতিমালা তৈরি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নীতিমালায় নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং অথবা প্রাইভেট পড়াতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন ছাত্রছাত্রীকে নিজ বাসায় পড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে লিখিতভাবে ছাত্রছাত্রীর নাম ও রোল নম্বরসহ তালিকা জানাতে হবে। শুধু তাই নয়, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা ওই ১০ শিক্ষার্থীর মধ্যে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজনকে পড়ালেও তাকে অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কোচিং সেন্টারের নামে বাসা ভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছে। এমনকি কোনো শিক্ষক বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা কোচিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হতে পারবেন না। শাস্তির বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি বা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে সাময়িক বা চূড়ান্ত বরখাস্ত, এমপিওভুক্ত শিক্ষক হলে এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন-ভাতাদি স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন এক ধাপ অবনমিতকরণ ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে। দুদক টিমের একজন কর্মকর্তা বলেন, কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকাটি প্রস্তুত করার আগে তারা সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে অনেককেই হাতেনাতে কোচিংয়ে পান। তাদের সতর্ক করার পরও তারা একইভাবে কোচিং করিয়ে আসছিলেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, কোচিংয়ে জড়িত সবচেয়ে বেশি শিক্ষক রয়েছেন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে। প্রথম ধাপে ৩৬ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করা হলেও আরও কিছু শিক্ষকের বিষয়ে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। তাদের একটি তালিকাও আছে দুদকের হাতে।
১১১ কোচিংবাজ শিক্ষকের তালিকা : দুদকের অনুসন্ধানে যে ১১১ জন কোচিংবাজ শিক্ষককে চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের মধ্যে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের রয়েছেন ৩৬ জন। তারা হলেন- নিজাম উদ্দিন কামাল (ইংরেজি), আবদুল মান্নান (রসায়ন), উম্মে ফাতিমা (বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়), মো. আজমল হোসেন (বাংলা), গোলাম মোস্তফা (গণিত), আশরাফুল আলম (রসায়ন), বাবু সুবাস চন্দ্র পোদ্দার (রসায়ন), লাভলী আখতার, তাসমিন নাহার, মতিনুর (ইংরেজি), উম্মে সালমা (ইংরেজি), মো. আবদুল জলিল (ব্যবসায় শিক্ষা), মোহাম্মদ ফখরুদ্দীন (রসায়ন), মনিরা জাহান (ইংরেজি), ফাহমিদা খানম পরী (গণিত), লুৎফুন নাহার (গণিত), হামিদা বেগম (গণিত), নাজনীন আক্তার (গণিত), তৌহিদুল ইসলাম (ইংরেজি), সুরাইয়া জান্নাত (ইংরেজি), মো. সফিকুর রহমান-৩ (গণিত ও বিজ্ঞান), মো. শফিকুর রহমান সোহাগ (গণিত ও বিজ্ঞান), নুরুল আমিন (গণিত), মনিরুল ইসলাম (ইংরেজি), রফিকুল ইসলাম (সমাজবিজ্ঞান), অহিদুজ্জামান (বাংলা), মাকসুদা বেগম মালা, আলী নেওয়াজ আলম করিম, মো. আবুল কালাম আজাদ ও মো. আবদুর রব এবং বনশ্রী শাখার মো. শফিকুল ইসলাম (ইংরেজি), মো. মাহবুবুর রহমান (পদার্থবিজ্ঞান), মো. মোয়াজ্জেম হোসেন (গণিত) ও আবদুল হালিম (গণিত)।
মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২৪ জনের মধ্যে রয়েছেন- সহকারী প্রধান শিক্ষক এনামুল হক, মেজবাহুল ইসলাম (ইংরেজি), সুবীর কুমার সাহা (গণিত), মো. সাইফুল ইসলাম, মোহনলাল ঢালী, বাসুদেব সমদ্দার, বকুল বেগম, আসাদ হোসেন (ইংরেজি), প্রদীপ কুমার বসাক, আবুল খায়ের, শারমীন খানম, মো. কবীর আহমেদ, খ. ম. কবির আহমেদ, মো. দেলোয়ার হোসেন, মাও. কামরুল হাসান, মো. রুহুল আমিন-২, মো. কামরুজ্জামান, শেখ শহীদুল ইসলাম, শুকদেব ঢালী, হাসান মঞ্জুর হিলালী, আমান উল্লাহ আমান, হামিদুল হক খান, রমেশ চন্দ্র বিশ্বাস ও চন্দন রায়।
মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ১২ শিক্ষক রয়েছেন তালিকায়। তারা হলেন- প্রভাতি শাখার সহকারী শিক্ষক আবুল হোসেন মিয়া (ভৌতবিজ্ঞান), মো. মোখতার আলম (ইংরেজি), মো. মাইনুল হাসান ভূঁইয়া (গণিত), মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন (গণিত), মুহাম্মদ আফজালুর রহমান (ইংরেজি), মো. ইমরান আলী (ইংরেজি), দিবা শাখার সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ কবীর চৌধুরী, এবিএম ছাইফুদ্দীন ইয়াহ, মো. মিজানুর রহমান, মো. আবুল কালাম আজাদ, মো. জহিরুল ইসলাম ও সহকারী শিক্ষক মো. জামাল উদ্দিন বেপারি। মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫ জনের নাম এসেছে তালিকায়। তারা হলেন- প্রভাতি শাখার সহকারী শিক্ষিকা নূরুন্নাহার সিদ্দিকা (সামাজিক বিজ্ঞান), দিবা শাখার সহকারী শিক্ষক শাহ মো. সাইফুর রহমান (গণিত), মো. শাহ আলম (ইংরেজি), মোসা. নাছিমা আক্তার (ভূগোল)। খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের রয়েছেন একজন। তিনি হলেন সহকারী শিক্ষক মো. নাছির উদ্দিন চৌধুরী। এ প্রতিষ্ঠানের আরও কিছু শিক্ষকের নাম যাচাই করা হচ্ছে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৭ জনকে শনাক্ত করেছে দুদক টিম। তাদের কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- প্রভাতি শাখার সহকারী শিক্ষক কামরুন্নাহার চৌধুরী (ইংলিশ ভার্সন), ড. ফারহানা (পদার্থবিজ্ঞান), সুরাইয়া নাসরিন (ইংরেজি), লক্ষ্মী রানী, ফেরদৌসী ও নুশরাত জাহান।
এছাড়া মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ১৪ জনের নাম এসেেেছ কোচিং ব্যবসায়ীর তালিকায়। তারা হলেন- প্রভাতি শাখার সহকারী শিক্ষক যোবায়ের মাহমুদ (গণিত), মো. নুরুদ্দিন (গণিত), মো. মেহেদী হাসান (গণিত), শহীদুল ইসলাম (ইংরেজি), তুহিনুর রহমান (রসায়ন), ফেরদৌস হাসান (ইংরেজি), শামসুন্নাহার (বাংলা), মো. মাছুদ আলম, (ইংরেজি), দিবা শাখার সহকারী শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন (ইংরেজি), মো. মোখলেছুর রহমান (গণিত), মো. নূরুজ্জামান (রসায়ন), মো. সাইফুল্লাহ (ইংরেজি), তাজুল ইসলাম (বাংলা) ও সহীদুর রহমান বিশ্বাস (ইংরেজি)। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ৮ জনের নাম এসেছে অনুসন্ধানে। তারা হলেন- মো. শাহজাহান সিরাজ (গণিত), মোহাম্মদ ইসলাম (গণিত), জাকির হোসেন (গণিত), মো. শাহজাহান (গণিত), মো. আবদুল ওয়াদুদ খান (সামাজিক বিজ্ঞান), মো. আলতাফ হোসেন খান (ইংরেজি), মো. আযাদ রহমান (ইংরেজি) ও রণজিৎ কুমার শীল (গণিত)।
আর রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে প্রাথমিক অনুসন্ধানে ৫ জনের সম্পৃক্ততা মিলেছে। তারা হলেন- মইনুল ইসলাম (গণিত), মো. আলী আকবর (গণিত), মো. রেজাউর রহমান (গণিত), মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম (ইংরেজি) ও মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (রসায়ন)।

Advertisement
Advertisement

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here