দুর্নীতিবাজ কাউকে ক্ষমা করা হবে না বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তবুও দুর্নীতি থামছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের টাকা মেরে খাচ্ছে তাদের নিয়োগকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জাকারিয়া অ্যান্ড কোং। অনৈতিকভাবে প্রত্যেক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাছ থেকে সম্প্রতি এক লাখ টাকা করে নিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। কয়েক মাস আগে বর্ধিত বেতন তোলার সময়ও প্রত্যেকের কাছ থেকে ২০-৩০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য নিরুপায় হয়ে এসব টাকা দিয়েছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। বিভিন্ন পর্যায় থেকে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে সমকালের অনুসন্ধানে টাকা নেওয়ার সত্যতা মিলেছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টাকা মেরে খাওয়ার ঘটনা জানলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ছাড়াও সদরঘাট অফিস, মতিঝিল, আইজি গেট ও মিরপুরে অবস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিবাসে পরিচ্ছন্নতার কাজে নিযুক্ত জাকারিয়া অ্যান্ড কোং। প্রতিষ্ঠানটির মালিক টিপু সুলতান নামের এক ব্যক্তি। মতিঝিল নাহার ম্যানশনে জাকারিয়া অ্যান্ড কোং-এর অফিস। সব মিলিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ঢাকার বিভিন্ন অফিসে আড়াইশ’ পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাজ করছেন। সরকার নির্ধারিত বেতন কাঠামোর আলোকে প্রত্যেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রতি মাসে ১৫ হাজার ৫৫০ টাকা করে পেয়ে থাকেন। এর বাইরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সার্ভিস চার্জ হিসেবে প্রতি মাসে মোট বেতনের ওপর দশ শতাংশ করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট প্রধান কার্যালয়ের সব স্থাপনা এবং সেনাকল্যাণ ভবনে অবস্থিত প্রধান কার্যালয়ের ভাড়া করা ১১টি ফ্লোর পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য টেন্ডার ডাকা হয়। সেখানেও কাজ পেয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে টানা তিন বার কাজ পেয়েছে তারা। বারবার এই প্রতিষ্ঠান কাজ পাওয়া নিয়ে রয়েছে সমালোচনা।
পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার মাধ্যমে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে সমকালের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান করা হয়। প্রথমে কয়েকজন কর্মীর কাছে জানতে চাইলে পরিচিত না হওয়ায় কেউই এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। পরে নিজের পরিচয় গোপন করে কৌশলে বিভিন্ন কর্মকর্তার কক্ষে ডেকে ২৭ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সঙ্গে কথা হয়। এসব কর্মকর্তা এই প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলেন। টাকার বিষয়টি জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার পাল্টা প্রশ্ন ছিল- স্যার আপনি জানলেন কী করে? কোম্পানি এ খবর জানলে নিশ্চিতভাবে চাকরি যাবে। আবার ওই টাকাও যাবে। দু-একজন কোনো কথা না বলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। যারা সময় নিয়ে কথা বলেছেন, তাদের প্রত্যেকে বিষয়টি অন্য কারও কাছে না বলার অনুরোধ করেছেন। একপর্যায়ে টাকা জোগাড় করতে গিয়ে কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে তা তুলে ধরেন তারা।
জানতে চাইলে জাকারিয়া অ্যান্ড কোং-এর মালিক টিপু সুলতান সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান। কেউ কোনো অন্যায় করলে তাকে দায়বদ্ধতার আওতায় রাখার স্বার্থে টাকা নেওয়া হয়েছে। টাকা নেওয়া আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। কেউ যদি গ্যারান্টার দিতে পারে, তার কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয় না। যারা উপযুক্ত গ্যারান্টার দিতে পারে না, তাদের কাছ থেকে এক লাখ টাকা করে নেওয়া হয়- এ রকম প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না না, এক লাখ তো আমরা বলি। তবে এত টাকা ওরা পাবে কই? ২০-৫০ হাজার টাকা দেয়।’ তিনি বলেন, পুরনো যারা আছে তাদের কারও টাকা দিতে হচ্ছে না। এ রকম কেউ যদি আপনাকে বলে, আমার অফিসে পাঠিয়ে দেবেন।
এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানান, ছয় বছর ধরে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে কাজ করছেন। যখন কাজে ঢুকেছিলেন, তখন তার কাছ থেকে একবার জাতীয় পরিচয়পত্র, নাগরিক সনদ ও অষ্টম শ্রেণি পাস সনদের ফটোকপি নেওয়া হয়। নতুন করে আবার এসব কাগজ চাওয়ার পর তিনি তাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান জাকারিয়া অ্যান্ড কোং-এর অফিসে যান। সেখানে গেলে জানানো হয়, কাগজ জমা থাকলে আর প্রয়োজন নেই। তবে জামানত হিসেবে এক লাখ টাকা দিতে হবে। অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে একই রকম তথ্য জানতে পারেন তারা। প্রত্যেককে বলা হয়েছে, দ্রুত টাকা না দিলে চাকরি চলে যাবে। এরপর টাকা জোগাড় করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। আবার যান ওই অফিসে। সেখানে গিয়ে টাকা পরে দিলে হবে কি-না জানতে চান। তখন ১৫ দিনের সময় দিয়ে বলা হয়, এই সময়ের মধ্যে টাকা না দিলে তার জায়গায় নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চাকরি রক্ষায় পরে তার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে এক লাখ টাকা এনে জমা দেন তিনি।
আরেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলেন, পাঁচ বছর আগে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা মাসিক বেতনে এই চাকরিতে যোগ দেন। পরে বেতন আট হাজার টাকা হয়। নতুন বেতন কাঠামো কার্যকরের পর তাদের বেতন হয় ১৫ হাজার ৫৫০ টাকা। বাড়তি বেতন পাওয়ার পরেই ঠিকাদার তার অফিসে ডেকে নিয়ে টাকা নিয়েছে। তবে কোনো ধরনের প্রমাণপত্র দেওয়া হয়নি। প্রমাণপত্র চাইলে বলা হয়, বাড়াবাড়ি করলে চাকরি যাবে। চাকরি যাওয়ার ভয়ে বিষয়টি নিয়ে কারও সঙ্গে বলতেও পারছেন না। আবার সইতেও পারছেন না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সবাই এখন জেনে গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মহা. নাজিমুদ্দিন সমকালকে বলেন, টাকা নেওয়ার বিষয়ে তাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে কেউ টাকা নিলে প্রমাণ সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মূলত ২০১৫ সালের জুলাইতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অফিস সহকারী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্যও একটি বেতন কাঠামো হয়। এর আগে তাদের বেতন ছিল আট হাজার টাকা। তবে ঠিকাদারের সঙ্গে নির্দিষ্ট মেয়াদ ও বেতন চুক্তি থাকায় নতুন কাঠামো কার্যকরে কিছুটা সময় নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সব ঝামেলা শেষে গত জুলাইতে তাদের এরিয়ার বিলসহ প্রত্যেককে প্রায় এক লাখ টাকা করে দেওয়া হয়।
পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা জানান, ওই টাকা তাদের অ্যাকাউন্টে আসার পর থেকে নানা উপায়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে টাকা নিচ্ছে। মূলত ওই এক লাখ টাকা করে তাদের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ ছিল শেষ দিকে। তখন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বলা হয়, নতুন করে এ প্রতিষ্ঠান কাজ না পেলে সবার চাকরি যাবে। আর কাজ পাওয়ার জন্য কিছু খরচ করতে হবে। এ জন্য সবার কাছ থেকে ২০-৩০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। ওই সময় বলা হয়েছিল, কাজ পাওয়া গেলে প্রত্যেককে আবার টাকা ফেরত দেওয়া হবে। তবে কাজ পাওয়ার পর উল্টো নতুন করে এক লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে।