স্টাফ রিপোটারঃ রাজধানীর উপকন্ঠ ধামরাইয়ে দুর্নীতির দুই মানিকজোড়কে নিয়ে তোলপাড় চলছে। ধামরাই পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমজাদ হোসেন ও তার ঘনিষ্ট আশরাফ আলীর আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন সম্পদ অর্জন, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে জমি দখল ও বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়ে পুলিশ, র্যাবসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করছে বলে বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) রয়েছে অভিযোগ। গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সদস্য এরইমধ্যে তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে। পৌরসভার মেয়র এবং অন্যান্য কাউন্সিলর ও স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে অবগত। তাদের ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস করে না। স্থানীয় প্রশাসনের অনেকেই এখন ‘ম্যানেজ’ বলে অভিযোগ রয়েছে।
একাধিক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, অবৈধ পন্থায় অর্জিত অর্থে তারা রাষ্ট্রের মোটা অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছেন। নামে বেনামে, দেশে বিদেশে তার রয়েছে সম্পদের পাহাড়। হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাচার করছেন অর্থ। বেনাপোল সীমান্তের ওপাড়ে দুটি মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানীতে রয়েছে তাদের মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ। প্রায় রাতেই আমজাদ ও আশরাফ মিলে মদ নারীর আসড় জমায় বলেও এলাকায় অভিযোগ রয়েছে ।
একাধিক হত্যা মামলার আসামি হয়ে এক সময় গ্রীসে পালিয়ে যাওয়া আমজাদ ২০১১ সালে দেশে ফিরে মোটা অঙ্কের টাকায় মামলা থেকে অব্যহতি পান। গ্রীস শাখা জিয়া পরিষদের সাবেক সভাপতি আমজাদ ৫ বছর আগে স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে নাম লেখান। এরপর মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করে তিনি ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বনে যান। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একজন নেতার স্ত্রীকে ম্যানেজ করে অবৈধ পন্থায় গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। তার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম ‘আদিব ইঞ্জিনিয়ারিং’ অথচ প্রতিবছর রাষ্ট্রের বড় অঙ্কের টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে দিব্যি বহালে আছেন। আমজাদ হোসেন তার পিএস হিসেবে পরিচিত সঞ্চয় বনিক অপু এবং শুভ বনিক বান্টির মাধ্যমে বেনাপোল সীমান্তের ওপাড়ে ভারত অংশে দুটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানে এবং হুন্ডির মাধ্যমে কলকাতায় কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন। আমজাদের ছোটভাই শামীম হোসেনের নামে রয়েছে একাধিক ব্যাংক হিসাব ও ১০ কোটি টাকার সম্পদ। যা আমজাদ তার ভাইয়ের নামে রেখেছেন। রীতা সূত্রধর নামে এক মহিলা তার ঘনিষ্ট। ধূর্ত আমজাদ প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে আস্থাভাজন ওই মহিলার নামেও সম্পদ রেখেছেন। প্রভাত রাজবংশী, দীপু, চান্দুল নামে চার যুবক তার ঘনিষ্ট। যারা তার অবৈধ সম্পদ ও এর উৎস্য অবগত। উক্ত তিন যুবক ইয়াবা ও ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদক ব্যবসায় জড়িত বলে এলাকায় প্রচলিত আছে। ধামরাই থানার এসআই সাইফুল ইসলাম খুচরা মাদক ববসায়ী প্রভাতকে গত ২৩ জুন ইয়াবার চালানসহ আটক করলে কাউন্সিলর আমজাদ ৪০ হাজার তাকে গভীররাতে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেন বরে অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিষয়টি এলাকায় ওপেন সিক্রেট।
অভিযোগ রয়েছে, আমজাদ হোসেন তার নিজের, স্ত্রী ও সন্তানদের নামে ডাকঘর ও একাধিক ব্যাংকে ৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র রেখেছেন। তার স্ত্রীর কমপক্ষে ১২৪ ভরি ওজনের স্বর্নালঙ্কার রয়েছে। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ট্রাষ্ট ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংকের ধামরাই শাখায় তার নামে বেনামে একাধিক হিসাবে রয়েছে ৪ কোটি টাকা। ধামরাই আইঙ্গন (কেলিয়া মৌজা) ১০ শতাংশ জমি রয়েছে, যার বর্তমান বাজার মূল্য ৪ লাখ টাকা শতাংশ হারে ৪০ লাখ টাকা। কায়েতপাড়া ব্যাস এন্ড মিটান সমিতির ২০ শতাংশ জমি ৪ লাখ টাকা শতাংশ হারে ৮০ লাখ টাকায় বিক্রি করে হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাচার করেছেন। জয়পুরা বাজারে ৩০ শতাংশ সরকারী জমি দখল করে ৬২টি দোকান বানিয়ে প্রতিটি ৮ লাখ টাকা করে ৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা নিয়েছেন। ধামরাই গার্লস স্কুল সংলগ্ন ‘মিনানগরে’ তার নামে ২০ শতাংশ জমি রয়েছে। ৮ লাখ টাকা শতাংশ হারে যার মূল্য ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। কাকিলাজানি নদী ভরাট করে (দাগ নং- এসএ ৫৪৭, আরএস ১১১৭) ৬২ শতাংশ জমি দখল করেছেন। যার মূল্য ২ লাখ টাকা শতাংশ দরে ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ধামরাই পশ্চিম কায়েতপাড়ার শ্রীধাম বণিকের ২০ শতাংশ জমি আমজাদ গং জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছে। যার মূল্য ৭০ লাখ টাকা। ধামরাই থানার ডাউটিয়া মৌজার জয়পুরা গ্রামের (ভিপি মামলা নং ৬/৮০) ৮ একর সরকারী সম্পত্তি দখল করে নিয়েছেন আমজাদ। যার মূল্য ১০ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে ধামরাই দক্ষিণপাড়ায় শ্রী শ্রী কালী মন্দিরের ৭ শতাংশ জমি দখল করে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে আমজাদ হোসেন। ধামরাই কায়েতপাড়ার মৃত কুব্বত আলী খানের পুত্র লিয়াকত আলীর ২০ লাখ টাকা মূল্যের ৫ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছেন আমজাদ হোসেন। কুমরাইল এলাকার সাইদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে জমির বায়না বাবদ ৮০ লাখ টাকা নিয়ে আতœসাত করেছেন আমজাদ হোসেন। শরীফবাগ মৌজার ৫৪৭ নম্বর দাগে বংশী নদীর (কাকিলাজানি নদী) প্রায় ৫ একর জমি দখল করে সেখানে রাইস মিলের ধান শুকানোর মাঠ তৈরী করেছে এই চক্র। যেখানে আমজাদের বিনিয়োগ দুই কোটি টাকা।
জয়পুরা মৌজার লীজের ২০ শতাংশ সম্পত্তি (ভিপি মামলা নং ২০৫/৭৮) জোরপূর্বক দখল করে মার্কেট নির্মাণ করে দোকান বিক্রি করেছেন আমজাদ। যার মূল্য ৫০ লাখ টাকা। কালামপুর বাজারে সরকারী জমি দখল করে দোকানপাট বানিয়ে ইচ্ছেমতো মাসিক ভাড়া আদায় করছেন আমজাদ হোসেন।
এছাড়া ধামরাই সদরের সিধাম বনিকের ৭ লাখ টাকা শতাংশ দরে ১৩ শতাংশ জমি দখল করে ৯১ লাখ টাকায় বিক্রি, দীনেশ পালের ৮ শতাংশ জমি জাল দলিলের মাধ্যমে ৬৪ লাখ টাকায় বিক্রি করে টাকা হাতিয়েছেন আমজাদ হোসেন। সুয়াপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের সরকারী গাছ মাত্র ১২ লাখ টাকায় কিনে তিনি পরে অন্যত্র তা বিক্রি করে টাকা বাগিয়েছেন। আমজাদ হোসেন ধামরাই পৌর এলাকার বি ৩০/৫ পূর্ব কায়েতপাড়ার মৃত আবুল হোসেনের পুত্র।
এদিকে ধামরাই উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বিএনপি নির্বাহী কমিটির সদস্য তমিজ উদ্দিনের ছোটভাই আশরাফ আলী আমজাদ হোসেনের ঘনিষ্ঠ। তাদের কর্মকান্ড একইসূত্রে গাথা। আশরাফ কায়েতপাড়া শরীফবাগ এলাকার মাধববাড়ি ঘাটে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০০ শতাংশ জমি জবর দখল করে সেখানে রাইস মিল নির্মাণ করেছেন। যেখানে যুগ যুগ ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন দূর্গা প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে আসছিলেন। আশরাফের অত্যাচারে কমপক্ষে ১০টি পরিবার সম্পত্তি হারিয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এরমধ্যে এক তরুণীর পরিবার সম্ভ্রম বাঁচাতে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে আমজাদ হোসেনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসব আপনারা সারাসরি খোঁজ করে দেখুন। এরইমধ্যে র্যাব, পুলিশসহ একাধিক সংস্থা এসবের খোঁজখবর করছে বলেও তিনি জানান।
অন্যদিকে আশরাফ আলীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।