বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জনজীবন * নগরবাসীকে গুনতে হয়েছে তিনগুণ পর্যন্ত ভাড়া * সড়কে একসঙ্গে চলেছে নৌকা ও রিকশা
টানা বৃষ্টিতে শনিবার ঢাকার বেশির ভাগ সড়ক তলিয়ে ছিল পানির নিচে। হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি ডিঙিয়ে চলতে হয়েছে নগরবাসীকে। বৃষ্টি আর জলজটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জনজীবন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর ছেড়ে বেরোনোর সাহস করেননি বেশির ভাগ মানুষ। ছুটি থাকায় শনিবার সরকারি চাকুরেদের পথে নামতে না হলেও বেসরকারি চাকুরে, কর্মজীবী ও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির অন্ত ছিল না। বিরতিহীন বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার সুযোগে রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং ভাড়ায় চালিত পরিবহনগুলো দ্বিগুণ, তিনগুণ ভাড়া আদায় করেছে। পানি নিষ্কাশনে অনেক স্থানেই দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার তৎপরতা ছিল, কিন্তু সেটা আশানুরূপ কাজে আসেনি। পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, হাজারীবাগ, রাজারবাগ, আরামবাগ, মতিঝিল, কারওয়ান বাজার, মালিবাগ, শান্তিনগর, কাকরাইল, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর, কালশী, খিলক্ষেত, জোয়ার সাহারাসহ নগরীর অধিকাংশ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে-সিংহভাগ সড়কই পানিতে ডুবে আছে। প্রগতি সরণি, বেগম রোকেয়া সরণি, বিমানবন্দর সড়ক, পান্থপথ, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউসহ অতিব্যস্ততম সড়কগুলোতে জলজটের সঙ্গে ভুগিয়েছে দীর্ঘ যানজটও। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ধকল এদিন আরও চরমভাবে পোহাতে হয়েছে এমনকি অলিগলিতেও। বেগম রোকেয়া সরণিসহ কয়েক সড়কে একসঙ্গে নৌকা ও যানবাহন চলতেও দেখা গেছে।
অতিবৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে ঢাকার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এদিন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ও পানি ডিঙিয়ে স্কুলে গিয়েই তা জানতে পারে তারা। পরে একই ভোগান্তি নিয়ে ফিরে আসে। শ্রমজীবী ও নিন্ম আয়ের অনেক মানুষকেই দিনটি কাটাতে হয়েছে বসে থেকে। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে সব মিলিয়ে শনিবার ঢাকার জনজীবনে বড় ধরনের ছন্দপতনই ঘটে।
বৈরী আবহাওয়ার কারণে ঢাকা থেকে সারা দেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, আবহাওয়া অধিদফতর অভ্যন্তরীণ নদীতে ২ নম্বর নৌ-হুশিয়ারি সংকেত জারি করায় আগ থেকেই ৬৫ ফুটের কম দৈর্ঘ্যরে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ছিল। আবহাওয়া পরিস্থিতি অবনতির কারণে শনিবার বিকালে ঢাকা নদীবন্দর (সদরঘাট) থেকে ছোট-বড় সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত তা বন্ধ থাকবে।
পানির নিচে খিলগাঁওয়ের সিংহভাগ সড়ক : রামপুরা, খিলগাঁও ও শাহজাহানপুর ঘুরে দেখা গেছে, এ অঞ্চলের সড়ক, অলিগলি, এমনকি ফুটপাতও তলিয়ে গেছে পানিতে। প্রায় প্রতিটি মহল্লার রাস্তা হাঁটু পানির নিচে। মূল সড়কেও অনেক স্থানে একই অবস্থা। তাকালেই চোখে পড়েছে থৈ থৈ ময়লা পানি। অনেক বাসা-বাড়ি ও দোকানেও ঢুকে পড়েছে তা। রিকশা, অটোরিকশা তেমন একটা মিলছে না। মিললেও দাম হাঁকাচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি। বাসও কম। যেগুলো চলছে অধিকাংশই ফিটনেসবিহীন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আধাভেজা সড়কেও অনেক স্থানে একই অবস্থা। তাকালেই চোখে পড়েছে থৈ থৈ ময়লা পানি। অনেক বাসা-বাড়ি ও দোকানেও ঢুকে পড়েছে তা। রিকশা, অটোরিকশা তেমন একটা মিলছে না। মিললেও দাম হাঁকাচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি। বাসও কম। যেগুলো চলছে অধিকাংশই ফিটনেসবিহীন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আধাভেজা হয়ে যারা এসব বাসে উঠছেন, ভাঙা জানালা ও ফুটো ছাদ গলে বৃষ্টির পানি তাদের বাকিটাও ভিজিয়ে দিচ্ছে।
খিলগাঁওয়ের এ, বি ও সি ব্লক, তালতলা, সিপাহীবাগ, মৌলভীরটেক, লোহারগেইট, বৌ-বাজার, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, আবুল হোটেলের সামনের রাস্তা, শাহজাহানপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনের রাস্তা, গুলবাগ, শান্তিবাগ, শহীদবাগ ও মোমিনবাগসহ এই এলাকায় ভেতরের রাস্তাগুলো পানির নিচে। মানুষজনকে পানি ডিঙিয়ে বাইরে বের হতে হচ্ছে। পানির নিচে থাকা অধিকাংশ রাস্তায় খানাখন্দের কারণে যাত্রী নিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ছে রিকশা-অটোরিকশাসহ যানবাহন। হাঁটুসমান ময়লা পানি পাড়ি দিয়েই বেসরকারি চাকরিজীবী ও স্কুল-শিক্ষার্থীদের ছুটতে দেখা গেছে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রুটিন পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে।
সাংবাদিক মঈন উদ্দিন খান থাকেন তালতলার ‘বি’ ব্লকে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘এক কথায় বললে বৃষ্টিতে এ এলাকার মানুষের দুর্ভোগ চরমে। টানা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে আশপাশের সব রাস্তা। বাসা থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। বলতে গেলে সবাই পানিবন্দি। এর পাশাপাশি বিদ্যুতের লুকোচুরি চলছে। গ্যাসে চাপ নেই।’
তেজগাঁও-বনানী সড়ক যেন প্লাবন ভূমি : তেজগাঁও থেকে বনানী পর্যন্ত রাস্তায় যেন প্লাবন। আমতলী থেকে সেনামালঞ্চ পর্যন্ত রাস্তা এমনভাবে পানির নিচে তলিয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে এটা ঢাকা নয়, ভেনিস। দোকানপাট, বাসাবাড়ি পানিতে থৈ থৈ। পানিতে পা না ভিজিয়ে হাঁটার মতো অবস্থা নেই। সাতরাস্তা থেকে মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এমনিতেই এ রাস্তায় খানাখন্দে ভরা। তার ওপর বৃষ্টিতে জমেছে হাঁটুপানি। টানা বর্ষণে শহরে গাড়ির আধিক্য না থাকলেও এ রাস্তায় যানজট লেগে ছিল। বলাকা বাসের ড্রাইভার শরিফুল ইসলাম বলেন, তেজগাঁওয়ের এই রাস্তটুকু এতটাই ভাঙা যে, একটু অসাবধান হলেই যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে সব গাড়িই এখানে ধীরে চালায়। ফলে যানজটের সৃষ্টি হয়। পথচারী শরণ আহমেদ বলেন, এমনিতেই টানা বৃষ্টি হচ্ছে। তার মধ্যে রাস্তার দু’পারে এতটা ময়লা পানি জমেছে যে, হাঁটার মতো অবস্থা নেই। একটু অসাবধান হলেই গাড়ির ছিটিয়ে দেয়া ময়লা পানিতে গোসল হয়ে যায়। বৃষ্টির কারণে পাবলিক বাস খুবই কম। তাছাড়া এ রাস্তায় রিকশা চলতে না দেয়ায় পথচারীদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।
ডুবে থাকা ধানমণ্ডি : অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমণ্ডি এবং সংলগ্ন হাজারীবাগ এলাকার সড়কেও ছিল হাঁটুপানি। পশ্চিম ধানমণ্ডির ১৫ নম্বর সড়ক খুঁড়ে রাখায় সড়কটি এলাকাবাসীর মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। খানাখন্দে পড়ে অনেকেই হতাহত হচ্ছেন। ঝিগাতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পুরনো সুনামি হোটেল পর্যন্ত হাঁটুর ওপর পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। এসব সড়কে রিকশা, সিএনজিগুলো অতি সতর্কভাবে চলাচল করতে দেখা গেছে। হাজারীবাগ পানির ট্যাংকি, ঝিগাতলা কাঁচাবাজার সড়কে ছিল হাঁটুপানি। ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়কের চিত্রও একই।
মধুবাগ বাজার এলাকার এক বাসিন্দা মুজিব মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, সড়কের প্রায় কোমর সমান পানি জমে গেছে। প্রাইভেট কার নিয়ে বের হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করায় রিকশায় চড়ে বাসা থেকে বের হয়েছি। এরপরও আশপাশের গাড়ি চলাচলের কারণে ঢেউয়ে শরীর ভিজে গেছে। হাজারীবাগের আরেক বাসিন্দা মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে হাজারীবাগ, ধানমণ্ডি, ঝিগাতলা এলাকার সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। ময়লা-দুর্গন্ধ এই পানি মাড়িয়ে চলাচলে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।
কাজীপাড়ার সড়কে নৌকা : রাস্তায় খনাখন্দ থাকায় রিকশা ও বাস চলাচল সীমিত। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রোকেয়া সরণিতে নৌকা চলতে দেখা গেছে। এক শিক্ষার্থী বলেন, কলেজের যাওয়ার উদ্দেশে শেওড়াপাড়া থেকে বেলা ১১টার দিকে বাসে উঠেছি, এখন সাড়ে ১১টা বাজে মাত্র কাজীপাড়ায় এসেছি। বেলা ১২টার দিকে আমার ক্লাস আছে, জলাবদ্ধতার কারণে বাসও চলতে পারছে না।
কাজীপাড়ার গৃহবধূ মহসেনা বেগম বলেন, বৃষ্টি হলেই এ এলাকার সড়কে কোমর পানি জমে যায়। ময়লা দুর্গন্ধময় এ পানি মাড়িয়ে আমাদের চলতে হয়। বড়রা কোনো রকম চলতে পারলেও শিশুদের ভোগান্তি অন্তহীন। আর সড়কগুলোর বেহাল অবস্থার কারণে ভোগান্তি চরমে।
রায়েরবাজারের সড়ক পানির নিচে : এলাকার সড়কে জলাবদ্ধতা। অলিগলিসহ পুরো সড়ক পানির নিচে। বউবাজারের অধিকাংশ দোকানে পানি প্রবেশ করে বিপুল পরিমাণ মালামালের ক্ষতি হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের বৃষ্টির মধ্যে হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমরপানি মাড়িয়ে স্কুল-কলেজে যেতে দেখা গেছে। অফিসগামী ও খেটে খাওয়া মানুষদের একই অবস্থা ছিল। একদিকে সড়কে পানি অন্যদিকে যানবাহনের অভাব। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কোনো যানবাহন না পেয়ে হাঁটুপানি মাড়িয়ে গন্তব্যে যেতে হয়েছে অনেককে। সকাল দশটায় ট্যানারি মোড় এলাকায় রাস্থার দু’পাশে যানবাহনের জন্য অনেক মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
কাকরাইল-মালিবাগ সড়কে অন্তহীন দুর্ভোগ : কাকরাইল থেকে মৌচাক-মালিবাগ এলাকার সড়কগুলো রীতিমতো খালে পরিণত হয়েছে। ভাঙাচোরা এ সড়কে কোমরসমান পানি মাড়িয়ে চলাচলে নাকাল হচ্ছেন নগরবাসী। রিকশা, সিএনজি এমনকি মাইক্রোবাসও উল্টে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। পানি নিষ্কাশনের জন্য ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা রাখা হলেও তাতে তেমন সুফল মেলেনি। উল্টো যান চলাচলে বাধার সৃষ্টি করছে। রাস্তার পানি উপচে আশপাশের দোকানেও ঢুকে পড়েছে। এসব সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি খুব বেশি চলাচল করেনি। অলিগলি থেকে মূল সড়কে আসতে রিকশার ওপর ভরসা করতে হয় সাধারণ মানুষকে। তাদের বেশি ভাড়া গুনতে হয়েছে। শান্তিনগর কাঁচাবাজারে বাজার করতে আসা মালিবাগের বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছরই বর্ষায় জলাবদ্ধতা হলে সিটি কর্পোরেশনের টনক নড়ে। ড্রেন পরিষ্কারে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। এরপর আর খোঁজ থাকে না। ফলে বছরের অন্য সময় অল্প বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে। নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার রাখলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো না।
নাখালপাড়ার সড়কগুলো যেন একেকটি খাল : পশ্চিম নাখালপাড়া ও তেজকুনি পাড়ার বেশির ভাগ অলিগলিতে হাঁটু থেকে কোমর পানি জমেছিল। বিশেষ করে তেজকুনি পাড়ার অবস্থা ছিল শোচনীয়। বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত এসব সড়ক ছিল যেন খাল। ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরা এসব সড়কে চলাচলে নাকাল হতে হয়েছে।
পশ্চিম নাখালপাড়ার ৬ নম্বর গলির বাসিন্দা আবদুল ওয়াহেদ বলেন, একটু বৃষ্টি হলেই এ সড়কের মধ্যাংশে পানি জমে। সড়কটি দীর্ঘদিন ধরে ভাঙাচোরাও। বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গর্ত হয়ে আছে। রয়েছে অপরিকল্পিত স্পিড বেকার। এ কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
জোয়ার সাহারায় জলজট, যানজটে ভোগান্তি : কুড়িল-প্রগতি সরণি সড়কের জোয়ারা সাহারা এলাকায় তীব্র জলজটের সৃষ্টি হয়। এর ফলে এ সড়কের পিচ ঢালাই, ইট, খোয়া উঠে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। হাঁটুসমান পানি মাড়িয়ে পরিবহন চলতে হয়েছে। শনিবার এ সড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্ব পাড়ি দিতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা লেগেছে।
যমুনা ফিউচার পার্কের ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন বলেন, নতুন বাজার থেকে মাইক্রোবাসে কুড়িল চৌরাস্তা পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টা লেগেছে। অথচ অন্যান্য দিন তিন থেকে পাঁচ মিনিট লাগে। বৃষ্টি হলেই এ সড়কে পানি জমায় চলাচলে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।
শনিবার সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত কুড়িল প্রগতি সরণি সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, এ সড়কের জোয়ার সাহারা এলাকা হাঁটু পানির নিচে। আশপাশের অলিগলিগুলোতে পানির পরিমাণ আরও বেশি। প্রধান সড়কে খানাখন্দ থাকায় সড়কের ওই অংশে ধীরগতিতে পরিবহন চলাচল করেছে। এ সড়কে চলাচলে দীর্ঘসময় লাগায় রিকশা, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল আরোহীদের উল্টোপথে চলাচল করতে দেখা গেছে। এক ভুক্তভোগী বলেন, সামান্য বৃষ্টিতে জোয়ার সাহারা এলাকার প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। এ সময় সড়কে পরিবহনগুলো বাধ্য হয়ে খুব ধীরগতিতে চলে। ফলে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
মিরপুরে জনদুর্ভোগ চরমে : কোথাও কোথাও পানি জমার কারণে ঘর থেকে বের হওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। আবার কোথাও পানি না জমলেও রাস্তা সংস্কারের কারণে কাদা জমে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। মিরপুর ৬০ ফিট রাস্তার কাছে চতুর্দিকে পানি জমে থাকতে দেখা যায়। সকালে হাঁটু পানি জমায় বাজার করতে মিরপুরে-১ নম্বরে যেতে পারেননি অনেক মানুষ।
পশ্চিম শেওড়াপাড়ার শামীম সরণি, শাপলা সরণি পর্যন্ত এবং মাসুদ কোম্পানি থেকে পানির পাম্প এবং আশপাশের রাস্তার সংস্কারকাজ শেষ না হওয়ায় কাদায় ভরা ছিল সড়ক। অনেককে জুতা ও স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে।
এখানকার বাসিন্দা ডা. আবু তাহের মিয়া বলেন, আমার বাসার সামনের রাস্তায় সংস্কারকাজ চলছে অনেক দিন ধরেই। বৃষ্টির পানি জমে চলাচল করাই দায় হয়ে পড়েছে। শাপলা সরণির বাসিন্দা জোবেদা বেগম বলেন, আমার বাসার সামনে সংস্কারকাজ শেষ না হওয়ায় পানি ও কাদায় একাকার হয়ে গেছে। বাসা থেকে গাড়ি বের করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
মিরপুর-১ উন্নয়ন কাজে বেড়েছে জলাবদ্ধতা : মিরপুর-১, দক্ষিণ পাইকপাড়া, আনসার ক্যাম্প এলাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে ড্রেনেজ লাইনের সংস্কারকাজ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। এলাকাবাসী ভেবেছিলেন, এবারের বর্ষায় তাদের জলাবদ্ধতার ভোগান্তি পোহাতে হবে না। কিন্তু ঘটেছে উল্টো। অন্যান্য বারের চেয়ে এবার মিরপুর-১, দক্ষিণ পাইকপাড়া এলাকায় জলাবদ্ধতা বেশি। এলাকাবাসীর প্রশ্ন, তাহলে এত টাকা খরচের প্রয়োজন কী ছিল? এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মিরপুর-১, দক্ষিণ পাইকপাড়া, আনসার ক্যাম্প এলাকার সড়কে কোমর পানি। এই পানি ভেঙে ওই সড়কে চলাচল করছে রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা, মাইক্রোবাস। সড়কে পরিবহন ও রিকশা কম। এ কারণে স্কুল শিক্ষার্থীদের কোমর পানি মাড়িয়ে বাসার ফিরতে দেখা গেছে। নারী ও শিশুদেরও একই ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
দক্ষিণ পাইকপাড়ার আনোয়ার হোসেন বলেন, বৃষ্টি হলেই মিরপুর-১ নম্বর প্রধান সড়ক, দক্ষিণ পাইকপাড়াসহ আশপাশের এলাকায় পানি জমে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় এই পানি জমে থাকে। ফলে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।
বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত ডেমরার জনজীবন : ডেমরাসহ আশপাশের এলাকা কাদা পানিতে একাকার। সারুলিয়া, টেংরা, আমতলা, উত্তর-দক্ষিণ ডগাইর, পূর্ব-পশ্চিম ডগাইর, বামৈল, বড়ভাঙ্গা, কোদালদোওয়া, শূন্যা, সানারপাড়, কোনাপাড়া, মাতুয়াইলের কিছু এলাকা পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে বহু বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি, নার্সারি ও সবজি ক্ষেত। বৃষ্টির পানির সঙ্গে কলকারখানা ও বাড়িঘরের বর্জ্য পানি মিশছে।
উত্তরার সড়কও পানির নিচে : উত্তরা পশ্চিম থানা হয়ে খানটেক, পাকুরিয়া, যাত্রাবাড়ী আহালিয়া সড়ক এবং এলাকা পানিতে ডুবে ছিল শনিবার। বাউনিয়া বাঁধ, বাদালদি, মানিকদি, মাটিকাটা এলাকার বহু ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। উত্তরা পূর্ব হয়ে আদম আলী মার্কেট, ক্লাব রোড, কবরস্থান রোড, মজিবর মার্কেট এলাকার অনেক সড়কও ডুবে গেছে। দক্ষিণখানের জয়নাল মার্কেট, দেওয়ানবাড়ি, কাঁচাবাজার, ফরিদ মার্কেট, সুপার মার্কেট, মুক্তিযোদ্ধা রোড, কসাইবাড়ি, আশকোনা এবং কাওলার শিয়াল ডাঙা ও নামাপাড়া এলাকাও পানিতে তলিয়ে ছিল। খিলক্ষেতের নামাপাড়া, বউরাসহ তলিয়ে যায় ৭-৮টি এলাকা। দক্ষিণখানের বাসিন্দা খাদিজা ইসলাম বলেন, দু’দিন ধরে বাসা থেকে বের হতে পারছি না।
তিন দিন পানির নিচে চানখারপুর : চানখাঁরপুল থেকে নাজিমউদ্দিন রোড এবং এর আশপাশ এলাকা তিন দিন ধরে পানির নিচে। নাজিমউদ্দিন রোডের শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের সামনে থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে হোটেল নীরব পর্যন্ত জলাবদ্ধ। এ পথে যাওয়ার ডানে-বামে আছে চানখাঁরপুল প্রাইমারি স্কুল গলি, নবাববাগিচা, জমিদার গলি, চানখাঁরপুল লেন, শুকুর মিয়ার গলি, নবাববাগিচামুখী বড় শাহী মসজিদ গলি, তাঁতখানা লেন বা কবিরাজ মসজিদের গলি। একই দশা বকশিবাজার এলাকার। প্রত্যেক গলিতে কোথাও হাঁটু, আবার কোথাও কোমরসমান পানি। অনেক বাসাবাড়ি-দোকানপাটে ঢুকে গেছে পানি। এ কারণে কেউ কেউ দু’দিন ধরে পানির মধ্যে বসবাস করছেন। নীরব হোটেলের উত্তর দিকের কানাগলির ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী জানান, এবারের বৃষ্টিতে অনেকবারই এলাকা ডুবেছে। কিন্তু কখনও আমার দোকানের গুদামে পানি ঢোকেনি। গত দিনের বৃষ্টিতে গুদামে পানি ঢুকে মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের শিক্ষক বদরুল ইসলাম বলেন, কলেজের সামনে পানি জমে গেছে। শনিবার ক্লাসে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। বিকালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা থাকায় অবশ্য অনেকে এসেছে। তবে ২০ গজ পানি পার হতে ২০-৩০ টাকা গুনতে হয়েছে। গৃহবধূ শাহনুর বেগম বলেন, গলির ভেতরে বাসাবাড়িতে যেতে ৫০-১০০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টির কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সড়ক ও অলিগলি পানিতে তলিয়ে গেছে। অনবরত বৃষ্টি হওয়ায় পানি নিষ্কাশন হলেও সড়কের পানি সরছে না। বাধাহীনভাবে পানি নিষ্কাশন করতে ডিএসসিসির প্রকৌশলী, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাঠে রয়েছেন। বৃষ্টি কমলে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে পানি সরে যাবে বলে আশা করছি।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্যানেল মেয়র ওসমান গণি বলেন, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে ঢাকার বেশির ভাগ সড়ক তলিয়ে গেছে। এতে নগরবাসীর চরম ভোগান্তি হচ্ছে। সরকারি ছুটি থাকার পরও ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাঠে নেমে পানি নিষ্কাশন কাজে সহযোগিতা করার নির্দেশনা দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, শনিবার সকালে বাসা থেকে বের হয়ে নতুন বাজার, গুলশান, বনানী ও মহাখালী এলাকা ঘুরে মানুষের চরম ভোগান্তির দৃশ্য লক্ষ করা গেছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল হাসান বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে পানি জমে গেছে। জমে থাকা পানি নিষ্কাশন করতে ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করছে। বৃষ্টির পরিমাণ কমলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পানি সরে যাবে। বাধাহীন পানি নিষ্কাশন করতে ড্রেন লাইনগুলো ক্লিয়ার রাখা হচ্ছে। এ ছাড়াও ঢাকা ওয়াসার সেচ পাম্পগুলো পানি নিষ্কাশনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।