বিশেষ প্রতিনিধিঃ
ভেল্কিবাজিকেও হার মানিয়েছেন বহুরূপী রাশেদুল হক। তার গোমর ফাঁস হওয়ায় সাংবাদিক মহলে চলছে তোলপাড়। আওয়ামীলীগার পরিচয়ে মাদ্রাসার পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে সরকারী সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন। বিএনপিপন্থী সাংবাদিকরাও রাশেদুলের কারিশমা নিয়ে বিস্মিত। ক্ষমতাসীনদের বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত দৈনিক দিনকাল এর বার্তা সম্পাদক পদে থেকেও পাচ্ছেন পূর্ণ বেতন-ভাতা। আওয়ামীলীগ বিরোধী হিসেবে তিনি পরিচিত বিএনপি- জামায়াত নেতা-কর্মীদের কাছে। দাপটের সঙ্গে কিভাবে উভয় কূল ম্যানেজ করে চলছেন, তা নিয়ে ধান্ধায় আছেন তার সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠরা।
সাপ্তাহিক অপরাধ চিত্র পত্রিকায় গত ১৪ আগস্ট ২০১৭ “একই অঙ্গে কত রূপ” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকরা এ ঘটনাকে চাঞ্চল্যকর ও উদ্বেজনক উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন, রাশেদুল হক ব্যক্তিগতভাবেও বিএনপির সুবিধাভোগী। সাংবাদিকদের সংগঠনেও তার পরিচিতি বিএনপিপন্থী হিসেবে। রাজনৈতিক কানেকশনেই তিনি দলীয় মুখপত্র ‘দৈনিক দিনকাল’ বার্তা সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। তিনি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করেই কিভাবে একটি মাদ্রাসার পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে সরকারী সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তারা এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়ে বলেছেন,এতে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো সরকারের ভেতর থাকা আরো অনেক বিভীষণের সন্ধান মিলতে পারে।
অন্যদিকে তিনি নিজেকে বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর পিএস পরিচয় দেন সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক মহলে। রাশেদুল একজন এপিএস নিয়োগ করেছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাকে শিগগিরই ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি নিযুক্ত করবেন বলেও ঘনিষ্ঠদের কাছে প্রচারণা চালাচ্ছেন। বর্তমান সরকারের আমলেও একজন ঘোর বিএনপি সমর্থক কিভাবে আওয়ামী লীগার সেজে একের পর এক সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছেন, তার হিসেব মিলাতে পারছেন না তারা।
নব্য আওয়ামী লীগার রাশেদুলের বিরুদ্ধে আরো চমকপ্রদ তথ্য মিলেছে। বিএনপিমহলে নিজেকে ত্যাগী জাতীয়তাবাদী হিসেবে প্রচারকারী এই সাংবাদিক ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন। সে নির্বাচন বর্জন করেছে দলটি।‘মসজিদুল আকবার ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক’ হিসেবে মিরপুরের মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয় বালিকা শাখা কেন্দ্রে তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নিজেকে তখন সাচ্ছা আওয়ামীলীগার হিসেবে জাহির করতে নানা নাটকীয়তায় অবতীর্ন হন। আওয়ামীলীগ নেতাদের খুশি করে মাদ্রাসার চাকরী জায়েজ করতে তিনি পারঙ্গমতার পরিচয় দেন।তার অতি বিএনপি বিরোধী নাটকীয়তার সহকর্মীরাও লজ্জ্বা পাচ্ছিলেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর মিরপুর ১ নং সেকশন এলাকায় রাশেদুল হকের পরিচয় একজন মাদ্রাসা শিক্ষক হিসেবে। রাজধানীর শাহআলী থানাধীন মসজিদুল আকবার ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত আছেন তিনি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ওই মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক (কৃষি) হিসেবে চাকুরি লাভ করেন। সরকারী সুবিধাসহ বেতনভাতা নিচ্ছেন। তার এমপিও ইনডেক্স নম্বর ৬৪৪২৬৬। রাজনৈতিক প্রভাবে দ্রুত এমপিওভুক্ত ছাড়াও ক্ষমতার বিস্তার ঘটান। মাদ্রাসায় দিনের পর দিন অনুপস্থিত থেকেও মাস শেষে নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন। কাজে ফাঁকির বিরুদ্ধে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দূরের কথা, কেউ কোনো কথা বলারও সাহস পাচ্ছেননা। কারণ একদিকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর, অন্যদিকে জাঁদরেল (!) সাংবাদিক। সাংবাদিকতার সুবাদে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা বোর্ড কিংবা মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তার সঙ্গেই রয়েছে তার বিশেষ সম্পর্ক। তাছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার বাড়ি কাপাসিয়ায় হওয়ায় তার পোয়াবারো। এ সম্পর্ক এবং নিজের পরিচিতিকে পুঁজি করেই মাদ্রাসার অন্যান্য শিক্ষক এবং পরিচালনা পর্ষদের কর্মকর্তাদের দাবড়িয়ে বেড়ান।
চারদলীয় জোট সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারালেও রাশেদুলের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। বরং বোল পাল্টে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং আওয়ামী পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন। দিনকাল বার্তা সম্পাদক সাচ্ছা আওয়ামী লীগার সেজে অবৈধ সুবিধা পেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের চেষ্ঠা করেছেন। তার একই অঙ্গে বহুরূপের গোমর ফাঁসে ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকরা বিস্মিত। হতবাগ আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি’র কর্মীরাও।
ঘনিষ্ঠরা জানান, রাজনৈতিকভাবে কাপাসিয়া এবং সাংবাদিক ইউনিয়নে রাশেদুলের পরিচিতি বিএনপিমনা। তিনি এক সময় নিজেকে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা প্রয়াত ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাহ আবদুল হান্নানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে জাহির করতেন। হালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে প্রচার করেন। তাছাড়া দীর্ঘকাল ধরে বিএনপির মুখপত্র দৈনিক দিনকালে সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকায় বিএনপি নেতাদের সাথে তার দহরম-মহরম সম্পর্ক। এরপরও তিনি নিজেকে কিভাবে আওয়ামী পরিবারের সদস্য দাবি করছেন, তা নিয়ে বিস্মিত সকলে।
এদিকে আড়াই বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো রাশেদুলের একটি আবেদনকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে কৌতুহলও। ওই আবেদনে রাশেদুল দাবি করেছেন যে, তার পিতা মৃত আব্দুল সালেক মুন্সী একজন বী মুক্তিযোদ্ধা। স্ত্রী হেলেনা বেগম মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং মাতা শিরিয়া বেগম শিবপুর থানা মহিলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক। পক্ষান্তরে মসজিদুল আকবার ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে জামায়াত কানেকশনের অভিযোগ তোলা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, নিজের অপকর্ম ঢাকতেই দিনকাল বার্তা সম্পাদক রাশেদুল হক খোলস পাল্টাবার কৌশল নিয়েছেন। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে নিজেকে সাচ্ছা আওয়ামী লীগার পরিচয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের চেষ্ঠার গোমর ফাঁসে তার ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকরাও বিস্মিত।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, রাশেদুল কর্মক্ষেত্রে মূর্তিমান আতংক হিসেবে পরিচিত। সাংবাদিকতার মহান পেশাকে ব্যক্তিস্বার্থে অপব্যবহারের ব্যাপারে কেউ কথা বল্লেই তিনি তার আক্রশের শিকার হন। রাশেদুল ঢালাও প্রচারণা চালাচ্ছেন এই বলে যে, রাশেদুল হক আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী মহলের লোক। দিনকাল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রয়োজনেই বার্তা সম্পাদকের পদে বসিয়ে ধন্য হয়েছে। দিনকাল থেকে রাশেদুল হক চাকরী ছেড়ে দিতে চাইলেও সম্পাদক ড. রেজোয়ান সিদ্দীকি এবং বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বিশেষ অনুরোধে তিনি সেবা দিচ্ছেন। রাশেদুল সাংবাদিক এবং কর্মচারিদের বাগে রাখতেই সম্পাদকের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতার কথা জানান দেন। এমনকি তিনি চাকরী থেকে বরখাস্ত করারও ভয় দেখান কোন কোন সহকর্মীকে। ইতোমধ্যে কয়েকজনের নামে সম্পাদক কারণদর্শাও নোটিশ দেয়ায় রাশেদুলের অসামান্য দৌরাত্মের প্রমান মিলেছে।
অন্যদিকে মাদ্রাসার চাকরী রক্ষায় ছুটছেন আওয়ামীলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছে। মাদ্রাসায় দায়িত্ব পালন না করেও বেতন-ভাতা গ্রহণের বৈধতার প্রশ্ন উঠলে ব্যক্তি স্বার্থে রাশেদুল আওয়ামীলীগের নেতাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সংবাদ দিনকাল পত্রিকায় গুরুত্বেও সঙ্গে প্রকাশের নিশ্চয়তা দেন বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে থাকার সুবাদে। তাছাড়া নিজেকে ত্যাগী আওয়ামীলীগার প্রমানের অপকৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ইতোপূর্বে দাখিলকৃত আবেদন পত্রের কপি তিনি মাদ্রাসা পরিচালনা সংশ্লিষ্ট এবং আওয়ামীলীগের মীরপুর অঞ্চলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করছেন বলে জানা গেছে। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য রাশেদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করে গ্রহণযোগ্য বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অভিযোগের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলেছেন, সাংবাদিতকতা পেশায় সার্বক্ষনিক নিয়োজিত থেকে মাদ্রাসা শিক্ষক হিসেবে বেতন-ভাতা গ্রহণ সম্পূর্ণ বেআইনী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তারা অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।