বৈরাম খা : বাংলাদেশের পারমানবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। বর্তমানে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দ্রুতগতিতে পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে।
দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প’ নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা থাকলেও, সফলভাবে শেষ হয়েছে প্রথম ধাপের কাজ। চলতি মাসের যেকোনো দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল অংশের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করবেন বলে নিশ্চিত করেছে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকে ঘিরে পাবনা জেলার রূপপুর পদ্মার পাড়ে চলছে রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশনের নেতৃত্বে কর্মযজ্ঞ। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সার্বিক কার্যক্রম সরাসরি তদারকি করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হয়েছে ৫০৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় বা শেষ পর্যায়ের কাজও। এরই অংশ হিসেবে নভেম্বরে উদ্বোধন হতে পারে বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল স্থাপনার ‘রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং (উৎপাদন কেন্দ্র)’ নির্মাণ কাজ। এ লক্ষ্যে পুরোদমে চলছে স্থাপনাটির ফাউন্ডেশনের (‘ফার্স্ট কংক্রিট পোরিং ডেট বা এফসিডি) সার্বিক কার্যক্রম।
দুই পর্যায় মিলে ১ লাখ ১৮ হাজার ১৮০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের কাজ ২০১৩ সালে শুরু হয়েছে। প্রকল্প সমাপ্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশিষ্টরা।
এই বিষয়ে প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ইউরিক মিখাউল খোসলেভ জানান, ২০১৭ সাল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখন রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং তৈরির প্রস্তুতি হিসেবে সাব বেইজ তৈরি করা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে মূল প্রকল্পের ভিত্তি। অবকাঠামো ছাড়াও অনেক কাজ চলছে। যেমন রড, ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি। সব কাজই হচ্ছে পরিকল্পিতভাবেই। মূল স্থাপনার কাজ শুরু হলে তার পরের ৬৮ মাসের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘‘প্রতিদিন রাশিয়ার বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশি কর্মী মিলে এক হাজারের বেশি লোক দিন-রাত কাজ করছেন। এ প্রকল্পের জন্য থ্রি প্লাস রিঅ্যাক্টর বসবে। যেটি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও আধুনিক প্রযুক্তির। যা শুধু রাশিয়ার একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রয়েছে। আর বাংলাদেশের রূপপুরেই হবে দ্বিতীয় ব্যবহার। এখানে মালিক (সরকার), সাব-কন্ট্রাক্টর ও আমরা সবাই এক কমান্ডেই কাজ করছি। কোনো সমস্যা নেই। নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা নেই। ২০২০ সালের মধ্যে রিঅ্যাক্টর ভেসেলসহ সব যন্ত্রপাতিই রাশিয়া থেকে চলে আসবে। তারপর এখানে অ্যাসেম্বলিং করা হবে।’’
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে মূল স্থাপনার জন্য সয়েল স্টাবলিস্টমেন্টের কাজ পুরোদমে চলছে। বাংলাদেশের মাটি তুলনামূলক নরম হওয়ায় যন্ত্রের সাহায্যে মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত সিমেন্ট মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে ১৭ হাজার ৪৫০ কিউবিক মিটার কংক্রিটিংয়ের কাজ চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। প্রথম পর্যায়ে চার হাজার কিউবিক মিটারের কাজ শেষ হয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারির মধ্যে পুরোটা শেষ হবে। মূল স্থাপনার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হবে ৭০ মিটার করে, আর ফাউন্ডেশনের থিকনেস হবে তিন মিটার। আনুষঙ্গিক অনেক কাজই দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চলছে প্রটেকশন ড্যাম (বাঁধ) তৈরির কাজ। ২ দশমিক ৮ কিলোমিটার লম্বা এবং ১৩ মিটার প্রস্ত এই বাঁধের কাজও এগিয়েছে অনেকদূর। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথম পর্যায়ে ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা ছিল। কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত না হওয়ায় ইতিমধ্যে ৮০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আরও ২১৯ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। নতুনভাবে অধিগ্রহণ করা পদ্মার বিশাল চরে চলছে মাটি ভরাটের কাজ।
মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে গ্রিনসিটি আবাসন পল্লী নির্মাণের কাজ অনেকটাই শেষ পর্যায়ে। পাবনা গণপূর্ত অধিদপ্তর এগুলো বাস্তবায়ন করছে। ইতিমধ্যে তিনটি সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। এই এলাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০ তলার ১১টি বিল্ডিং এবং ১৬ তলার ৮টি বিল্ডিংয়ের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ২২টি সুউচ্চ বিল্ডিং তৈরি হবে এ চত্বরে। থাকবে মাল্টিপারপাস হল, মসজিদ ও স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের ওয়েব সাইট থেকে জানা যায়, দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ব্যয়ের প্রকল্প হচ্ছে এই রূপপুর পরমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। মোট ব্যয়ের মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে রাশিয়া দিচ্ছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
আসলেই কি সম্পূর্ণ নিরাপদ এই বিদ্যুৎ প্রকল্প?- এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রকল্প পরিচালক শওকত আকবর বলেন, রূপপুর প্রকল্পে রিঅ্যাক্টর ঘিরে রয়েছে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয়। এর পাশাপাশি রাশিয়ান ফেডারেশনের নির্মিত প্রযুক্তির অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ সেফটি সিস্টেমের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় কোনো ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এরপরও যদি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেও, এর তেজস্ক্রীয়তা জনগণের নাগালের মধ্যে যাবে না। কাজেই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্তই বলা যায়।
নির্মাণ কাজ পরিদর্শনে এসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ড. ইয়াফেস ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে ১৯৬০ সালে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য ১৯৬০, ১৯৭৭-৭৮ এবং ১৯৮৮-৮৯ সালে কারিগরি ও অর্থনৈতিক ও আর্থিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে এটি নির্মাণ সম্ভব হয়নি। সরকারের বিদ্যুৎ খাতের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহের ১০ শতাংশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ থেকে পাওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। বর্তমানে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। আমরা আশা করি চলতি মাসের শেষের দিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পের মূল কাজ উদ্বোধন করবেন।’’
ড. ইয়াফেস আরো জানান, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং গাইডলাইন অনুযায়ী পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে। গত জুলাই মাসে এই প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেন সংস্থাটির মহাপরিচালক ইউকিয়া আমানো।