বাসক পাতা অনেকের কাছে ফেলনা মনে হলেও ভেষজ চিকিতসায় এ গাছের পাতার জুড়ি নেই। বাড়ির আশপাশের পতিত জমিতে কিংবা কেউ কেউ জমির ফসলের নিরাপত্তার জন্য আইল (বেড়া) দেয়ার জন্য এটি লাগিয়ে থাকেন। বহুকাল থেকে ঠাণ্ডা কাশির ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসলেও আমাদের দেশে বাসকের বাণিজ্যিকভাবে চাষ নেই বললেই চলে। সম্প্রতি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ ও কোটচাঁদপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বাসক পাতার চাষ হতে দেখা যাচ্ছে।
কালীগঞ্জে প্রায় ২৫ হেক্টর ও কোটচাঁদপুর উপজেলায় প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে এই পাতার চাষ হচ্ছে। প্রথম দিকে গবাদি পশুর হাত থেকে জমি রক্ষার জন্য বেড়া এবং বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে হলেও এখন ধারণা পাল্টেছে। দেশের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা এসে কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি মণ কাঁচা পাতা ৩০০ টাকা এবং প্রতি মণ শুকনা পাতা ১০০০-১৩০০ টাকা দরে ক্রয় করছে। আর এ কারণে বাড়ির আশপাশের পতিত জমিতে এটি চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন স্থানীয়রা। বাসক একটি ভারত উপমহাদেশীয় ভেষজ উদ্ভিদ। বৈজ্ঞানিক নাম আধাটোডা ভাসিকা (Adhatoda Vasica)। লোকালয়ের কাছেই আর্দ্র ও সমতলভূমিতে এটি বেশি জন্মে। বাসক অর্থ সুগন্ধকারক। বাসকের আরেক নাম বসায় বা বাকসা। সবুজ ও হালকা হলুদ রঙের ডালপালাযুক্ত ১ থেকে ২ মিটার উঁচু গাছ, ঋতুভেদে সর্বদাই প্রায় সবুজ থাকে। বল্লমকারের পাতা বেশ বড়। গাছ লম্বায় ১-১৫ মিটার (৩-৫ ফুট) পর্যন্ত হয়। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মোস্তবাপুর গ্রামের আশাদুল ইসলাম, অজিত কুমার সাহা, ইউনুছ আলী, শহিদুল ইসলাম, মকছেদ খাঁসহ প্রায় ২০ জনের মতো কৃষক তাদের বাড়ি ও ফসলি জমির পাশে গত ৬-৭ বছর ধরে বাসক পাতা গাছের চাষ করছেন। এই গ্রামের আশাদুল ইসলাম গত সাত বছর আগে প্রথম তার বাড়ির ২০ শতক জমির চারপাশে বাসক পাতার গাছ লাগান। উদ্দেশ্য ছিল বেড়া দিয়ে জমি রক্ষা, অন্যদিকে সৌন্দর্য বৃদ্ধি। দু’বছর পর কুষ্টিয়া থেকে আসা কিছু লোক নামমূল্য টাকায় বাসকের সবুজ পাতা কিনে নিয়ে যান। এরপর থেকে নিয়মিত তারা এসে টাকার বিনিময়ে বাসকের পাতা সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে থাকেন। আশাদুলের দেখাদেখি গ্রামের অনেকেই বাসকের গাছের চাষ শুরু করেন। এই বাসক গাছ একদিকে গবাদি পশুর হাত থেকে জমির ফসল রক্ষায় বেড়া হিসেবে কাজ করে অন্যদিকে এর পাতা বিক্রি করা হয়। দেশের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা এসে কৃষকদের কাছ থেকে এই পাতা সংগ্রহ করে নিয়ে যান। এই গ্রামের কৃষকরা বছরে ৩ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত এই বাসক পাতা বিক্রি করেন। এ ছাড়া সারা বছরই স্থানীয় অধিবাসীরা ঠাণ্ডা কাশির ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। কৃষি অফিস সূত্র জানিয়েছে, কালীগঞ্জ উপজেলার ষাটবাড়িয়া গ্রামের লিটন, রাড়িপাড়ার ইসলাম, অনপমপুর গ্রামের আবুল হোসেন, ফরাসপুর, রায়গ্রাম ঘোষপাড়ার সুনিল ঘোষ, রবিন ঘোষ, দুলালমুন্দয়ায় মজনুর রহমান, মফিজুর রহমান, মান্নান হোসেন ও রহিমা, একই গ্রামের দাসপাড়ার বাসুদেব কুমার ও গীতা রানী, পাখা পাড়ার জাকির হোসেন, খামারমুন্দিয়া গ্রামের আরিফুল ইসলাম, আগমুন্দিয়া গ্রামের রশিদুল ইসলাম, মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের মজিদ, ভাটাডাঙ্গা গ্রামের কার্তিক পাল, ১নং সুন্দরপুর দুর্গাপুর ইউনিয়নের আলাইপুর, শ্রীরামপুর, সিনদহী, কমলাপুর, মধুপুর, কালুখালী গ্রামের কয়েকশ’ কৃষক বাণিজ্যকভাবে এই চাষ শুরু করেছেন। এ ছাড়াও কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নের শিশারকুণ্ডু, আসাননগর, কুল্লাগাছা, গুড়পাড়া, ফাজিলপুর, বলরামপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের আরো শতাধিক কৃষক বাসক পাতার বাণিজ্যিক বাজার মূল্য এবং চাহিদার কারণে চাষ শুরু করেছেন।
বাসক পাতার পাইকারী ক্রেতা কুষ্টিয়ার শরিফুল ইসলাম জানান, তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ ও কোটচাঁদপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে কাচা ও শুকনা বাসক পাতা ক্রয় করে থাকেন। বছরে তিনি ৩-৪ বার এই পাতা ক্রয় করেন। এক মণ কাঁচা পাতা ৩শ’ টাকা আর এক মণ শুকনা বাসক পাতা ১ হাজার থেকে ১৩০০ টাকা পর্যন্ত দরে ক্রয় করে থাকেন। এই পাতা কৃষক পর্যায় থেকে ক্রয় করে তিনি বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেন। কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, কালীগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ২৫ হেক্টর জমিতে বাসক পাতা চাষ হয়। বাসক মূলত বাড়ির আশপাশের জমিতে লাগানো হলেও কেউ কেউ এটি বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করেছেন। তিনি বলেন, বাসকের কাঁচা ও শুকনো পাতা ঔষধি হিসেবে কাজে লাগে। বাসকের পাতায় ভাসিসিন নামের ক্ষারীয় পদার্থ ও তেল থাকে। শ্বাসনালীর লালাগ্রন্থিকে সক্রিয় করে বলে বাসক শ্লোষ্মনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি বলেন, বাসক পাতার রস ব্যবহার করা হয়। এতে সর্দি, কাশি ও শ্বাসনালীর প্রদাহমুলক ব্যধিতে বিশেষ উপকারী। যেহেতু বর্তমানে বাসক পাতার বাণিজ্যিক মূল্য রয়েছে সে ক্ষেত্রে উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুব্ধ করা হচ্ছে বাড়ির আশপাশের পতিত জমিতে এই্ পাতা চাষ করার জন্য। কৃষি অফিসার বলেন, এ অঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটি বাসক গাছ চাষের জন্য উপযোগী। ফলে রাস্তা ও বাড়ির পাশের পড়ে থাকা অবহৃত জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট এক পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে।