মোহাম্মদ মোশাররাফ হোছাইন খানঃ : বিশ্বব্যাপী অভিনব ব্যাংক কেলেঙ্কারির ইতিহাসে বাংলাদেশের কামেল পীরের মোখলেস লুটেরা এস. আলমের এস. আলম গ্রূপের ব্যাংক লুটপাট সর্বাধিক নিখুঁত ও অভিনব কৌশলে সংঘটিত হয়েছে । এ যাবৎ কালে এশিয়া মহাদেশে এতবড় সংঘবদ্ধ অফিসিয়াল সিন্ডিকেট ব্যবহার করে এত বড় লুটপাট ঘটনা এই প্রথম বলে মনে করছেন ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ ।
কেউ কেউ আবার বলেছেন, আর্থিক খাতে এ ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটণা বিশ্বে এটিই প্রথম। এস. আলম তার দখলদারিত্বে থাকা ৭ ব্যাংকের বাহিরেও সোনালী, জনতা, ন্যাশনাল ব্যাংক ও অন্যান্য আরো ব্যাংক লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে একই কায়দায়। প্রতিনিয়ত এ লুটপাট একটি ওপেন সিক্রেট বিষয় হলেও তা ছিলো অপ্রতিরোধ্য । ২০১৭ সালের পর থেকে ব্যাংকিং খাতে এস. আলমের একক আধিপত্য ছিলো স্বয়ং দিন দুপুরে পালানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পালিয়ে পদত্যাগ করা ডি-গ্রেডের গভর্নর আঃ রউফ তালুকদারের তত্ত্বাবধানে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের নজরদারিতে, তার দখলদারিত্বে থাকা ব্যাংকগুলোয় পদস্থ পদগুলোতে তার বসানো দালালদের মাধ্যমে জনসাধারণের গচ্ছিত আমানতের হাজার হাজার কোটি টাকা নিরাপদে বের করে নিতে স্বক্ষম হয়েছে।
নেত্র নিউজের সূত্র মতে,২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি একটি সরকারী সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় এস. আলম প্রথমে বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি দখলে নেয়। এ কাজে সার্বিক সহযোগীতা করেন, তৎকালীন ব্যাংকটির এমডি ও সিইও আব্দুল মান্নান। ইসলামী ব্যাংক দখলের পর এই ব্যাংকের টাকায় আকর্ষিক ঝড়ের মতো একের পর এক বাংলাদেশের অর্থিক খাতে ২০১৭ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহ দখলে নিতে থাকে বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক সমূহ। এস. আলমের এই দখলদারিত্ব-লুটপাট এবং অফিসিয়াল ডাকাতির বিষয়ে মুখ খুলতে কারো সাহসতো দূরের কথা সে দিকে তাকাতেও কেউ সাহস পায় নি।
এই সময়ের মধ্যে যদিও দৈনিক ডেইলি স্টার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন “এস. আলমের আলাদিনের চেরাগ” প্রকাশ করার মতো দুঃসাহসিক কাজ করেছে। প্রতিবেদনটি ব্যাপকভাবে সারা জাগালেও হাসিনার আজ্ঞাবহ কোর্ট সে প্রতিবেদনের ফলাফল যাতে সামনে না এগুতে পারে এজন্য নির্দেশনা প্রদান করে। এতে এস. আলম গ্রুপ আরো আগ্রাসীভাবে ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিতে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে ।
২০২৪ সালে ভোটারের পরিবর্তে ছাগল, গরু, কুকুর ঘুমানো ভোটার বিহীন মাঠের কেন্দ্রে বক্স ভর্তি ভোটে নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। তাকে প্রথম ফুলের মালা দিয়ে প্রথম বরন করেন এস. আলম পরিবার। ব্যাংকিং খাতে অনেকে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার এই ভোটার বিহীন নির্বাচনের খরচের বিশাল একটা অংশ বহন করেছে এই এস. আলম।
এ ছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিশাল অংকের খরচও যোগান দিয়েছে এই এস. আলম। এতে শেখ হাসিনা তার প্রতি সন্তুষ্টি হয়ে একের পর এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান তুলে দেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। এস. আলমের প্রতি শেখ হাসিনার তাহাজ্জুদান্তের নির্ভেজাল দোয়া, চলার পথের সাহসিক আশির্বাদ ও ঐকান্তিক চাওয়াটা বাস্তবায়ন করে দিয়েছ সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও পরিদপ্তর সমূহ। এমন কথাও বলেছেন অনেকে।
চিটাগাং ভিত্তিক এই এস. আলম গ্রুপ ২০১৭ সালের আগে দেশের ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের কাছে খুব বেশী পরিচিত ছিলো না। কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা জানিয়েছেন, এই অখ্যাত, অজ্ঞাত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিভাবে হঠাৎ করে ২০১৭ সালে পর ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় মাফিয়া ডন হয়ে উঠেছিল এ নিয়ে অর্থখাতে রয়েছে নানা আলোচনা সমালোচনা।
এই এস. আলম গ্রুপ শুধু অর্থ পাচার, আত্মসাৎ, লুটপাটে তাদের কাজ সীমাবদ্ধ রাখে নি, ব্যাংকিং খাত বিশেষতঃ ইসলামী ব্যাংকিং খাতে কয়েক হাজার অযোগ্য, অদক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে । এর মধ্যে তাদের দখলদারিত্বে থাকা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিতে দশ হাজারের অধিক লোকবল নিয়োগ দিয়েছে বলে জানা যায়।
আরো জানা যায়, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির সকল নিয়মনীতি লংঘন করে বিশাল সংখ্যক এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্ন করেছে। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সাল থেকে পটিয়ার বা চট্রগ্রামের নিয়োগ দেয়া অধিকাংশের ব্যাংকের রুলস এন্ড রেগুলেশন অনুযায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হয় নি। এদের মেজরিটির নিয়োগ দেয়া হয়েছে বেক ডোর দিয়ে।
এ ছাড়া কয়েক হাজারের সনদ জ্বাল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সূত্রটি আরো জানিয়েছে, গত ২০১৭ সাল থেকে পটিয়া ও চট্টগ্রামের যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে এদের সনদ বোর্ড বা বিশ্ব বিদ্যালয় সমূহে জাস্টিফিকেশন করা হলে এদের কয়েক হাজারের সনদ বের হবে জাল। এ ছাড়া, এস. আলমের দখলদারিত্বে থাকা অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহে ২০১৭ সালের পরে নিয়োগ দেয়া জন বলের একই দশা হবে বলেও কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে। তারা জানিয়েছেন, বোর্ড বা বিশ্ব বিদ্যালয়ে জাস্টিফিকেশন করা হলে জাল সনদের ছড়াছড়ি হতে পারে।
গত ৫ আগষ্ট আলোকজ্জল দিনের বেলায় ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর একে একে বের হতে থাকে এস আলম সহ অন্যান্য ব্যাংক লুটেরাদের সার্বিক কর্মকান্ড। এ যাবৎকালে বাংলাদেশের ইতিহাসে তথা এশিয়ার কোন দেশে এত বড় ধরনের পাচার ও আত্মসাৎ বা আর্থিক কেলেংন্কারীর ঘটনা সংঘটিত হয় নি । প্রতিষ্ঠানটির সাথে পলায়নকৃত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবারের সংশ্লিষ্টতা থাকায় রাষ্ট্রীয় কোন প্রতিষ্ঠান গত কয়েক বছর কোন ধরনের প্রতিকার মূলক ব্যবস্হা দূরের কথা টু শব্দ করতেও সাহসী হয়নি।
সাইফুল আলমের এস. আলমের গ্রুপের বিরুদ্ধে কয়েক বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ মুখে মুখে থাকলেও প্রকাশ্য এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা পাচার করে সিঙ্গাপুরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অভিযোগ ছিলো অনেক আগে থেকেই । একরোখা সৈরাচার শেখ হাসিনার পলায়নের পর সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান এস আলমের লুটপাট, আত্মসাৎ ও পাচারের বিষয়ে সক্রিয় হয়ে মাঠে নেমেছে বলে জানা যায় । বিগত দিনের অভিযোগের পূণ:অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে এস আলম গ্রুপের ব্যাংক হিসাবের যাবতীয় লেনদেনের তথ্য এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করেছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক মোঃ নূর-ই-আলম । সম্প্রতি দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন, গত বছরের আগস্ট মাসে এস আলমের অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক। উচ্চ আদালতের এক আদেশের পর অনুসন্ধান কাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল। আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণের পর পুন:রায় অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে। এ অনুসন্ধানের তদারকির দায়িত্বে রয়েছন মানিলন্ডারিং শাখার পরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী।জানা যায়, সাইফুল আলম তথা এস আলম আওয়ামী লীগ সরকারের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সাধারণত বিদেশে বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এ গ্রুপটি কোনো নিয়মনীতি তোয়াক্কা করে নি। গত এক দশকে সিঙ্গাপুরে এস আলম অন্তত দুটি হোটেল, দুটি বাড়ি, একটি বাণিজ্যিক স্পেস এবং অন্যান্য যে সম্পদ কিনেছেন সেখানেও বিভিন্ন উপায়ে কাগজপত্র থেকে তার নাম সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলেও জানা যায়।
উল্লেখ্য যে,এস আলম গ্রুপ বিনিয়োগ গ্রহনণর নামে সবচেয়ে বেশী আত্মসাত ও পাচার করেছে দেশের সর্ব প্রাচীন ও সর্ব বৃহত্তর আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি থেকে। এই ব্যাংকটি ২০১৭ সালে শেখ হাসিনার মদদে, একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্যে পরিকল্পিতভাবে দখল করে নেয় এস. আলম গ্রুপ। দখলে নেয়ার পর ব্যাংকটি ৯ টি শাখার মাধ্যমে গ্রুপটির ২৯ টি প্রতিষ্ঠানের নামে ৫১ হাজার ৪ শত ৪৬ কোটি টাকা তুলে নেয়। এ ছাড়া ব্যাংকটির অপসোর ব্যাংকিং, সিএসআর, চিপস, এসেট ম্যনেজম্যান্ট, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন থেকে ইত্যাদির মাধ্যমে আরো কয়েক হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বলেও ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র সমূহ জানিয়েছে।
এদিকে ২০১৭ সালে ব্যাংকটি দখলে নেয়ার পর এস আলমের নিজ এলাকা পটিয়া এবং চট্রগ্রামের দশ হাজারের উপরে জন বল নিয়োগ দেয়। বিপুল সংখ্যক জনবলের অর্ধেকাংশের সনদ নেই অথবা জাল সনদে চাকুরী দেয়া হয়েছে বলে ইসলামী ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এদিকে, ৫ তারিখ সৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ও পালানোর পর ইসলামী বাংলাদেশ পিএলসির কর্মকর্তারা ৬ তারিখ থেকে এস. আলমের দখলদারিত্ব মুক্তি চেয়ে আন্দোলন শুরু করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে তাদের দাবী দাওয়া তুলে ধরে স্মারকলীপি পেশ করে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিকখাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে হিসেবে এস. আলম গ্রুপের কর্তৃত্ব ও তাদের গঠিত বোর্ড বাতিল করে ইসলামী ব্যাংক পিএলসিতে ৫ সদস্যের একটি একটি নতুন বোর্ড গঠন করে দিয়েছে। ৫ সদস্যের এই বোর্ডে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়ীত্ব দেয়া হয়েছে, সোনালী ও রুপালী ব্যাংকের সাবেক এমডি ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদকে।
তিনি ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক এবং ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রূপালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নতুন পর্ষদের অন্য পরিচালকেরা হলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ খুরশীদ ওয়াহাব, আল–আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল জলিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের অধ্যাপক এম মাসুদ রহমান ও সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ আব্দুস সালাম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত বৃহস্পতিবার নিয়োগ অনুমোদন করেন । ইতোমধ্যে, ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদ ও অন্যান্য পরিচালকদের নিয়ে রাজধানীর মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় নবগঠিত পরিচালকদের অপসারণের দাবী সম্বলিত পোষ্টার সাটানো দেখা গেছে।
এ ছাড়া দখলদারিত্বে থাকা সব ব্যাংকে এস আলমের গঠিত বোর্ড ভেংগে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ইতোমধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড ভেংগে দিয়ে নতুন করে ৫ সদস্যের বোর্ড গঠন করে দেয়া হয়েছে।
এস. আলম গ্রুপ সম্পর্কে আমাদের অনুসন্ধান চলমান।