মুনিয়া হত্যাকান্ডে থানার পুলিশ ও পিবিআই তদন্তের কারসাজিতে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীর এখনো ধরাছোঁয়ার বাহিরে
এম শাহীন আলম : কলেজ ছাত্রী মুনিয়া হত্যাকান্ডের ঘটনায় গত ২০ আগস্ট-২০২৪ (মঙ্গলবার) জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে মুনিয়া হত্যার পুনঃতদন্তে দাবী সহ ন্যায়বিচারে বাধা দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন অভিযোগ করেন মুনিয়ার বড় বোন তানিয়া। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা ও আইন উপদেষ্টার কাছে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিও করেন তানিয়া।
মুনিয়ার বড় বোন অভিযোগ করে বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবাহান আনভীর সহ হত্যায় জড়িতদের প্রতি প্রভাবিত হয়ে ছাড় দিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এই মামলার আইনজীবী অভিযোগ করে বলেন, রাষ্ট্র, তদন্তকারী কর্মকর্তা এমনকি আদালতকেও ম্যানেজ করে মামলা থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন সায়েম সোবাহান আনভীর। শুধু তাই নয়, মামলা উঠিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন সময় সায়েম সোবাহান ও তার অনুসারীরা বাদীকে টাকার প্রলোভন দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।
এছাড়াও মামলার তদন্তকারী কারা কারা ঘুষ নিয়ে মামলাকে প্রভাবিত করতে সহায়তা করেছে তাও খুঁজে বের করার আহ্বান জানান আইনজীবী। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে মামলা পুনঃতদন্তেরও দাবি করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
উল্লেখ্য, গত ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল রাজধানীর গুলশানে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের ভাড়া করা একটি ফ্ল্যাট থেকে কলেজ ছাত্রী মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ফ্ল্যাট থেকে একটি ডায়েরি পাওয়া যায় যেখানে মুনিয়ার সঙ্গে আনভীরের প্রেম ও শারীরিক সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে লেখার প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই সময় গুলশান থানায় মুনিয়াকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগে আনভীরকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু পরক্ষণে ওই মামলায় আনভীরকে অব্যাহতি দিয়ে গুলশান থানার পুলিশ ২০২১ সালের ১৯ জুলাই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। একেই বছরের ১৮ আগস্ট ওই মামলার চার্জশিটও গ্রহণ করেন আদালত। মুনিয়ার পরিবারের অভিযোগ আওয়ামী রাজনীতির ছত্র-ছায়ায় আর প্রভাবশালী বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীরের সাথে আতাঁত করে ঢাকা মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী ওই সময় পুলিশের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে মুনিয়ার পরিবারের করা অনাস্থা আবেদনটিও খারিজ করে দেন।
ওই সময়ে রাজধানীর গুলশানে একটি ফ্ল্যাটে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের করা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার এজাহারনামীয় আসামি সাইফা রহমান মিমকে তার বাসা থেকে গ্রেফতার করে পরে তাকে পিবিআইয়ের স্পেশাল ক্রাইম অফিসে নেন। ওইদিন সন্ধ্যায় পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার এ তথ্য জানান।
মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলায় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীর ও তার পরিবারের সদস্যদের অব্যাহতি দিয়ে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান তানিয়া ওই বছর ৬ সেপ্টেম্বর তাদের বিরুদ্ধে হত্যা ও ধর্ষণের মামলা করেন।
তৎকালীন ঢাকার ৮ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মাফরুজা পারভীন বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে পিবিআইকে এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ প্রদান করেন।
ওই সময়ে কলেজছাত্রী মুনিয়া হত্যার ঘটনায় বসুন্ধরার এমডি আনভীরের পাশাপাশি তার বাবা বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, মা আফরোজা সোবহান, আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা, শারমিন, সাইফা রহমান মিম, মডেল
ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা এবং ইব্রাহিম আহমেদ রিপনকে এ মামলায় আসামি করা হয়।
তৎকালীন কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে আদালতকে অবহিত করেছেন বাদীপক্ষের আইনজীবীরা। তারা আদালতকে জানান, মুনিয়াকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেলেও প্রধান আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে এ মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদও করেননি। এমনকি ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণে পরীক্ষার জন্য তার কাছ থেকে কোনো নমুনাও নেয়নি তদন্তকারীরা। মামলার আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় তারা পার পেয়ে গেছে বলেও আদালতকে অবহিত করেন বাদী পক্ষের আইনজীবীরা।
একেই বছর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল-৮-এর বিচারক শওকত আলীর আদালতে বহুল আলোচিত মুনিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর আদালত পরবর্তী শুনানির জন্য ২০২১ সালের ২০ মার্চ নতুন তারিখ ধার্য করেন।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই)ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে মামলার বাদী নারাজি দেওয়ার ১৩ মাস পর যখন শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। তখন শুনানিকালে এজলাসে অঝোরে কাঁদেন মামলার বাদী ও মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া। আদালতের কাছে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে তিনি বলেন, নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাকে আদালতে আসতে কয়েক দফা গাড়ি পরিবর্তন করতে হয়েছে। বোনের হত্যার ন্যায়বিচার চেয়ে মামলা করায় প্রধান আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীর ও তার সহযোগীরা তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছিলেন মুনিয়ার বড় বোন তানিয়া।
ওই সময়ে শুনানিতে বাদীপক্ষের আইনজীবী পিবিআইর চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা তুলে ধরেন। এ সময় বারবার আসামিপক্ষ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। বাদীপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন ও অ্যাডভোকেট মাসুদ সালাউদ্দিনসহ কয়েকজন। আসামিপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাডভোকেট তুহিন হাওলাদারের নেতৃত্বে কয়েকজন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট রেজাউল কবির রেজা।
বাদীপক্ষের আইনজীবীরা তাদের বক্তব্যে বলেন, এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার আগে মুনিয়া প্রায় ৩ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বিষয়টি জানতে পেরেই বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের “মর্যাদা” রক্ষায় পুরো পরিবার মিলে চক্রান্ত করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। বিচারক জানতে চান, এ সংক্রান্ত কোনো মেডিকেল রিপোর্ট আছে কি না? উত্তরে আইনজীবী জানান, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেই অন্তঃসত্ত্বা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে অভিযুক্ত আনভীরের ডিএনএ পরীক্ষা হয়েছে কি না বিচারক তা জানতে চাইলে আইনজীবী বলেন, অভিযুক্ত আসামি আনভীরকে গ্রেপ্তার বা কোনো জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়নি। বাদীপক্ষ থেকে বারবার আবেদন করা হলেও পুলিশ ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করেনি। জিজ্ঞাসাবাদ না করা ও ডিএনএ পরীক্ষা না হওয়ার কথা শুনে বিচারক আশ্চর্য হয়ে বলেন, কিন্তু সেটাই তো হওয়ার কথা। এ সময় বাদী নুসরাত জাহান তানিয়া বলেন, অথচ মামলার তদন্তকারীরা আমাকে টানা ৬ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এই শুনানি চলাকালে পাশ থেকে অনেক আইনজীবী বলতে থাকেন, প্রভাবশালীদের বিচার হয় না।
তৎকালীন থানার মামলায় কোন বিচার না পেয়ে মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান তানিয়া পরক্ষণে আনভীরকে প্রধান আসামি করে মুনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা করার অভিযোগ এনে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮-এর আদালতে মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, মুনিয়াকে ধর্ষণ করে শ্বাসরোধে হত্যা করেছেন বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর। অন্যরা এ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে নানাভাবে সহযোগী ছিলেন। আনভীর ছাড়া মামলার অপর আসামিরা হলেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলম, তার স্ত্রী আফরোজা বেগম, আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা, আনভীরের বান্ধবী সাইফা রহমান মিম, আনভীরের আরেক বান্ধবী মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, বাড়ির মালিক ইব্রাহিম আহমেদ রিপন ও তার স্ত্রী শারমীন। এরপর আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত চলাকালে পিবিআই মুনিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও সাইফা রহমান মিমকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডেও নেয়। পরে আসামিদের নির্দোষ দাবি করে পিবিআই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে ২০২২ সালের অক্টোবরে। পিবিআইয়ের প্রতিবেদনের ওপর আদালতে নারাজি দেন নুসরাত জাহান তানিয়া।
ওই সময়ে শুনানি শেষে বাদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন বলেন, মুনিয়াকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। এবং তদন্তে তা সঠিকভাবে আসেনি সেটি আমরা আদালতকে বলেছি। আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমরা পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দিয়েছি। আদালত আমাদের কথা শুনে ওই বছর ২০ মার্চ শুনানির দিন নির্ধারণ করেন। আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে বলে আইনজীবি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
কলেজ ছাত্রী মুনিয়া হত্যার ঘটনায় অনুসন্ধানে জানা যায়,চলতি বছরের মার্চ মাসে আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডিসহ আটজনকে অব্যাহতি দেন। মামলায় অব্যাহতি পাওয়া ব্যাক্তিরা হলেন, সায়েম সোবহান ছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমদ আকবর সোবহান, তাঁর স্ত্রী আফরোজা সোবহান ও সায়েমের স্ত্রী সাবরিনাকে আসামি করা হয়। অন্য আসামিরা হলেন সাইফা রহমান, ফারিয়া মাহবুব, শারমিন ও ইব্রাহিম আহমেদ। এছাড়াও এ মামলায় সাইফা ও ফারিয়াকে গ্রেপ্তার করেছিলেন পিবিআই। পরে তাঁরাও জামিনে মুক্তি পান।
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮–এর বিচারক শওকত আলী আজ বুধবার চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেন। ওই ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক (পিপি) প্রসিকিউটর রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পিপি রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান ওরফে মুনিয়া হত্যার অভিযোগে করা মামলায় পিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন জমা দেয় বাদীপক্ষ। আদালত সব পক্ষের শুনানি নিয়ে পিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেন।
অন্যদিকে কলেজছাত্রী মোসারাতের বড় বোন নুসরাত জাহানের আইনজীবী মাসুদ সালাউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, আদালত পিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করায় আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন। তাই বিচারিক আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাননি ভুক্তভোগীর বড় বোন। আদালতের এই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে শিগগির হাইকোর্টে আবেদন করা হবে।