অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: আরাকান বর্বর সেনারা আসতো রাতের অন্ধকারে। প্রায়ই আসতো। জুন মাসের এমন এক রাত। পশ্চিম মিয়ানমারের কোনো এক গ্রামে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সদ্যবিবাহিত এক দম্পতি। আচমকা সদলবলে তাদের শোবার ঘরে ঢুকে পড়লো সাত বর্মী সেনা।
ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে গেলেন নববধূ এফ (নামের আদ্যাক্ষর)। তার আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না। তিনি জানতেন, সেনারা রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে হামলা চালাচ্ছে। ক’দিন আগেই তার পিতা-মাতাকে হত্যা করেছে সেনারা। ভাইয়ের খোঁজ মেলেনি। এ দফায় বর্মী বাহিনীর টার্গেট সে। সেনারা এফের স্বামীকে বেঁধে ফেলে দড়ি দিয়ে। তার মাথা থেকে স্কার্ফ টান দিয়ে খুলে ফেলে তা দিয়ে মুখ বেঁধে দেয়। কেড়ে নেয় শরীরে থাকা স্বর্ণালঙ্কার। পরনের পোশাক ছিঁড়ে তাকে ছুড়ে ফেলে মেঝেতে। পালাক্রমে ধর্ষণযজ্ঞ চালায় মানুষরূপী পশুগুলো। এর মাঝে চলেছে লাঠি দিয়ে প্রহার। পাশেই শূন্যদৃষ্টিতে নিজের স্ত্রীর সম্ভ্রম হরণ হতে দেখলেন অসহায় স্বামী। এরপর এক সেনা এফ-এর স্বামীর বুকে গুলি চালায়। আরেক সেনা তার গলা কেটে ফেলে। পরে এফকে বিবস্ত্র অবস্থায় বাড়ির বাইরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় সেনারা। তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। দু’মাস পরে এফ বুঝতে পারেন, বিভীষিকার এখানেই শেষ নয়; তিনি অন্তঃসত্ত্বা।
নৃশংস পাশবিকতার এমনই সব বর্ণনা উঠে এসেছে নজিরবিহীন যৌন নির্যাতনের শিকার ২৯ নারীর মুখে । বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে তাদের পৃথক সাক্ষাতকার নেয় বার্তা সংস্থা এপি। ক্রাইসিস রিপোর্টিংয়ের ওপর পুলিতজার সেন্টারের অনুদানে এপি বিশেষ এই প্রতিবেদন তৈরি করে। সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি তৈরির সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছ থেকে মন্তব্য চেয়েও পায়নি এপি। ধর্ষণের শিকার এই ২৯ নারীর বয়স ১৩ থেকে ৩৫। ২০১৬’র অক্টোবর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বিভিন্ন সময়ে তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রত্যেকের মুখেই একইরকম বর্ণনা শোনা গেছে। এপি তাদের বিশেষ এই প্রতিবেদনের শিরোনামে বলেছে, রোহিঙ্গাদের পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। প্রসঙ্গত, এর আগে জাতিসংঘ এবং শীর্ষস্থানীয় দুই গণমাধ্যম বিবিসি ও গার্ডিয়ানের নিজস্ব অনুসন্ধানগুলোতে একইরকম নিপীড়নের বহু ঘটনা উঠে আসে।
এপি তাদের অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী সংঘবদ্ধ ও পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণযজ্ঞ চালিয়েছে রোহিঙ্গা নারীদের ওপর। তাদের ছোবল থেকে বাদ পড়েনি ১৩ বছরের শিশুও। স্বামীকে বেঁধে রেখে তার চোখের সামনে, কখনো বা স্বামী-সন্তানকে হত্যার পর ধর্ষণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গা নারীদের যোনিতে বন্দুকের নল ঢুকিয়েও নির্যাতন করার ঘটনাও ঘটেছে।
নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা নারীদের ভাষ্য ছিলো একইরকম। প্রত্যেকেই হামলাকারীদের পরনে থাকা উর্দির যে বর্ণনা দিয়েছে তা স্থানীয়রা সেনাঘাঁটিতে থাকা সেনাদের পরনে দেখেছেন। অনেক নারী জানান, হামলাকারীদের পোশাকে তারা, তীর কিংবা সামরিক বাহিনীর অন্যান্য চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন। এফ-এর মতোই গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এই নারীরা। কোথাও কোথাও নারীদের পুরুষদের থেকে আলাদা করে অন্য জায়গায় নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। চোখের সামনেই হত্যা করা হয়েছে তাদের সন্তানদের। স্বামী, সন্তান, সম্ভ্রম সর্বস্ব হারিয়ে দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন তারা।
বার্তা সংস্থা এপি’র তরফে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বার বার কথা বলতে চাওয়া হলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, এতো প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অং সান সুচির সরকার শুধু ধর্ষণযজ্ঞের নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে- তাই নয়, এগুলো স্রেফ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
১৩ বছরের মেয়েটির ঘটনা বর্ণনায় এপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, মেয়েটি এখনো শিশু। তার শরীরে যৌনতার ছিটেফোঁটাও প্রকাশ পায় নি। তারপরও রেহাই পায় নি সে। তার শিশুত্বও তাকে রক্ষা করতে পারে নি। ১০ সেনা পালাক্রমে তার ওপর পাশবিকতা চালিয়েছে। কয়েক ঘণ্টার নির্যাতনে সংজ্ঞা হারায় সে। আর তার দুই ভাই নিখোঁজ ছিলো। তাদের মা পরবর্তীতে আর’কে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। অপর দুই সন্তানকে খুঁজে বের করার সময় জোটেনি কপালে। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটি এখন রাতে ঘুমাতে পারে না। দুঃস্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায় তাকে। নিজের ওপর হওয়া নির্যাতন ছাপিয়ে ভাই হারানোর বেদনা তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। কিছুতেই ভুলতে পারে না ছোট্ট দুই ভাইয়ের কথা।