কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করার প্রক্রিয়ার নাম কোচিং। আভিধানিক অর্থ এটাই। লক্ষ্যটি ব্যক্তিগত বা পেশাগত হতে পারে। প্রশিক্ষণ ও উপদেশনার মাধ্যমে এ সহায়তা দেওয়া হয়। যিনি দেন তিনি ‘কোচ’। শব্দটি ক্রীড়াঙ্গনে বেশি চালু। বছর ৪০ ধরে শব্দটি আমাদের শিক্ষাঙ্গনেও
চালু রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষক বা উপদেশককে কোচ বলা হয় না, তিনি শিক্ষকই। ১৮৩০ সালের দিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ‘উত্তীর্ণ’ করানোর জন্য বিশেষ প্রক্রিয়া চালু করেছিলেন কিছু শিক্ষক। বিষয়টিকে তেমন সুনজরে দেখা হয়নি, তাই নিন্দার্থে ‘কোচিং’ শব্দটি চালু হয়। শিক্ষণের বিশেষ প্রক্রিয়া বোঝাতে শব্দটি ব্যাপকভাবে প্রযুক্ত হতে থাকে সত্তরের দশকে। আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘কোচিং’ ব্যাপকতা লাভ করে আশির দশকে। শুরুর দিকে বাছাইকৃত ছাত্রদের চূড়ান্ত পরীক্ষায় (পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা ও এএসসি পরীক্ষা) ভালো ফল করানোর জন্য কোচিং করানো হতো। কিছু ফি নেওয়া হতো; কোনো কোনো স্কুলে বিনা ফিতেই কোচিং করানো হতো। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভালো ফল করিয়ে প্রতিষ্ঠানের সুনাম অর্জন করা। বছর দশেকের মধ্যে উদ্দেশ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, অতিরিক্ত উপার্জনের উপায় হিসেবে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেন শিক্ষকরা। এখন শুধু চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য নয়, ভর্তি-চাকরি প্রভৃতি ব্যাপারেও ‘কোচিং’ লাগে। কোচিং ব্যবসার বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। স্কুল শিক্ষকদের অনেকে এটিকে বাধ্যতামূলক করে তুলেছেন। তাঁদের কাছে কোচিং না করলে স্কুলের পরীক্ষায়ও ভালো করার গ্যারান্টি নেই। গভর্নিং বডির সঙ্গে অনৈতিক আর্থিক সম্পর্কে ও প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। পাকেচক্রে কোচিং শব্দের অর্থ আবার বিগত কালের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গিয়ে হাজির হয়েছে। কোচিং-সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের নিয়ে গণমাধ্যমে, বিশেষ করে মুদ্রণ মাধ্যমে, সভা-সেমিনারে প্রচুর আলোচনা হয়। এসব আলোচনা-প্রতিবেদনে বিস্তর অভিযোগ থাকে। স্কুলের অনেক শিক্ষক তাঁদের কাছে কোচিং না করলে হয়রানি করেন; পরীক্ষায় নম্বর কম দেন। এ কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা বাধ্য হচ্ছে কোচিং করতে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর আটটি স্কুলের ৯৭ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো চিঠিতে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন, জড়িত শিক্ষকদের বদলিসহ পাঁচটি সুপারিশ করা হয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে শিগগির অভিযানে নামার কথাও বলেছে দুদক। কোচিং যে অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে, তাতে কোনো ইতিবাচকতা অবশিষ্ট নেই। শুরুর দিকের শুভ উদ্দেশ্য বহাল থাকলে এত অভিযোগ উঠত না। আদিরূপে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হতো। সেটি সম্ভব না হলে বন্ধ করে দেওয়াই উচিত। দুদকের পরামর্শ সরকার সক্রিয় বিবেচনায় নেবে বলে আমরা মনে করি। তবে এ বিষয়ে নিয়ামক ভূমিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই পালন করতে হবে।