দেশে ৫টি খাতে সংস্কারের পরই নির্বাচন কূটনীতিকদের বললেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস
এম শাহীন আলম : দেশের ছাত্র জনতার রোষানলে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রথম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সাথে বৈঠককালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন,দেশে খুব দ্রুত অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনী ও মিডিয়ায় সংস্কার এই পাঁচটি খাতে সংস্কার করার পর আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন বলে জানান। গত ১৮ আগস্ট (রবিবার) রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে “মিট অ্যান্ড গ্রিট” অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা জানান।
অনুষ্ঠান শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গণমাধ্যমকে বিষয়টি অবগত করেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে তার সরকারের কার্যক্রমের পুরোপুরি সমর্থন চেয়েছেন। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে দেশে অগ্রাধিকার হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। দ্রুত এটি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিও সরকারের গুরুত্ব থাকবে। একই সঙ্গে তৈরি পোশাক শিল্পে কোনো অস্থিরতা সহ্য করা হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, আমি এমন একটি সময়ে এসে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি, যেখানে অনেক দিক থেকেই পুরোপুরি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তিনি আরো বলেন,ক্ষমতায় থাকার চেষ্টায় শেখ হাসিনার স্বৈরাচার সরকার দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। দীর্ঘ দেড় দশকের নির্মম নৃশংসতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার দমন করা হয়েছিল। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম তাদের ভোটাধিকারের চর্চা না করেই বেড়ে উঠেছে। আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে লুণ্ঠন করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক গুলোকেও লুট করা হয়েছে।
ড. ইউনূস আরো বলেন, দেশ নিয়ে ছাত্রদের একটি স্বপ্ন আমাদের মুগ্ধ করেছে, যে স্বপ্ন একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। ছাত্ররা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখছে যেখানে মানুষ তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে, নিজেদের আকাঙ্খা পূরণ করতে ও মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। সরকার গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে।
এই ছাত্র জনতার আন্দোলনকে দেশের “দ্বিতীয় বিপ্লব” হিসেবে অভিহিত করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এখন নতুনভাবে শুরু করতে হবে। লাখো জনতার অভ্যুত্থানে চরম স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কিন্তু যাওয়ার আগে নিরাপত্তা বাহিনী এবং শেখ হাসিনার ছাত্র সংগঠন স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম বেসামরিক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তারা।
অনুষ্ঠান চলাকালে ছাত্র আন্দোলনে হতাহতদের কথা স্মরণ করে আবেগঘন হয়ে পড়েন প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় তিনি কূটনীতিকদের বলেন,পৃথিবীর কোনো দেশে ছাত্রদের এত ত্যাগ করতে হয়নি। পৃথিবীর কোথাও নাগরিকরা এতটা মানবাধিকার বঞ্চিত হয়নি, যা বাংলাদেশে হয়েছে।
বাংলাদেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন,এসব ঠিক করতে সময় লাগবে। আশা করি, নতুন বাংলাদেশ তৈরিতে সবাই পাশে থাকবেন। এসব সংস্কার শেষ করার পর নির্বাচন করবে এই সরকার
আওয়ামী লীগ ও তার দলবলের হামলায় ছাত্র আন্দোলনে শত শত মানুষ মারা গেছে ও হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে জানিয়ে ড.ইউনূস বলেন,অনেক ছাত্রের চোখে গুলি লেগেছে। তাদের দেখতে গিয়েছিলাম। জানি না তাদের কী হবে।
অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস কূটনীতিকদের কাছে তার সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন চেয়েছেন। তিনি কূটনীতিকদের বলেন, এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা ফেরানো এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তার সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার। জনগণের অটুট সমর্থন ও দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তায় শিগগিরই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরবে বলে আশা করেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস কূটনীতিকদের আরো বলেন,জাতিসংঘের তদন্তকে স্বাগত জানিয়েছে সরকার। সরকার চায় যে গণহত্যা চালানো হয়েছে তার নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। এ কারণে সরকার জাতিসংঘের তদন্ত দলকে সহায়তা করবে। তিনি জানান,কিছুদিন আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার টুর্কের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত চাই আমরা। এর জন্য জাতিসংঘের তদন্তকারী দলকে আমরা সব ধরনের সহায়তা দেবেন বলে কুটনীতিকদের আশ্বস্হ করেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমাদের সরকার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে সহায়তা অব্যাহত রাখবে। রোহিঙ্গাদের মানবিক কার্যক্রম এবং তাদের শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা, মর্যাদা ও পূর্ণ অধিকারসহ তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিরন্তর প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করার জন্য আমরা সুশাসন, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার দিয়ে শক্তিশালী এবং সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক সংস্কার গ্রহণ করব। গ্লোবাল ক্লদিং সাপ্লাই চেইনের ক্ষেত্রে আমরা মূল প্লেয়ার। কাজেই এ সাপ্লাই চেইন কেউ বাধাগ্রস্ত করলে আমরা তা সহ্য করব না।
অনুষ্ঠানে প্রায় ৫০ জনের অধিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা অংশ নেন বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।