২০১১ সালে মানিকগঞ্জে এক পথ দুর্ঘটনায় নিহত তারেক মাসুদের পরিবারকে আদালত ৪ দশমিক ৬২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাস ড্রাইভার, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এবং তিনজন বাস মালিককে যথাক্রমে ৩০ লাখ, ৮০ লাখ এবং ৪ দশমিক ৩০ কোটি টাকা দেওয়ার
নির্দেশ দিয়েছেন। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য তারেক মাসুদের পরিবারকে এভাবে আদালত কর্তৃক ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেওয়া বাংলাদেশে একটি ব্যতিক্রমী ব্যাপার। তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। এক সময় তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সদস্য ছিলেন। তার মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তি ও কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার এই নির্দেশ গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এর মাধ্যমে এটা একভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, পথ দুর্ঘটনায় যে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ প্রতি বছর নিহত হচ্ছেন, তাদের পরিবারকেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া প্রয়োজন। এ কথা তারেক মাসুদের স্ত্রীও বলেছেন তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রায় প্রকাশিত হওয়ার পরই। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী হাইকোর্টও মন্তব্য করেছেন যে, দুর্ঘটনায় নিহতদের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান ভিন্ন হলেও স্নেহ ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে তারা সমান। কাজেই তাদের সবার পরিবারকে একই পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া দরকার (ডেইলি স্টার, ৪.১২.২০১৭)।
দুনিয়ার সব দেশেই সড়ক দুর্ঘটনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে তার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং সরকার কর্তৃক প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী চার-পাঁচ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন! কিন্তু তা হলেও আজ পর্যন্ত এ ধরনের দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত কোনো পরিবারকেই সরকার বা বাস মালিকরা এক পয়সার ক্ষতিপূরণও দেয়নি। এরশাদের আমলে ঘোষণা করা হয়েছিল- বাস দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে বাস মালিকরা বাধ্য থাকবে। কিন্তু হাজার হাজার নিহত লোকের একজনের পরিবারকেও কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সরকার বাধ্য করেনি। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের পর নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও এদিক দিয়ে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কবীর কাসেম বরিশাল থেকে পাবনা যাওয়ার পথে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এভাবে তার মৃত্যুর প্রতিবাদে বরিশাল শহরে বড় ধরনের সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল ইত্যাদি হয়। সেই বিক্ষোভের মুখে সংশ্নিষ্ট বাস কোম্পানি তাদের অফিস বন্ধ করে কয়েক দিনের জন্য গা-ঢাকা দেয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তার পরিবারকে কোনো ক্ষতিপূরণই দেওয়া হয়নি। কিন্তু এটাই কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। এখনও প্রত্যেক দিন সংবাদপত্রের পাতায় পথ দুর্ঘটনায় দশ-বিশ-চল্লিশ জনের মৃত্যু সংবাদ এক নিয়মিত ব্যাপার। কিন্তু মালিক শ্রেণির, সরকারের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় এভাবে প্রতি বছর হাজার হাজার লোকের মৃত্যু হলেও তাতে তাদের কিছু যায়-আসে না।
তারেক মাসুদ দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর এটা শুধু আইনগতভাবে নয়; নীতিগতভাবেও প্রমাণিত হয়েছে যে, যারা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছেন, তাদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ পাওয়া দরকার। এ ধরনের অনেক লোকের মৃত্যু হয়, যাদের পরিবারের উপার্জনক্ষম অন্য কোনো লোক না থাকায় তারা ভিক্ষুকে পর্যন্ত পরিণত হচ্ছেন। কিন্তু এসব কথা বিবেচনার কোনো ব্যাপার সরকারের নেই। একজন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী সব সময়ই থাকেন। তার কাজ হলো শুধু নীতিবাক্য আওড়ানো এবং দুঃখ প্রকাশ করা। কিন্তু এভাবে দুঃখহীন লোকদের দুঃখ প্রকাশ নিহত লোকদের পরিবারের কোনো কাজে আসে না। কোনো ক্ষতিপূরণ না পেয়ে তাদের জীবন বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত হয়।
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয়ের উল্লেখ করা দরকার। তারেক মাসুদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা দায়ের করে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এ ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা দায়ের করতে হবে কেন? একজন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে তার জন্য ক্ষতিপূরণ তার পরিবারের অবশ্য প্রাপ্য। এ ক্ষতিপূরণ এমন ব্যাপার, যা মামলা করে আদায় করার মতো নয়। তা ছাড়া এভাবে মামলা না করলে যদি ক্ষতিপূরণ পাওয়া না যায়, তাহলে ৯৯ শতাংশ পরিবারই ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হবে। কেননা, আর্থিক কারণ ছাড়া অন্য নানা কারণেই মামলার মধ্যে যাওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই।
সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, এগুলো প্রকৃতপক্ষে দুর্ঘটনা নয়। মালিকদের মুনাফার তীব্র লোভ এবং সরকারের সঙ্গে মালিকদের সম্পর্কের কারণে এসব দুর্ঘটনার কারণ কোনো সময়েই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় না। যেসব বাস সড়কপথে চলাচল করে, সেগুলো চলার যোগ্য কি-না তার কোনো নিয়মিত তদারকি মালিকরা করে না; পুরাতন, অকেজো বাস তারা রাস্তায় নামায়। এ ছাড়া বাস ড্রাইভারদের নিযুক্তি দেওয়ার সময় তাদের যোগ্যতা দেখার পরিবর্তে অল্প বেতনে তাদেরকে নিযুক্তি দেওয়া হয়। অনেক সময় বাসের হেলপাররা শহরের মধ্যে তো বটেই, এমনকি হাইওয়েতে পর্যন্ত গাড়ি চালায়! এ ছাড়া যে সরকারি সংস্থা বাস চালকদের লাইসেন্স দেয়, তা তাদের যোগ্যতা পরীক্ষা না করেই, ঘুষ খেয়ে। এর ফলে দেখা যায়, অধিকাংশ বাসচালকই গাড়ি চালানোর যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও হাইওয়েতে গাড়ি চালায়। সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার হলো, কোনো সরকারি তদারকিই এ ক্ষেত্রে থাকে না। গাড়ির ফিটনেস ও ড্রাইভারের গাড়ি চালানোর যোগ্যতা যেখানে তদারকির অধীন নয়, সেখানে সড়ক দুর্ঘটনা যে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হবে এবং পরিস্থিতির অবনতি দিন দিন ঘটতে থাকবে; এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে এখন তাই হচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনা আসলে কোনো দুর্ঘটনা নয়। যেভাবে বাংলাদেশে এটা ঘটে; একে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। কিন্তু কে না জানে যে, বাংলাদেশে অপরাধের কোনো বিচার নেই। যেটুকু আছে তা উল্লেখযোগ্য নয়। কাজেই এদেশ হলো অপরাধীদের অভয়ারণ্য। শুধু বাস দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই নয়; অন্য হাজার রকম ক্ষেত্রে যেসব অপরাধ হচ্ছে, সেগুলোর বিচার হচ্ছে না, শাস্তি হচ্ছে না। তা ছাড়া এক একটি মামলার বিচার সম্পন্ন ও শেষ হতে লাগছে অন্তত পাঁচ-ছয়-সাত বছর। তারেক মাসুদের পরিবার যে মামলার রায়ে ক্ষতিপূরণ পেয়েছে, সে মামলা দায়ের করা হয়েছিল ২০১১ সালে। অর্থাৎ তার রায় বের হতেও সময় লেগেছে ছয় বছর! কাজেই অন্য নিহতদের পরিবার মামলা করলেও তাতে যা সময় যাবে, তার মধ্যে ক্ষতিপূরণ না পেয়ে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। তা ছাড়া এ ধরনের মামলা দু’চারটি হয়ে থাকলেও কেউ সেসব মামলায় ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন- এমন কোনো উদাহরণ আমাদের জানা নেই। কাজেই আগের কথায় ফিরে গিয়ে আবার বলা দরকার যে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য মামলা দায়ের করার ব্যবস্থা উঠিয়ে দিয়ে নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। সেটা না হলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের কথা বলা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
পরিশেষে এটা বলা দরকার যে, এ বিষয় নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। আমি নিজেও এ বিষয়ে অনেক লিখেছি। কিন্তু তার ফলে আজ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। উপরন্তু এসব আলোচনা ও লেখালেখি সত্ত্বেও পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। কারণ এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। সারাদেশে যেভাবে এখন অপরাধের জয়জয়কার চলছে, দেশ যেভাবে অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এবং অপরাধীদের শাস্তির কোনো ব্যবস্থা নেই; তাতে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার কোনো পরিবর্তন অদূর ভবিষ্যতে ঘটবে- এমন আশা করার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। জনগণের মধ্যে এ নিয়ে সচেতনতা কিছুটা বৃদ্ধির সম্ভাবনা ছাড়া এ ধরনের লেখালেখি এবং আলোচনার দ্বারা অন্য কিছু অর্জিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই যে নেই- এটা বলাই বাহুল্য।