২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে একটি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে মাইক্রোবাস আরোহী তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন ঘটনাস্থলেই নিহত হনযাযাদি রিপোর্ট চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদমানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার
তারেক মাসুদের মৃতু্যর ঘটনায় তার পরিবারকে চার কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ চেয়ে তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদের করা এক মামলায় বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারম্নল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ রোববার এই রায় দেয়।
রায়ে বলা হয়, চালক, বাস মালিক ও বীমা কোম্পানিকে তিন মাসের মধ্যে ওই অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
এই রায়ে সন্ত্মোষ প্রকাশ করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ক্যাথরিন মাসুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘এতদিনের যন্ত্রণার পর এ রায়টা পেয়ে কিছুটা হলেও সান্ত্ম্বনা পেয়েছি। আমি তারেককে ফেরত পাব না। তবে আজকে আমি কিছুটা সান্ত্ম্বনা পেয়েছি আমার সাত বছরের ছেলের জন্য, যে তার বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।’
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে একটি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে মাইক্রোবাস আরোহী তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
মুক্তির গান ও মাটির ময়না চলচ্চিত্রের জন্য আন্ত্মর্জাতিকভাবে প্রশংসিত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তখন তার নতুন ছবি ‘কাগজের ফুল’-এর শুটিং শুরম্নর কাজ করছিলেন। সাংবাদিকতার সাবেক শিক্ষক মিশুক মুনীর তখন টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ‘কাগজের ফুল’-এর লোকেশন দেখতেই তারা মানিকগঞ্জে গিয়েছিলেন।
তারেক মাসুদের প্রোডাকশন ম্যানেজার ওয়াসিম ও কর্মী জামাল এবং মাইক্রোবাসের চালক মুস্ত্মাফিজও নিহত হন ওই দুর্ঘটনায়।
আহত হন ওই মাইক্রোবাসে থাকা তারেকের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, চিত্রশিল্পী ঢালী আল-মামুন ও তার স্ত্রী দিলারা বেগম জলি এবং তারেকের প্রোডাকশন ইউনিটের সহকারী সাইদুল ইসলামও।
দুর্ঘটনার সময় এই ধগাড়িতেই ছিলেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জনসচেতনতা তৈরিতে সেই গাড়ি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘সড়ক দুর্ঘটনা স্মৃতি স্থাপনা’।
সড়ক দুর্ঘটনায় দুই ব্যক্তিসহ পাঁচজনের মৃতু্যর ওই ঘটনা পুরো দেশকে নাড়া দিয়ে যায়। চলতি বছর ফেব্রম্নয়ারি মাসে মানিকগঞ্জের আদালত চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের ওই বাসের চালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিলেও সেখানে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আসেনি।
দুর্ঘটনার দেড় বছর পর ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রম্নয়ারি তারেক ও মিশুকের পরিবারের পক্ষ থেকে মোটরযান অর্ডিনেন্সে ১২৮ ধারায় বাসমালিক, চালক ও ইনসু্যরেন্স কোম্পানির বিরম্নদ্ধে ক্ষতিপূরণের দুটি মামলা করা হয় মানিকগঞ্জে। পরে বাদীপক্ষের আবেদনে জনস্বার্থে মামলা দুটি হাইকোর্টে স্থানান্ত্মর করা হয়।
২০১৬ সালের ১৩ মার্চ হাইকোর্টে তারেক মাসুদের মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরম্ন হলে প্রথমদিন সাক্ষ্য দেন তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ। বাদীপক্ষে এ মামলায় মোট নয় কোটি ৯৪ লাখ ৩০ হাজার ৯৮ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়।
বিচার শেষে রায়ে বলা হয়, যারা এ দুর্ঘটনা আর মর্মান্ত্মিক মৃতু্যর জন্য দায়ী, তাদের চার কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা দিতে হবে।
এর মধ্যে বাসের চালক দেবে ৩০ লাখ টাকা; বীমা কোম্পানি রিলায়েন্স ইন্সু্যরেন্স কম্পানি দেবে ৮০ হাজার টাকা, আর বাকি চার কোটি ৩০ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫২ টাকা দেবে তিন বাস মালিক।
ক্ষতিপূরণের এই অর্থ পাবেন তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, তাদের ছেলে নিষাদ মাসুদ এবং তারেকের মা নুরম্নন নাহার।
হাইকোর্টে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আব্দুস সুবহান তরফদার। বীমা কোম্পানি রিলায়েন্স ইন্সু্যরেন্স কোম্পানির পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী, শিশির মনির ও সৈয়দ মুহাম্মদ বুরহান উদ্দিন।
তারেক মাসুদের পরিবারের পক্ষে শুনানি করেন ড. কামাল হোসেন। সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইসরাত জাহান।
বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারম্নল হক আকন্দের বেঞ্চ এ মামলার রায় ঘোষণা শুরম্ন করে গত বুধবার সকালে। বৃহস্পতিবার ও রোববার দুপুর পর্যন্ত্ম রায় পড়া চলে এবং এরপর আদালত ক্ষতিপূরণের সিদ্ধান্ত্ম ঘোষণা করে।
রায়ের পর সারা হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘দীর্ঘ পাঁচ বছরের লড়াইয়ের আজ সমাপ্তি টানা হলো। মৃতু্যর জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে তারেক মাসুদের স্ত্রী, ছেলে ও মা মামলাটি করেছিলেন। আজকে (রোববার) রায় পেয়েছি।’
রায়ের বরাত দিয়ে এই আইনজীবী বলেন, ‘স্বামীর স্নেহ বঞ্চিত হওয়ায় এবং স্বামী-স্ত্রীর প্রাকৃতিক জীবন থেকে বঞ্চিত হওয়ায় এ ক্ষতিপূরণের প্রথম দাবিদার তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ।
“যত্ন, সুরক্ষা, পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় দ্বিতীয় দাবিদার তারেক মাসুদের ছেলে নিষাদ মাসুদ এবং সামাজিক নির্ভরতা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তারেক মাসুদের মা নুরম্নন নাহার এ ক্ষতিপূরণের তৃতীয় দাবিদার। তারা এ টাকাটা ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাবেন।”
রিলায়েন্স ইন্সু্যরেন্স কোম্পানির আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, রায়ের অনুলিপি পেলে তা বিশেস্নষণ করে তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত্ম নেবেন।
বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েক হাজার মানুষের মৃতু্য হলেও ক্ষতিগ্রস্ত্ম পরিবারের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ঘটনা বিরল।
এর আগে ১৯৮৯ সালে মিনিট্রাকের চাপায় দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু নিহত হওয়ার ঘটনায় ২০১০ সালে দুই কোটি এক লাখ ৪৭ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। তবে এ রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই।
সড়ক দুর্ঘটনায় যারা কাছের মানুষদের হারিয়েছে, তাদের সবার প্রতি সমবেদনা জানিয়ে ক্যাথরিন মাসুদ রায়ের পর বলেন, ‘এ রায়ের মধ্য দিয়ে আইনগতভাবে এটা স্বীকৃত হলো যে, তথাকথিত দুর্ঘটনা আসলেই দুর্ঘটনা নয়। এর পেছনে চালক ও কোম্পানির দায় আছে। এমনকি ইন্সু্যরেন্স কোম্পানিরও দায় আছে। এখন থেকে আশা করি, অনেকেই ক্ষতিপূরণ পাবে।’
মানিকগঞ্জের সেই দুর্ঘটনায় মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলী কাজী ও ছেলে সুহৃদ মুনীরের করা মামলাটি আগামী ৪ ফেব্রম্নয়ারি হাইকোর্টে শুনানির জন্য রাখা হয়েছে।