এদিকে অভিনব পন্থায় গোপনে এসব লাইসেন্স ইস্যুর ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের ঘুষ বাণিজ্যের প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অধিদফতরের চারজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। এ নিয়ে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের পক্ষ থেকে গঠিত উচ্চপর্যায়ের পৃথক দুটি কমিটি তদন্ত করছে। বলা হচ্ছে, লাইসেন্স কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
সূত্র জানায়, এমনিতেই মোটা অঙ্কের ঘুষ ছাড়া ক্লিনিক হাসপাতালের লাইসেন্স মেলে না। এটাই নাকি অলিখিত রেওয়াজ। সব আমলেই এটা হয়ে আসছে। নিদেন পক্ষে ১০ লাখ টাকা ঘুষ বা সার্ভিস চার্জ না দিলে লাইসেন্স ইস্যু হয় না। যদি এমন অভিযোগকে সত্য ধরে নেয়া হয় তাহলে ৭৭টি লাইসেন্স ইস্যুতে প্রায় ৮ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সিরাজুল হক খান শনিবার বলেন, ‘এ রকম অস্বাভাবিক ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। এরপর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তদন্ত করে তিনি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।’
যেভাবে দেয়া হয় লাইসেন্স : বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে কতিপয় অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারী গোপনে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে লাইসেন্স ইস্যু করেন। বিভিন্ন অযোগ্যতার কারণে যেসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের আবেদন দীর্ঘদিন ধরে পেন্ডিং ছিল মূলত সেগুলোর লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। বড় কর্মকর্তা বিদেশ থেকে ফিরে আসার আগেই ৬ দিনের মধ্যে ৭৭টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুকূলে লাইসেন্স দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. অধ্যাপক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন ৪ থেকে ১০ আগস্ট সরকারি সফরে কানাডা যান। পরিচালকের অনুপস্থিতিতে সহকারী পরিচালক মঞ্জুর হোসেনকে দাফতরিক কাজের রুটিন দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর ৫ আগস্ট থেকে তিনি গণহারে লাইসেন্স দেয়া শুরু করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, হাসপাতাল শাখার পরিচালক বিদেশ থাকার সময় এসব লাইসেন্স ইস্যু করা হবে, এমন পরিকল্পনা আগেই করা হয়। সে জন্য পরিচালক বিদেশে যাওয়ার আগেই সহকারী পরিচালক মঞ্জুর হোসেন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে নিজের নামে স্ট্যাম্প সিলও বানিয়ে রাখেন। পরিচালক বিদেশে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুকূলে লাইসেন্স দেয়া শুরু হয়। ১১ আগস্ট পরিচালক দেশে ফেরার পর অন্তত ১০ দিন বিষয়টি গোপন থাকে। একপর্যায়ে একটি ফাইলের সূত্র ধরে ঘটনা জানাজানি হলে স্বাস্থ্য অধিদফতরে হইচই পড়ে যায়। ঘটনাটি মন্ত্রণালয়কে জানানো হলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সিরাজুল হক খান। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. অধ্যাপক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘আমি মাত্র ৬ দিন কর্মস্থলে ছিলাম না। ১০ আগস্ট দেশে ফিরে ১১ তারিখ যথারীতি অফিস করেছি। কিন্তু ঘটনা জানতে আমার আরও কয়েকদিন লেগে যায়। আমার টেবিলে একটা লাইসেন্স ইস্যুর ফাইল এলে লাইসেন্সের সিরিয়াল নম্বর অস্বাভাবিক মনে হয়। কারণ সিরিয়াল নম্বরটি ছিল অনেক পেছনে। আমি তখনই শাখার লোকজনকে জিজ্ঞেস করি সিরিয়াল নম্বর এত পরে কেন। মাঝখানের নম্বরগুলো কোথায়? নানা ফাইল টানাটানির পর শাখা থেকে জানানো হয়, মাঝখানের ৭৭টি নম্বরের বিপরীতে লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে।’ পরিচালক বলেন, ‘এ ঘটনা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি তখনই বিষয়টি মহাপরিচালক, সচিব ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নজরে আনি।’
জড়িত ৪ জনকে অন্যত্র বদলি : স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দুটি কমিটি ঘটনার তদন্ত করছে। ইতিমধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত হিসেবে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার সহকারী পরিচালক ডা. মঞ্জুর হোসেন ও তিন অফিস সহকারী যথাক্রমে কামরুল হাসান, আতাউর রহমান ও হাবিবুর রহমানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের সবাইকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ের বাইরে অন্যত্র শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। এ ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তাদের কাছে ঘটনার বিষয়ে বক্তব্য চাওয়া হয়েছে।
বেশিরভাগই অযোগ্য প্রতিষ্ঠান : যেসব প্রতিষ্ঠানকে এভাবে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগই অযোগ্য ও লাইসেন্স প্রাপ্তির শর্ত পূরণে ব্যর্থ। বিষয়টি নিশ্চিত করেন খোদ পরিচালক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি জানান, বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী প্রতি ১০ বেডের সুবিধাসম্পন্ন হাসপাতালে সর্বনিন্ম ৩ জন সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, ৬ জন নার্স ও ৩ জন ক্লিনারসহ বেশকিছু অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা উপকরণ থাকা বাধ্যতামূলক। তাছাড়া নিয়মানুযায়ী বেসরকারি খাতে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স পেতে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এ প্রক্রিয়ার প্রথমে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্ধারিত ছকে আবেদন করতে হয়। আবেদিত প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শনের পর লাইসেন্স দেয়ার সুপারিশ পাওয়া গেলে অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ঢাকার মধ্যে হলে প্রত্যেকটি আবেদনের ক্ষেত্রে মেডিকেল অফিসারের প্রতিবেদনসহ সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক, পরিচালক ও মহাপরিচালক পর্যন্ত ফাইল অনুমোদিত হলেই লাইসেন্স ইস্যু করা হয়ে থাকে। ঢাকার বাইরে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জনের সুপারিশ থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ৭৭টি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে এসব নিয়মকানুন মানা হয়নি। প্রয়োজনীয় উল্লিখিত শর্তপূরণসমূহ পাশ কাটিয়ে সহকারী পরিচালক মঞ্জুর হোসেনের একক স্বাক্ষরে ৬ দিনে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। অথচ চলতি দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো সহকারী পরিচালক কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন না নিয়ে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে স্ট্যাম্প সিল ব্যবহার করতে পারেন না। লাইসেন্স ইস্যুর মতো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ারও তার নেই।
দুর্নীতির শেকড় : স্বাস্থ্য অধিদফতরের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখায় একবার পোস্টিং পেলে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আর কোথাও যেতে চান না। লাইসেন্স কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ৩ জন কর্মচারী ওই শাখায় ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে কর্মরত ছিলেন। আরও অনেকে আছেন ১৫-১৬ বছর ধরে। কারণ এ শাখায় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গজিয়ে ওঠা নামসর্বস্ব হাসপাতাল ক্লিনিক থেকে মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা পান। তাছাড়া চিকিৎসা বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লোক দেখানো তদন্তের নামে মোটা অঙ্কের ঘুষ আদায় এ শাখার দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরনো রেওয়াজ। নতুন লাইসেন্স ইস্যু ছাড়াও সারা দেশের প্রায় ৫ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ৯ হাজার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সেবার মান, চিকিৎসা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও লাইসেন্স নবায়ন সংক্রান্ত কাজেও মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেন হয়।
অভিযুক্তদের বক্তব্য : অভিযোগের বিষয়ে সহকারী পরিচালক মঞ্জুর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বিধি মোতাবেক লাইসেন্স ইস্যু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। তাহলে শাস্তিমূলক পোস্টিংয়ের শিকার হলেন কেন এমন প্রশ্নে মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘আছে কিছু দাফতরিক বিষয়। তবে আমি অন্যায় কিছু করিনি।’
অভিযুক্ত ৩ জন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরদের একজন কামরুল হাসান। তিনি ১৩ বছর ধরে হাসপাতাল শাখায় কর্মরত। অভিযোগ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘পরিচালক স্যার ৬ দিনের ছুটিতে ছিলেন। এ সময় পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন সহকারী পরিচালক। তিনি আমাদেরকে যেসব ফাইলে নোট দিয়ে উপস্থাপন করতে বলেছেন আমরা সেগুলো উপস্থাপন করেছি।’
অফিস সহকারী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘লাইসেন্স ইস্যু প্রক্রিয়াটি উচ্চপর্যায় থেকে করা হয়। তারা শুধু ফাইলে নথি উপস্থাপন করেন। তাই এ ঘটনায় তাদের ওপর দায় চাপানো সম্পূর্ণ অন্যায়’। আরেক অফিস সহকারী আতাউর রহমান খান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা নিচের সারির কর্মচারী। এডি স্যার যখন যে ফাইলে নোট দিয়ে নিয়ে যেতে বলেছেন তখন সেটা তার টেবিলে নিয়ে গেছি। আমরা কি লাইসেন্স ইস্যুর ক্ষমতা রাখি?’
সূত্র বলছে, লাইসেন্স কেলেঙ্কারির ঘটনায় এই চারজন ছাড়া আরও অনেকে জড়িত থাকলেও তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। একজন সহকারী পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও আরও অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা পর্দার আড়ালেই রয়ে গেছে। এমনকি ঘটনার সঙ্গে ৫-৬ জন অফিস সহকারী জড়িত থাকলেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে মাত্র ৩ জন অফিস সহকারীকে তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। অফিস সহকারী ক্যাজেলা চাকমা ও সাইদুর রহমান ৭৭টি লাইসেন্স দেয়ার সময় একাধিক ফাইল উপস্থাপন করলেও রহস্যজনক কারণে বেমালুম তাদের নাম চেপে গেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা।