ওয়াসা যখন অনিয়মের আখড়া, মূল বেতন ২৭ কোটি হলেও ওভারটাইম নিচ্ছে ৫৬ কোটি টাকা

0
1059

অপরাধ বিচিত্রা ঃ
ঢাকা ওয়াসার ২৫৫০ জন কর্মচারী গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মূল বেতন নিয়েছেন প্রায় ২৭ কোটি টাকা। অথচ অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এ সময়ে তারা ওভারটাইমই (ওটি) নিয়েছেন প্রায় ৫৬ কোটি টাকা। সাধারণত শ্রম আইনানুযায়ী ওভারটাইম কখনোই মূল বেতনের বেশি হতে পারবে না। কিন্তু এক্ষেত্রে সেই নিয়ম ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়েছে প্রতিষ্ঠানটির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। ১৯৭০ সালের একটি বিশেষ চুক্তির ওপর ভর করে দীর্ঘদিন কর্মচারীদের ওই ওভারটাইম দিয়ে আসছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। যদিও সামান্য চুক্তির অজুহাতে ওয়াসায় মানা হয়নি অনেক নিয়মনীতি। এমন অনেক অভিযোগের সত্যতা মিলেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি। যার তদন্ত রিপোর্ট বিডি মর্নিংয়ের কাছে রয়েছে। নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী ২৫৫০ জন কর্মচারীদের দেওয়া ওভারটাইম বাবদ সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব গচ্ছা দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র। নিজেদের পদ ঠিক রাখতে দেওয়া হচ্ছে ওই বাড়তি অর্থ। যার পিছনে রয়েছে শক্তিশালী এক সিন্ডিকেট। তবে ক্ষুদ্ধ শতাধিক কর্মকর্তা যারা ওই ওভারটাইমের টাকা পান না। তাদের অভিযোগ ১৯৭০ সালে ওয়াসাকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ওই সাময়িক ওই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে এর গুরুত্ব থাকা উচিত নয়। ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ৬ অক্টোবর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন একই বিভাগে যুগ্ম সচিব মাসুদ আহমদ ও মুহাম্মদ ইকবাল হুসাইন। যাদের রিপোর্টে মিলেছে অনেক অভিযোগের সত্যতা। তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায়, ১৯৭০ সালে সংস্থার কাজের স্বার্থে দ্বিগুণ হারে ওভার টাইম দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু অনেক কর্মচারীকে তিনগুণ বা তার অধিক হারে ওভারটাইম দেওয়া হয়েছে। যা ওই শ্রম আইন তো বটেই, ওই চুক্তিও ভঙ্গ করা হয়েছে। তা ছাড়া ২১৫তম বোর্ড সভায় দ্বিগুণ হারে ওভার টাইম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হলেও তা আজও কাযকর হয়নি। তাই এ মুহূর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের গোচরে এনে সরকারি অনুমোদন নেওয়ার জন্য প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি রিপোর্টে আরো বলা হয়, ১৯৭০ সালের চুক্তি অনুসারে ঢাকা ওয়াসায় ২৫৫০ জন কর্মচারী ওভার টাইম ভাতা পান কিন্তু গাড়ি চালকদের জন্য ওই একই বিধান প্রযোজ্য নয়। তাদের জন্য ১৯৮০ সালের সরকারি আদেশানুযায়ী ২৫০ ঘণ্টা ওভারটাইমের বিধান থাকা সত্ত্বেও তা মানেনি ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ঢাকা ওয়াসায় শ্রম আইনও মানা হয় না বলে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বেশ কিছু মতামত দেওয়া হয়েছে ঢাকা ওয়াসার ওভার টাইম পাওয়ার যোগ্য ২৫৫০ জন কর্মচারী মোট ৫৫ কোটি ৯৫ লাখ ২৭ হাজার ৫০৬ টাকা ওভার টাইম ভাতা দিনেছেন। অথচ ২০১৬ সালে শিক্ষানবিশ পাম্প অপারেটরের মধ্যে অন্তত ৭ জন মূল বেতনের ২.৫ গুণ থেকে শুরু করে ৩.৩০ গুণ ওভার টাইম নিয়েছেন। এদের মধ্যে মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন মূল বেতনের, মোঃ রেজাউল করিম মূল বেতনের ও মোঃ সোরওয়ার্দী মূল বেতনের ৩.২২ গুণ নিয়েছেন। অন্যান্যরা ২.৫ গুণ থেকে ৩ শাহাবউদ্দিন আহমেদ মূল বেতনের ৩.৩০ গুণ ওভারটাইম নিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে শ্রম আইনের পাশাপাশি ওই চুক্তিরও বেশি অর্থ দেওয়া হয়েছে। মতামতে আরো বলা হয়, মানা হয়নি গাড়িচালকদের ওভার টাইম নেওয়ার বিধানাবলী কিংবা শ্রম আইন। তাই ঢাকা ওয়াসার বিধানাবলী যুগোপযোগী করে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করে সরকারি আদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়েনের উদ্যোগ নিতে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির কাছে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানসহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন, ঢাকা ওয়াসা একটি সেবামূলক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য নিরবচ্ছিন্ন সুপেয় পানি সরবরাহ ও পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। পানি সরবারহের ৭৩৬টি টি পানির পাম্প ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়। পাম্পগুলো পরিচালনার জন্য ওয়াসার পর্যাপ্ত পাম্প অপারেটর নেই। তাই পাম্প সার্বক্ষণিক চালু রাখার জন্য পাম্প অপারেটরদের অতিরিক্ত সময়ে কাজ করতে হয়। এ ছাড়া স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ ক্লিনারদের নির্ধারিত সময় ব্যতিরেকে সার্বক্ষণিকভাবে কার্যাদি সম্পাদন করতে হয়। এজন্য ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী জনস্বার্থে কাজ করতে হয় বিধায় ওভারটাইম প্রদান করা হয়ে থাকে। ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে তৎকালীন শ্রমিক ইউনিয়নের (সি.বি.এ) মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী কর্মচারীদের দ্বিগুণ হারে ওভারটাইম দেওয়ার ব্যবস্থা চালু আছে। এই সুবিধা বিগত ৪৬ বছর যাবৎ কর্মচারীগণ ভোগ করে আসছেন। ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসার প্রায় তিন হাজার কর্মচারীর মূল বেতন ছিল প্রায় ২৭ কোটি টাকা। অথচ এ সময়ে তারা ওভারটাইমই নিয়েছে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে ওই অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আসলে দুদক বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে স্থানীয় মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী একজন কর্মচারী সারা মাসে অফিস সময় ধরা হয় গড়ে ১৭৫ ঘণ্টা। এটা ধরেই তাঁদের ঘণ্টায় বেতন হিসাব করা হয়। সাধারণ কর্মচারীরা শ্রম আইন অনুযায়ী অতিরিক্ত কাজের জন্য মূল বেতনের দ্বিগুণ পান। তবে ১৯৮০ সালে সরকারি আদেশ অনুযায়ী ছুটির দিনসহ গাড়ি চালকদের মাসে সর্বোচ্চ আড়াই’শ ঘণ্টা ওভারটাইম দেওয়া যায়। তবে তা কখনোই মূল বেতনের বেশি হতে পারবে না। প্রভাবশালী গাড়ি চালকেরা এটা না মেনে দ্বিগুণ, তিন গুণ ওভারটাইম দাবি করেন ঢাকা ওয়াসা। অভিযোগ রয়েছে,অনেক গাড়ি চালক প্রকৃত শ্রমের অতিরিক্ত ওভারটাইম দাবি করেন। পাম্প-অপারেটররা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল কমর্ঘণ্টা আট ঘণ্টার চেয়ে ওভারটাইম দ্বিগুণও দেখান। ওয়াসার বেশির ভাগ পাম্প অপারেটরের মূল বেতন গত অর্থবছরে ছিল ৮ হাজার ৭০০ টাকা। কিন্তু তাঁরা ওভারটাইম পেয়েছেন দ্বিগুণেরও বেশি। নতুন বেতন কাঠামোর মূল বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ওভারটাইম বেড়েছে আরও অনেক বেশি। উদাহরণ হিসেবে অভিযোগে বলা হয়েছে, ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) গাড়ি চালক মাধব গোপাল মজুমদারের মূল বেতন বর্তমানে ২০ হাজার ৪২০ টাকা হলেও ২০১৬ সালের জুলাই মাসে তাঁর ওভারটাইম হয়েছে ৬১ হাজার ১৫ টাকা। তিনি ২৬০ ঘণ্টার ওভারটাইমের হিসাব দেন। পাম্প-অপারেটর কাজী মজিবুর রহমান ও রফিকুল ইসলামের মূল বেতন ১৮ হাজার ৮৬০ টাকা, ওভারটাইমও করেছেন ৩৬০ ঘণ্টা। ওভারটাইম বিল হচ্ছে ৭৮ হাজার ৩১ টাকা। চালক ও অপারেটরদের মধ্যে অনেকে কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সদস্য। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শিক্ষানবিশ পাম্প-অপারেটর হাবিবুল ইসলাম ও ওসমান গনির মূল বেতন ছিল প্রায় সাড়ে ৮ হাজার টাকা থেকে জুলাই/২০১৬ মাসে মূল বেতন হয়েছে ১৩ হাজার ৭৮ টাকা। ওভারটাইম বিল করেছেন যথাক্রমে ৪৩ হাজার ৭২ ও ৪৫ হাজার ৬০৬ টাকা। শিক্ষানবিশ পাম্প-অপারেটর মোঃ সোহরয়ার্দী, জাহাঙ্গীর হোসেন, রেজাউল করিম, শাহাবুদ্দীন ও আরিফুল আলমের মূল বেতন ১৩ হাজার ৭৮০ টাকা। কিন্তু সবার ওভারটাইম একই টাকার অঙ্কের ৪৪ হাজার ৩৩৯ টাকা ৪৩ পয়সা। সবাই ২৮০ ঘণ্টার ওভারটাইম দেখিয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

sixteen − thirteen =