জলাবদ্ধতা ও যানজটে রাজধানী প্রায় অচল

0
1459

অপরাধ বিটিত্রা রিপোর্ট কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটের জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নেয়ায় রাজধানীতে চলাচলরত যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক সব ধরনের যানবাহনই স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। এতে মঙ্গলবার সকাল থেকে গোটা নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। বাস-মিনিবাস, লেগুনা-অটোরিকশাসহ সব গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত গাড়ি বিভিন্ন পয়েন্টে ভয়াবহ যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা থাকায় দিনভর নগরবাসীকে চরম পরিবহন সংকটে পড়তে হয়েছে। এতে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষের রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে। বিশেষ করে স্কুলগামী খুঁদে শিক্ষার্থী ও তাদের সঙ্গীয় অভিভাবকরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন।
এদিকে ভাঙাচোরা সড়কের বড় খানাখন্দে পড়ে যানবাহন উল্টে গিয়ে নগরীর বিভিন্ন স্থানে বিপুলসংখ্যক ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। জলাবদ্ধ রাস্তায় অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়িসহ বিভিন্ন ছোট যানের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় যানজট আরও বেড়েছে। এতে নগরজীবনের ভোগান্তি আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

আবহাওয়া অধিদফতর সূত্র জানায়, আরও দু’দিন ভারি বৃষ্টি হবে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ২৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। হাতিয়ায় দেশের সর্বোচ্চ ২৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় লঘুচাপের সৃষ্টি হয়েছে, যা রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্বদিকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। লঘুচাপ বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত।
পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, বুধবার রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকাসহ বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। কোথাও কোথাও ভারি বৃষ্টিপাত এবং কোথাও কোথাও অতি ভারি বৃষ্টিও হতে পারে। এ সময় ঝড়ো হাওয়ার আশঙ্কায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৩ নাম্বার সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি সড়কেই এক-দেড় ফুট থেকে দুই-আড়াই ফুট পানি জমে আছে। আবার কোথাও কোথাও এর চেয়েও বেশি পানি জমেছে। এ সব সড়কে দিনভর শম্ভুক গতিতে যানবাহন চলাচল করেছে। কোনো কোনো সড়কের যানবাহন ২০/২৫ মিনিট একই জায়গায় স্থবির হয়ে থেকেছে।
ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের এডিসি পদমর্যদার একজন কর্মকর্তা জানান, প্রাণান্ত চেষ্টা করেও যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য ভাঙাচোরা সড়ক ও জলাবদ্ধতাকেই প্রধানভাবে দায়ী করে এই ট্রাফিক কর্মকর্তা বলেন, ‘যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলতে না পারলে যানজট হবেই। ট্রাফিক পুলিশ হাজারো চেষ্টা করেও তা সামাল দিতে পারবে না।’ নগরজীবনের এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বিশেষ কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে মঙ্গলবার সকাল থেকেই গুলশান-বনানী এলাকার অধিকাংশ সড়কেই ছিল যানজট। এ সময় ওই এলাকার বিপুলসংখ্যক কর্মজীবী মানুষকে বিভিন্ন গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত যানে উদ্বিগ্ন সময় পার করতে দেখা গেছে। বনানী-মতিঝিল রুটের বাসচালক জামান মিয়া জানান, বনানী থেকে পল্টন পেঁৗছতে তার আড়াই ঘণ্টা সময় লেগেছে। এ সময় অধৈর্য্য হয়ে যাত্রীদের অনেকে বাস থেকে নেমে হেঁটে কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পুরানা পল্টন, দৈনিক বাংলা, মতিঝিল, কাকরাইল ও মালিবাগ সড়কে ছিল তীব্র যানজট। এ সময় বিপুলসংখ্যক যাত্রীকে বাস থেকে নেমে ভিজে হেঁটে যেতে দেখা গেছে। আবার বাসের জন্যও অনেকে বিভিন্ন স্টপেজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছেন।
সকাল সাড়ে ৮টার আগ পর্যন্ত প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তা কিছুটা ফাঁকা থাকলেও ১০টার পরপরই সেখানে যানবাহনের দীর্ঘ সারি জমে ওঠে। হাইকোর্টের সামনে থেকে প্রেসক্লাব হয়ে পল্টন পেঁৗছতেই অনেক যানবাহনের এক থেকে সোয়া ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে বলে পরিবহন শ্রমিকরা দাবি করেছেন।
এদিকে মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা সড়ক মারাত্মকভাবে ভাঙাচোরা হওয়ায় দিনভর সেখানে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়। গণপরিবহন যাত্রীরা জানান, উত্তর বাড্ডা থেকে মালিবাগ মোড় পর্যন্ত পেঁৗছতে অধিকাংশ যানবাহনেরই দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লেগেছে। এ সড়কের বড় বড় খানাখন্দে অটোরিকশা, রিকশা ও ব্যক্তিগত যান উল্টে গিয়ে বিপুলসংখ্যক ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে বলেও খবর পাওয়া গেছে।
তীব্র যানজটে দুপুরের পর শেওড়াপাড়া, মিরপুর, পল্লবী, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, আসাদগেট ও কলাবাগান সড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে বলে জানান পরিবহন শ্রমিকরা। তাদের ভাষ্য, জলাবদ্ধতার কারণে বেশকিছু যানবাহন নির্ধারিত রুট ছেড়ে বিকল্প সড়কে চলাচল করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে ট্রাফিক পুলিশের দাবি, জলাবদ্ধতা ও রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা হওয়ায় সড়কে যানজট লেগেছে।
মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ভিকারুননিসা নূনের প্রভাতী শাখার শিক্ষার্থীদের স্কুল ছুটির পর বেইলি রোড, সার্কিট হাউস রোড ও মনোয়ারা হাসপাতালের গলি ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক হাজার ব্যক্তিগত গাড়ি, অটোরিকশা ও রিকশা ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে দেখা গেছে।
সার্কিট হাউস রোডে প্রায় হাঁটু সমান পানি হওয়ায় সেখানে বেশকিছু অটোরিকশার ইঞ্জিনে পানি ঢুকে তা বিকল হয়ে মাঝরাস্তায় পড়ে রয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।
এ সময় ছোট ছোট মেয়েদের নিয়ে স্কুল থেকে ফেরা বেশ ক’জন অভিভাবক এ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ছুটি ঘোষণা না করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের ওপর ক্ষোভ ঝেড়েছেন। মরিয়ম খাতুন নামের এক অভিভাবক জানান, মানিকনগর থেকে একশ’ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে তিনি মেয়েকে সকালে স্কুলে পেঁৗছে দিয়ে গেছেন। অথচ দুপুরে বৃষ্টি থাকায় দেড়শ’ টাকা ভাড়া যাচ্ছে। ছোট মেয়েকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে হবে এ আশঙ্কায় সে ভাড়া মেনে নিয়েই তিনি রিকশায় চড়েছেন। অথচ আধাঘণ্টায় তিনি মনোয়ারা হাসপাতালের গলি থেকে বের হতে পারেননি। এ ধরনের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় স্কুলে ছুটি ঘোষণা করলে লেখাপড়ার কি এমন ক্ষতি হবে বলে ক্ষুব্ধ স্বরে প্রশ্ন করেন তিনি।
এদিকে নগরজুড়ে তীব্র পরিবহনের সংকটের বিষয়টি যাত্রীদের পাশাপাশি গণপরিবহন শ্রমিকরাও নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। তারা জানান, যানজট ও জলাবদ্ধতার কারণে কোনো গাড়িই স্বাভাবিক সময়ের অর্ধেক ট্রিপ ভাড়া খাটতে পারেনি।
দুপুরে বৃষ্টিতে ভিজে কাকরাইল মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষারত মহিলা যাত্রী সুফিয়া খাতুন জানান, প্রায় ৪০ মিনিট ধরে তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। এ সময় ২/৩টি বাস আসলেও সেখানে অপেক্ষমান পুরুষ যাত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি বাসে উঠতে পারেননি। তাই অটোরিকশাতে পুরান ঢাকার বাবুবাজারের গন্তব্যে যেতে চাইছেন। কিন্তু কোনো অটোরিকশাই তিনশ’ টাকার নিচে সেখানে যেতে রাজি হচ্ছে না। অথচ স্বাভাবিক সময়ে এ রাস্তাটুকু যেতে সর্বোচ্চ দু’শ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে বলে জানান সুফিয়া।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

fourteen + fourteen =