‘জিডি করার সাধ মিটাইয়া দিলাম’

0
1242

আবুল বাসিত খান ওরফে বাচ্চু। রাজধানীর মুগদা থানার ৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর। এলাকায় নানা কারণেই আলোচিত-সমালোচিত এই জনপ্রতিনিধি। গত দু’দিন ধরে আবারো এলাকায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি। এবার তার বিরুদ্ধে
অভিযোগ এক নারীকে ধর্ষণের। কাউন্সিল অফিসেই ধর্ষণ করেছেন ওই নারীকে। ধর্ষণ শেষে গালাগালি করেছেন। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন ‘আমার বিরুদ্ধে জিডি করার সাধ মিটাইয়া দিলাম’। বৃহস্পতিবার রাতে মুগদা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় তিনি এসব কথা উল্লেখ করেছেন। মামলায় আবদুল বাসিত খান বাচ্চু ছাড়াও ধর্ষণে সহযোগিতার দায়ে স্বপ্না নামে এক নারীকে আসামি করা হয়েছে। নির্যাতিতা নারী অভিযোগ করেন, মামলা করার পর থেকেই তা তুলে নিতে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন তার সহযোগীরা। তিনি বলেন, এর আগেও কাউন্সিলর বাচ্চু তাকে ফোনে শারীরিক সম্পর্ক করার প্রস্তাব দিতো। সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে হত্যার হুমকিও দিতো। এসবের কল রেকর্ডিংও তার কাছে আছে বলে তিনি দাবি করেন। মামলায় ধর্ষণের শিকার নারী উল্লেখ করেন, মঙ্গলবার বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটে কাউন্সিলর বাচ্চু সালিশের কথা জানিয়ে তাকে ফোন দেয়। এ কথা তার স্বামীকে জানালে তিনি সাবধান করে দেন। পরে সন্ধ্যা ৬টার দিকে স্বপ্না এসে জানায় কাউন্সিলর তাকে রাত ৮টার দিকে অফিসে যেতে বলেছে, না গেলে তার ক্ষতি হবে বলে। এরপর সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে বাচ্চু তাকে আবারো ফোন করে অফিসে গিয়ে দেখা করতে বলে। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, কমিশনার ইতিপূর্বে অফিসে বসে এবং ফোনে কুপ্রস্তাব দেয়। যার কারণে তিনি সেখানে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু সালিশ বৈঠকে না বসলে ক্ষতি হবে চিন্তা করে তার স্বামী তাকে কমিশনার অফিসে সালিশ বৈঠকে যেতে বলেন। পরে রাত ৮টার দিকে তিনি কাউন্সিলর অফিসে যান। গিয়ে দেখেন, কমিশনারের দু’একজন নিজস্ব লোক এবং স্বপ্না ছাড়া সেখানে আর কেউ ছিলো না। এ সময় অন্য লোকজন নেই কেন জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দেন আর কারো দরকার নেই, তুমি আমার কথায় রাজি হও, তোমার কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। এই বলেই বাচ্চু রুমের দরজা বন্ধ করে তাকে জড়িয়ে ধরে। এ সময় তিনি চিৎকার করার চেষ্টা করলে মুখ চেপে ধরে মেঝেতে ফেলে দেয়। ওড়না দিয়ে মুখ বেঁধে ফেলে। ধর্ষণের পর কমিশনার তাকে গালাগালি করে বলে, আমার বিরুদ্ধে জিডি করার সাধ মিটাইয়া দিলাম। মামলায় আরো উল্লেখ করা হয়, নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে অনেক কষ্টে বাসায় যান তিনি। এ ঘটনা তার স্বামী ও এলাকার কয়েকজনকে জানানোর পর তারা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ওসিসিতে চিকিৎসা দেয়ার পর তারা ছাড়পত্র দিয়ে মামলা দায়েরের পরামর্শ দেন।
গতকাল নির্যাতিতা এই নারীর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তিনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। কথা বলতে গিয়ে শিহরে ওঠেন। বলেন, আজ কয়দিন ধরে ঘুমাতে পারছি না। বাচ্চু কমিশনারের নির্যাতনের কথা মনে হলেই সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। জীবনে এমন অবস্থার মুখোমুখি হবো ভাবতেও পারিনি। তিনি বলেন, এই এলাকায় ২৫ বছর ধরে আছি। আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। এলাকায় চলাফেরা করায় আমার জন্য মুশকিল হয়ে পড়েছে। নির্যাতিতা এই নারী বলেন, কয়েকমাস আগে তার বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলো স্বপ্না। ভাড়া নেয়ার সময় তার স্বামীও আসেন। কিছুদিন পরে তিনি বিদেশ চলে যান। কিন্তু শুরু থেকেই ঠিকমতো ভাড়া দিতো না স্বপ্না। প্রথমদিকে ভেবেছিলাম সমস্যা আছে তাই ভাড়ার জন্য খুব বেশি চাপ দেয়নি। সাত রং নামে একটি বিউটি পার্লার চালাতো সে। পরে জানতে পারি বিভিন্ন লোক আসে তার বাসায়। অসামাজিক কার্যকলাপ হয়। এ বিষয়টি এলাকায় লোকমুখে ছড়িয়ে পড়লে তিনি স্বপ্নাকে বাসা ছাড়তে বলেন। তিনি আরো বলেন, একদিন হঠাৎ তার বাসায় ঢুকি। ওইদিন তার চাচাতো ভাই পরিচয় দেয়া এক ব্যক্তিকে অপরিচিত এক মেয়ের সঙ্গে হাতেনাতে আপত্তিকর অবস্থায় ধরেছিলাম। তখন তারা হাতে পায়ে ধরে কাউকে না জানাতে বলে। এরপর থেকেই তাকে বাসা ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকলে সে বাচ্চু কমিশনারকে হাত করে। স্বপ্না উল্টো তার কাছ থেকে বাড়িওয়ালা ৫ লাখ টাকা ধার নিয়েছেন বলে ওই টাকা দাবি করেন। তার বিরুদ্ধে মামলাও করে। এ নিয়ে স্বপ্না ও তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিলো। এই সুযোগ নিয়ে কমিশনার তাকে কুপ্রস্তাব দেয়। তার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় নানা হুমকি দিতো। এমনকি আমার শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে ফোন করে এসব বাজে প্রস্তাব দিতো। বলতো শারীরিক সম্পর্ক না করলে বাসায় ঢুকে মেরে ফেলবো। এই নিয়ে সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় থাকতাম। তিনি বলেন, তার সব কথার কল রেকর্ড রয়েছে। এসব ঘটনা স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীকেও জানিয়েছিলেন। ইতিপূর্বে তিনি বাচ্চু কমিশনারের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। কয়েক মাসের ব্যবধানে তার শ্বশুর-শাশুড়ি মারা যাওয়ার জন্য এই মানসিক চাপকেও দায়ী করেন তিনি।
ওই নারী আরো অভিযোগ করেন, নির্যাতনের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরলে এক ব্যক্তি সাংবাদিক পরিচয়ে তার বাসায় আসেন। একই সময়ে বাসা ভাড়া নেয়ার নাম করে আরো একজন ঢুকে। তাদেরকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখে ভেতরে গেলে সাংবাদিক পরিচয় দেয়া ব্যক্তিটি অন্য একটি রুমে প্রবেশ করে। পরে জিজ্ঞেস করলে বলে- ফোনে কথা বলতে গিয়েছিল। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার মামলা করতে যাওয়ার আগে পূর্বে করা জিডির কপি নিতে গেলে দেখি সেগুলো নেই। এছাড়া আরো কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। তার ধারণা, ওই দুই ব্যক্তি সেগুলো নিয়ে গেছে।
অভিযোগকারী বলেন, ঘটনার এবং মামলার পর থেকে তাকে নানাভাবে হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে মামলা তুলে নিতে। এমনকি বাচ্চু এমন লোকদের আমার কাছে পাঠাচ্ছে যাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো। তারাও নানা কারণে বাচ্চু কমিশনারের কাছে জিম্মি। ফলে মামলা তুলে নিতে এখন তাদেরকে ব্যবহার করছে। এছাড়া মামলা করতে থানায় যাওয়ার ৫-৭ মিনিটের মধ্যে সেও সেখানে উপস্থিত হয়। অভিযোগকারী ন্যায়বিচার দাবি করে বলেন, আমি চাই না, আমার মতো আর কেউ এমন ঘটনার শিকার হোক। এলাকাবাসীর কয়েকজন জানান, কমিশনার লোকজনের মধ্যে ঝামেলা তৈরি করিয়ে সেখান থেকে সুবিধা আদায় করেন।
এদিকে নারীকে ধর্ষণের ব্যাপারে মঙ্গলবার ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল বাসিত খান বাচ্চুর সঙ্গে কথা হলে বলেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। রাজনৈতিক কারণে একটি মহল তার বিরুদ্ধে এসব করাচ্ছে। ইতিপূর্বেও তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 × 3 =