দুর্নীতির বিরুদ্ধে ডিসিদের কঠোর হতে বললেন প্রধানমন্ত্রী

0
1493

জনকল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন * গৃহহীনদের তালিকা তৈরি করুন * গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতাই দেশকে উন্নত করতে পারে

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘এই করাপশনকে যে করেই হোক দূর করতে হবে। কোনো কাজে করাপশন হলে উন্নয়নের ছোঁয়া গ্রামবাংলায় লাগবে না। এ জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে নিজেদেরও কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার তার কার্যালয়ে তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধনকালে এ কথা বলেন। ডিসিদের জন্য তিনি এদিন ২৩ দফা নির্দেশনা দেন। জনকল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মানুষের জন্য কাজ করার নির্দেশ দেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা যে সিদ্ধান্তই নেই, সেটা মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের দায়িত্ব আপনাদের ওপরই বর্তায়। আপনাদের আন্তরিকতা, কর্মদক্ষতা, যোগ্যতাই পারে এ দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান পাল্টে দিতে। কাজেই আপনারা সেভাবেই কাজ করবেন।’
দুর্নীতি উচ্ছেদ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ১২২ ভাগ বেতন বৃদ্ধি করেছি, যাতে যারা দেশের জন্য কাজ করবেন তারা যেন মানুষের জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে পারেন। মানুষের ভাগ্য গড়া- এটাই যেন সবার লক্ষ্য হয়। প্রধানমন্ত্রী এ সময় জাতির জনকের ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘এই বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষক করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা তাদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি।’ যে করেই হোক এ দুর্নীতিকে দূর করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, তার ঘোষিত ডিজিটালাইজেশন বাস্তবায়নের ফলে করাপশন নিয়ন্ত্রণে আসছে ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হচ্ছে। এখন আর টেন্ডারের বাক্স ছিনতাইয়ের খবর খুব একটা শোনা যায় না। জিজিটাইজেশনের সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই দেশকে এগিয়ে নিতে এবং আমরা বিশ্বাস করি গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতাই একটি দেশকে উন্নত করতে পারে, সেই অভিজ্ঞতা আমরা ইতিমধ্যে অর্জন করেছি। ’৭৫ থেকে ’৯৬-এ দেশের মানুষ শুধু বঞ্চনারই শিকার হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার যে জনগণের সেবক সেটা তখনই মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে, যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। তিনি বলেন, এই ৮ বছরে বাংলাদেশের যে উন্নয়নের ধারাটা সূচিত হয়েছে, তাতে আজ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ একটা মর্যাদা পেয়েছে। দেশ স্বাধীন না হলে এটা কোনোদিনও হতো না।
অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক। আরও বক্তব্য দেন মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহম্মদ শফিউল আলম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। জেলা প্রশাসকদের পক্ষে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক বেগম উন্মে সালমা তানজিয়া, চাঁদপুরের আবদুস সবুর মণ্ডল এবং যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিন এবং ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহ উদ্দিন বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট বাস্তবায়ন সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, ২০১২ সাল থেকে গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি আলাদা শাখা খোলা হয়েছে। এই ইউনিটের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবন করে সরকারি সেবা প্রদান পদ্ধতি সহজ করা। পাশাপাশি সরকারি কাজের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, আপনাদের মনে রাখতে হবে, বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ফলে একদিকে মানুষের আচরণ এবং রুচিতে যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনাসহ সবকিছু বদলে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সব মন্ত্রণালয়ে ডিজিটাল নথি নম্বর ও ই-ফাইলিং চালু, সব দফতরে দ্বিতীয় প্রজন্মের সিটিজেন চার্টার প্রবর্তন এবং এর আওতায় মাঠপর্যায়ের অফিসসমূহে হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে এবং প্রত্যেক মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ১৯৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত ডন পত্রিকার তথ্য উপস্থাপন করে পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী জাতি, বঞ্চনার এ ইতিহাস ভুললে চলবে না। বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে সব সময় মাথা উঁচু করে যেন চলতে পারি আপনারা সেভাবে কাজ করবেন এবং আমরা বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতাই একটি দেশকে উন্নত করতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের তথাকথিত অভিযোগ এবং কানাডার আদালতে তা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের যে সামর্থ্য আছে তা আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে প্রমাণ করছি, যা বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। এখন বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল বলা হয়। আপনাদের (জেলা প্রশাসক) কর্মপ্রয়াসের ফলে এই সুখ্যাতি অর্জন সম্ভব হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে বলেন, আমি আপনাদের যে নির্দেশনা দিচ্ছি তা আপনারা অধীনস্থদের কাছেও পৌঁছে দেবেন যে, আমরা দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই এবং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমরা এটা পারব। আমরা বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে চাই এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হবে ইনশাআল্লাহ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করতে হবে যে, বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশ। এখানে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না, থাকবে না কেউ অভুক্ত। প্রত্যেকের দোরগোড়ায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছবে। কেউ নিরক্ষর থাকবে না। সংবিধানে বর্ণিত জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো আমাদের পূরণ হবে। শেখ হাসিনা সব জেলায় গৃহহীনদের তালিকা তৈরি করতে ডিসিদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘খাসজমির বিষয়ে খোঁজ নিন। আমাদের সরকার সবাইকে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে দেবে। ২ লাখ ৮০ হাজার গৃহহীনের আবাসনের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করছে।’ প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের বলেন, ‘আপনারা গুচ্ছগ্রাম, আদর্শ গ্রাম ও এ ধরনের প্রকল্প থেকে গৃহহীনদের আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারেন।’
পরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন ৬৪ ডিসি এবং ৬ বিভাগীয় কমিশনার। সরকারের নীতিনির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে ৪ বছর আগে এ ধরনের সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে চতুর্থ ডিসি সম্মেলন।

 

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

sixteen − six =