ধর্ষণের সত্যতা মিলেছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে

0
1318

সাফাত ৬ ও সাদমান ৫ দিনের রিমান্ডে * আদালতে দুই তরুণীর জবানবন্দি * বনানী থানা পুলিশের গাফিলতি খুঁজতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি * ডিএনএ পরীক্ষায় এক তরুণীর সালোয়ার কামিজ

‘তাদের ভাবটা এমন, যেন কিছুই হয়নি। কোনো অনুশোচনা নেই, এমনকি তাদের মধ্যে নেই কোনো ন্যূনতম অপরাধবোধও। তাদের কাছে নাকি এটি সাধারণ ঘটনা। প্রায় সময়ই অনেক তরুণীর সঙ্গেই এমন ঘটনা ঘটে। জোর করে সরলমনা বিভিন্ন তরুণীকে নানাভাবে ফুসলিয়ে তারা গুলশান-বনানীর বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে নিয়ে ধর্ষণ করে।’

বনানীর দি রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণ মামলায় গ্রেফতার হওয়া দুই আসামি সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফের বিষয়ে এমনই তথ্য দিয়েছেন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা। সাফাত আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ এবং সাদমান হচ্ছেন রেগনাম রেহনাম সেন্টারের মালিক মো. হোসেন জনীর ছেলে। বৃহস্পতিবার সিলেট থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের ঢাকায় আনা হয়েছে।
গ্রেফতারের পরদিন শুক্রবার আদালতের মাধ্যমে সাফাতকে ৬ দিনের এবং সাদমানকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। এদিকে দুই তরুণকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে বলে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন। ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি নাঈম আশরাফ ওরফে হালিম, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ এখনও পলাতক। এর আগে বৃহস্পতিবার ধর্ষণের শিকার দুই তরুণীর জবানবন্দি নিয়েছেন আদালত।
ঘটনাটি স্পর্শকাতর হওয়ায় বৃহস্পতিবার চার সদস্যের একটি তদন্ত সহায়ক কমিটি গঠন করেছে ডিএমপি। এ কমিটির প্রধান করা হয়েছে ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায়কে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি-উত্তর) ডিসি শেখ নাজমুল আলম, গুলশান বিভাগের ডিসি মোস্তাক আহমেদ এবং উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের ডিসি ফরিদা ইয়াসমিন।
ধর্ষিত দুই তরুণীর মামলা নিতে বনানী থানা গড়িমসি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ধর্ষিত দুই তরুণীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে বনানী থানা পুলিশের বিরুদ্ধে। এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে ডিএমপি তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলে সাংবাদিকদের জানান ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায়। এ কমিটিকে ৩ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
আদালত সূত্র জানায়, শুক্রবার দুপুরে দুই আসামিকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম মো. রায়হান-উল-ইসলাম আসামি সাফাতের ৬ দিনের এবং সাদমানের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গ্রেফতারের পর পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সময় দুই আসামি স্বাভাবিক থাকলেও আদালতে তারা অঝোরে কেঁদেছে। বেলা ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে আসামিদের কাঠগড়ায় তোলা হয়। আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রায় ১০ মিনিট সাফাত ও সাদমান অঝোরে কান্না করে। আসামিদের শুভাকাক্সক্ষীরা তাদের শান্ত রাখার চেষ্টা করেন।
এ বিষয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আদালতের সহানুভূতি পাওয়ার আশায় সেখানে তারা কান্না করেছে বলে মনে হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের মধ্যে কোনো অপরাধবোধ কাজ করছে বলে মনে হয়নি। আসামিরা দুই তরুণী ছাড়া আরও অনেক তরুণীকে জোর করে বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে নিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে রিমান্ড আবেদনে পুলিশ বলেছে, আসামিরা খারাপ চরিত্রের। মামলার রহস্য উদ্ঘাটনসহ এজাহারনামীয় আসামিদের নাম ও ঠিকানা সংগ্রহে তাদের রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন।
ধর্ষণ মামলার দুই আসামিকে গ্রেফতারের পর শুক্রবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, বনানীর ঘটনাটি নিয়ে সারা দেশের মানুষের মধ্যে সংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে। মামলার পর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। বাদীর আগ্রহে ডিএমপির বিশেষায়িত বিভাগ উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশনকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ তদন্ত নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সত্যতা মিলেছে দাবি করে কৃষ্ণপদ রায় বলেন, দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে এখনও বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি।
মামলা বিলম্বে হলেও তদন্তে প্রভাব পড়বে না জানিয়ে যুগ্ম-কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, এ মামলাটি অনেক বিলম্বে হয়েছে। আলামত সংগ্রহে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মামলা তদন্তে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। মামলা বিলম্বে হলেও তদন্তে এর প্রভাব পড়বে না।
তিনি বলেন, মামলার পারিপার্শ্বিক তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। শারীরিক যে আলামত রয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে যেসব আলামত ফরেনসিক পরীক্ষার প্রয়োজন তা সংগ্রহ করা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি কোনো আলামত যেন নষ্ট না হয়। তাছাড়া ঘটনার সময় এবং মামলার সময়ে যে গ্যাপ রয়েছে তা নিরসনে সমন্বিতভাবে কাজ চলছে। আমরা আশাবাদী তদন্তের একটি যৌক্তিক পরিণতি হবে।
বনানী থানা পুলিশের গাফিলতি তদন্তে কমিটি গঠন : বনানী থানার পুলিশের গাফিলতি তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপারেশন অ্যান্ড ক্রাইম) মিজানুর রহমান। অন্য সদস্যরা হলেন যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায়, ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন।
এ বিষয়ে কমিটির সদস্য কৃষ্ণপদ রায় বলেন, বনানী থানার কার্যক্রম নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, সেটি ডিএমপি কমিশনার মহোদয় গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। বিভ্রান্তি নিরসনের পাশাপাশি কারও গাফিলতি বা দায়িত্বে অবহেলা ছিল কিনা, কেউ অপেশাদার আচরণ করেছে কিনা এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। এজন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পুলিশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে মামলার তদন্ত করছে : সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, আসামিরা প্রভাবশালী। এ কারণে এটা হচ্ছে না, সেটা হচ্ছে না। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই পুলিশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে অনেক ঘটনা উন্মোচন করেছে। এ সময় তিনি একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা কিন্তু আসামিকে গ্রেফতার করেছি। এই মামলার ক্ষেত্রেও সব অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে ওঠে পেশাদারিত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে।
৫ মে ঢাকা ছাড়ে চার আসামি : ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদ, তার গাড়িচালক বিল্লাল, দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ এবং ধর্ষণে সহায়তাকারী সাদমান সাকিফ ৫ মে ঢাকা ছাড়ে বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানিয়েছেন। মামলার অন্যতম আসামি নাঈম আশরাফ ওরফে হালিম তাদের সঙ্গে যাননি। এদিকে ৯ মে সাফাত আহমেদ বাসায় ছিলেন- গণমাধ্যমে এমন বক্তব্য দিয়েছেন তার বাবা দিলদার আহমেদ। এ বিষয়ে ওই কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, তিনি মিথ্যা বলেছেন। পুলিশ তাদের কিছু করতে পারবে না এমন মনোভাব থেকেই হয়তো তিনি এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।
ডিসি পদমর্যাদার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ওই তরুণী ৪ মে বনানী থানায় অভিযোগ দেন। বিষয়টি জানাজানি হলেই সাফাতসহ চারজন প্রাইভেটকার নিয়ে ঢাকা ছাড়ে। প্রথমে তারা গাজীপুরে যায়। পরে নরসিংদীতেও তারা অবস্থান করে। ৮ মে বিকালে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার একটি রিসোর্টে যান তারা। সেখানে উঠতে না পেরে তারা জালালাবাদ এলাকায় এক লন্ডনপ্রবাসীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ওই বাড়ি থেকেই তারা গ্রেফতার হন।
সাফাতের পারিবারিক বাড়ি সিলেটে। সিলেটে এসে সাফাত তার এক মামার সাহায্য চান। মামা তার এক লন্ডনপ্রবাসী বাড়িতে সাফাত ও সাদমানের থাকার ব্যবস্থা করেন। ওই বাড়ি থেকেই বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখার একটি বিশেষ দল।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সাফাত ও সাদমান তাদের মোবাইলফোনসহ অন্যান্য ডিভাইস বন্ধ করে রেখেছিল। তবে সিলেটে থাকা সাফাতের এক মামার মোবাইলে দুজনের ফোনালাপের প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই মামাকে ধরার পরই সাফাত ও সাদমানের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। সাফাতের মামা পুলিশের কাছে দাবি করেন, প্রথমে তিনি তাদের আশ্রয় দিতে রাজি হননি। অনেক অনুরোধের পর তিনি বন্ধুর বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিতে রাজি হন।
ধর্ষিত দুই তরুণীর জবানবন্দি : বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর হাকিম নূরন্নাহার ইয়াসমিনের আদালতে ধর্ষণের শিকার দুই ছাত্রী জবানবন্দি দেন। এ ছাড়া একই দিন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের শিকার এক তরুণীর সালোয়ার-কামিজ ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছেন ঢাকা মহানগর হাকিম দেলোয়ার হোসেন।
ধর্ষণের শিকার দুই ছাত্রী ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন আদালতে। জবানবন্দিতে দুই ছাত্রী জানান, গত ২৮ মার্চ ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তাদের সঙ্গে শাহরিয়ার নামের এক বন্ধু ছিলেন। দুই তরুণীকে বলা হয়েছিল, অনুষ্ঠানটি হবে অনেক বড় এবং এখানে অনেক লোকজন থাকবে। হোটেলে যাওয়ার পর সাফাত ও নাঈমের সঙ্গে তারা আরও দুই তরুণীকে দেখতে পান। তবে সেখানে অবস্থান করা লোকজনদের ভদ্র বলে মনে হয়নি তাদের কাছে। অনুষ্ঠানের পরিবেশ ভালো না লাগায় ওই দুই তরুণী ও শাহরিয়ার চলে আসতে চাইলে আসামিরা শাহরিয়ারের কাছ থেকে গাড়ির চাবি ছিনিয়ে নেন এবং শাহরিয়ারকে মারধর করেন। এরপর ওই দুই তরুণীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হোটেলের এক রুমে নিয়ে যান। সাফাত মামলার বাদীকে ধর্ষণের সময় তার গাড়িচালককে ভিডিওচিত্র ধারণ করতে বলেন। অপর দিকে মামলার বাদীর বান্ধবীকে নাঈম আশরাফ ধর্ষণ করেন। এ ঘটনা কাউকে জানালে আসামিরা ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন। আসামিদের কথামতো না চললে ওই দুই তরুণীকে মেরে ফেলা হবে বলেও হুমকি দেয়া হয়। এরপর আসামি সাফাত তার দেহরক্ষীকে দিয়ে ওই দুই তরুণীর বাসায় পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন। এতে ওই দুই তরুণী আরও ভয় পেয়ে যান।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 × three =