ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন কালাইয়ের কিডনি বিক্রেতারা

1
578

সংবাদদাতা ‘ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে এবং অর্থের মোহে পড়ে দুই লাখ টাকার বিনিময়ে সাত বছর আগে আমি আমার শরীরের মূল্যবান অঙ্গ কিডনি বিক্রি করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের কর্মক্ষমতাকেও বিক্রি করেছি। এখন আমি আর কোনো কাজ-কর্ম করতে পারি না। নিজেকে বড় অসহায় আর অপরাধী মনে হয়। আমি যে ভুল করেছি, এমন ভুল যেন আর কেউ না করে।’ কথাগুলো বলছিলেন জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ভেরেন্ডি গ্রামের কিডনি বিক্রেতা মেহেরুল ইসলাম। তিনি আরও বলেন, আমি ভালো নেই। ভারী কোনো কাজ করলে, হাঁটাচলা করলে সারা শরীরে ব্যথা হয়। মাঝেমধ্যেই জ্বর হয়, প্রস্রাবে জ্বালা যন্ত্রণা হয়, হয় শাসকষ্টও।’ কেবল মেহেরুলই নয়- একই ধরনের কথা বলেন, উপজেলার বোড়াই গ্রামের কিডনি বিক্রেতা জোসনা বেগম ও আইনুল, ভেরেন্ডির আক্তার, বাগইলের মিজানসহ অনেকেই।
অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার কয়েকটি গ্রামের কিডনি বিক্রেতারা বর্তমানে ভালো নেই। ঋণের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে যে মানুষগুলো একটু উন্নত জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখেছিল, তারা এখন রোগ শোকে কর্মশক্তি হারিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। ৫ থেকে ৭ বছর আগে কিডনি দেয়া এ মানুষগুলো এখন নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছেন। এদের কোমরে ব্যথা হয়, মাঝেমধ্যেই জ্বর, হয় প্রস্রাবে জ্বালা যন্ত্রণা। একটু হাঁটাচলা করলেই শাসকষ্ট দেখা দেয়। ভারী কাজ একেবারেই করতে পারছেন না তারা। এছাড়া সমাজে কিডনি বিক্রি করা মানুষ হিসেবে হেয় হচ্ছেন।

কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়নের ভেরেন্ডি গ্রামের পাড়ার মধ্যে ছোট্ট একটি পান, সিগারেটের দোকানে কথা হলো আকতার আলমের সঙ্গে। তিনি ২০০৯ সালে দালালের খপ্পরে পড়ে কিডনি বিক্রি করেছিলেন। চার লাখ টাকা কিডনির দাম ঠিকঠাক হলেও প্রতারণার শিকার হয়ে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। এ দিয়ে ৫টি এনজিও ঋণের আসল টাকা পরিশোধ করেছেন। এখনো গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি টানছেন। এখন পাড়ার ছেলেরা ছোট একটি দোকান করে দিয়েছে তাকে। এদিয়ে দুমুঠো খেয়ে দুই সন্তান নিয়ে অভাবের মধ্যে দিন কাটছে তার। তার জীবনের ভুল কাজের অনুশোচনা করে তিনি বলেন, আগে মানুষের বাড়িতে কাজ করে, কখনো ভ্যান চালিয়ে, রোজগার করতেন। দিনে ১০০ টাকা পেলেও শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন। আর এখন অন্যরা দিনে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার কাজ করলেও চোখের দেখা ছাড়া করার কিছুই নেই। তিনি আর কাজ করতে পারছেন না। এছাড়া ওষুধ কিনতে হচ্ছে প্রতি মাসেই। এছাড়া পাশের রোড়াই গ্রামের আইনুল, জোসনা সবাই জানালেন তাদের অসুস্থতার কথা।
২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের ১২০ জন মানুষ কিডনি বিক্রি করেছিল। এরপর আর সঠিক পরিসংখ্যান নেই উপজেলা প্রশাসন এবং সিভিল সার্জনের কাছে। তবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, কিডনি বিক্রি এখনো থেমে নেই। স্থানীয় সাংবাদিক এবং জনপ্রতিনিধিদের মতে কিডনি বিক্রির সংখ্যা তিন শতাধিক।
মাত্রাই ইউনিয়নের ভেরেন্ডি, উলিপুর, সাতার, কুসুমসাড়া, অনিহার, পাইকশ্বর ও ইন্দাহার, উদয়পুর ইউনিয়নের বহুতি, জয়পুর বহুতি, নওয়ানা, নওয়ানা বহুতি, দুর্গাপুুর, উত্তর তেলিহারা, তেলিহারা, ভুষা, কাশীপুর, বিনাই ও পুর্বর্কৃষ্টপুর এবং আহমেদাবাদ ইউনিয়নের রাঘবপুর ও বোড়াই গ্রামের লোকজন বেশি কিডনি বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া নতুন করে আশপাশের অনেকে কিডনি বিক্রি করেছেন বলে জানা গেছে।
কালাই পৌরসভার মেয়র হালিমুল আলম জন বলেন, কিডনি বিক্রি এখনো থেমে নেই। কয়েক মাস আগে তিনি ভারতের এক হাসপাতালে গিয়েও এলাকার লোককে কিডনি বিক্রির জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে দেখেছেন। তিনি মনে করেন, অভাব আর ঋণের কারণে কিডনি বিক্রি করছে, পুরোপুরি এমনটি নয়। লোভে পড়ে কিছুটা আয়েশি জীবনের আশায় তারা শরীরের মূল্যবান অঙ্গ কিডনি বিক্রি করছেন।
মাত্রাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আ. ন. ম শওকত হাবিব তালুকদার লজিক বলেন, কয়েক বছর আগে কিডনি বিক্রির যে প্রবণতা ছিল, তা কমে গেছে। কিডনি বিক্রি রোধে তারা জনসচেতনতামূলক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছেন।
জয়পুরহাটের সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার বলেন, কেবল কিডনি দেয়ার কারণেই কিডনিদাতাদের শরীরের নানা রকম উপসর্গ দেখা দিয়েছে, এ কথা ঠিক নয়। একটি কিডনি দিয়েও মানুষ চলতে পারে। তিনি মনে করেন, অপুষ্টিসহ একজন সাধারণ মানুষের মতো এসব কিডনিদাতাও অসুখে পড়তে পারেন। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে এলে তাদের চিকিৎসা দিবেন বলে জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

nineteen − three =