প্রার্থী নিয়ে সংশয় আ. লীগে বিকল্প ভাবনা জাপায়

0
426

কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট, ফুলবাড়ী উপজেলা ও কুড়িগ্রাম পৌরসভা নিয়ে গঠিত কুড়িগ্রাম-২ সংসদীয় আসন। আগামী নির্বাচন ঘিরে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে বড় দলগুলোতে নেতাদের তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

জাতীয় সংসদের ২৬ নম্বর আসনটিতে বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে তাজুল ইসলাম দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে শক্ত দাবিদার হলেও নানা কারণে অন্য কাউকে প্রার্থী করা যায় কি না, এমন ভাবনাও রয়েছে।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য পুরনো-নতুন মিলিয়ে বেশ কয়েকজন চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। তবে

দলের নেতাকর্মীরা বলছে, দলের প্রার্থী মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে তারা সংশয়ে আছে। কেননা জোটগত নির্বাচন হলে এবারও হয়তো জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দিতে হতে পারে। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীর নাম সবার আগে উচ্চারিত হচ্ছে। তিনি এখানে নির্বাচন না করলে স্থানীয় তিন নেতার মধ্যে কেউ মনোনয়ন পাবেন বলে আলোচনা রয়েছে।

জাতীয় পার্টি : কুড়িগ্রাম-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য তাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৭৯ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচবার নির্বাচিত হন। জিয়া ও এরশাদ আমলে তিনি মন্ত্রীও ছিলেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলে (পিডিপি) যোগ দেন। পরে আবার জাতীয় পার্টিতে ফেরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বিএনপির টিকিট নিয়ে ২০০৮ সালে নির্বাচন করেন তিনি। কিন্তু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাছে হেরে যান তাজুল ইসলাম। পরে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. জাফর আলীর কাছেও শোচনীয়ভাবে হারেন তিনি। জাতীয় পার্টিতে ফিরে ২০১৪ সালে দলের টিকিটে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন তাজুল ইসলাম।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, তাজুল ইসলাম চৌধুরী এমনিতেই নির্বাচনী এলাকায় কম আসেন। তার ওপর বেশ কয়েক মাস ধরে তিনি অসুস্থ। বন্যার সময় চিকিৎসার জন্য তিনি বিদেশে ছিলেন। অসুস্থতার কারণে তিনি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কি না, এ নিয়ে দলের ভেতর আলোচনা থাকলেও এখন পর্যন্ত তিনিই প্রার্থিতার শক্ত দাবিদার। যদিও তাঁর জনপ্রিয়তা আগের মতো নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম-২ নির্বাচনী এলাকায় জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক ভিত্তি খুবই দুর্বল। জেলা ও উপজেলায় পাল্টাপাল্টি কমিটির কারণে সাংগঠনিক কোনো তৎপরতা নেই। ভিড় নেই পার্টির কার্যালয়েও। সংসদ সদস্য পছন্দের কয়েকজনকে দিয়ে তাঁর কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ নেতাকর্মীদের।

অবশ্য আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদের অধিবেশন থাকায় এলাকায় আসতে না পারলেও সব নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। ’

জাতীয় পার্টির বিকল্প প্রার্থী হিসেবে বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক মেজর (অব.) আব্দুস সালামের নাম আলোচিত হচ্ছে। তিনি বিভিন্ন এলাকায় বিলবোর্ড লাগিয়ে জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। মাঝেমধ্যে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ করেন মেজর সালাম। এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষকে কাজের ব্যবস্থা করে দিয়ে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি।

মেজর সালাম জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনের বিধিমালার কারণে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের তিন বছর পূর্ণ না হওয়ায় বিগত নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। তবে তিনি মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী।

জাতীয় পার্টির বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তাজুল ইসলাম চৌধুরী মনোনয়ন না পেলে মেজর সালাম অথবা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজেই প্রার্থী হতে পারেন এ আসনে। এ ছাড়া দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান পনির উদ্দিন আহমদের নামও শোনা যাচ্ছে। জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে হেরে যাওয়া পনির উদ্দিন জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে ধারণা করছে তাঁর অনুসারীরা।

আওয়ামী লীগ : ক্ষমতাসীন দলটির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে সাবেক সংসদ সদস্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাফর আলীর নাম আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। এ ছাড়া সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আ ম সা আ আমিন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম মণ্ডল, সহসভাপতি চাষী করিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন, সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ হাসান লোবান, চলচ্চিত্র পরিচালক আবু সুফিয়ান ও ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. হামিদুল হক খন্দকারের নাম শোনা যাচ্ছে। তাঁদের অনেকেই নিয়মিত গণসংযোগ করছেন এবং বিলবোর্ড ও পোস্টার লাগিয়ে পরিচিতি অর্জনের চেষ্টাও করছেন।

বিগত নির্বাচনে দলের জনপ্রিয় নেতা মো. জাফর আলী মনোনয়ন পেলেও জাতীয় পার্টির সঙ্গে ‘সমঝোতার’ কারণে আসনটি ওই দলের প্রার্থী তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে ছেড়ে দিতে হয়। এবারও জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছাড়তে হয় কি না, তা নিয়ে দলে জোর গুঞ্জন রয়েছে। নেতাকর্মীরা এবার নিজেদের প্রার্থী দেওয়ার দাবি করছে।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, কুড়িগ্রামের চারটি সংসদীয় আসনে দলটির সংসদ সদস্য নেই। তাই দলের নেতাকর্মীদের মনোবল সংহত রাখতে জাফর আলীকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়। বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক গণসংবর্ধনাও পেয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিও সেরে নিয়েছেন তিনি। অবশ্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার কারণে সংসদ নির্বাচনে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় কাটেনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকে ঘিরে জাফর আলীর কর্মতৎপরতা সবার নজর কেড়েছে। দলের বেশির ভাগ নেতাই প্রধানমন্ত্রী ও জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের জানিয়েছেন, সদর আসনটি আবার জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিলে দলের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হবে। জাফর আলীকে মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের জোর সুপারিশও রয়েছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আলী বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরে জেলায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। ফলে ভোটাররা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। নেত্রী যাঁকে মনোনয়ন দেবেন দলের সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাঁর জন্য কাজ করবে। ’

বিএনপি : সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির প্রার্থী হিসেবে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীর নাম সবার আগে উচ্চারিত হচ্ছে। ২০০৬ সালে বাতিল ঘোষিত নির্বাচনে তিনি এ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। কুড়িগ্রাম শহরের চামড়াগোলা এলাকায় তাঁর বাড়ি রয়েছে। মাঝে একবার স্থানীয় নেতাদের বিরোধ মেটাতে ব্যর্থ হয়ে তিনি কুড়িগ্রামের ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। তবে বর্তমানে এ আসনে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে তাঁর অবস্থান নমনীয় বলে জানিয়েছেন জেলার শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন।

এ ছাড়া এই আসনে প্রার্থী হিসেবে দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা, কুড়িগ্রাম পৌরসভার সাবেক মেয়র আবু বকর সিদ্দিক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদের নাম শোনা যাচ্ছে। জনপ্রিয়তা ও মাঠে কর্মতৎপরতার দিক থেকে এগিয়ে রয়েছেন সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সোহেল হোসনাইন ও সাইফুর রহমান রানার পক্ষে নেতাকর্মীরা ভেতরে ভেতরে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। যদিও তাঁরা দুজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তাই এ নিয়ে টানাপড়েন চললেও মুখোমুখি কোনো আলোচনা হচ্ছে না।

এ ব্যাপারে সাইফুর রহমান রানা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুটি আসনেই মনোনয়ন চাইব। কেন্দ্র বিবেচনা করবে। ’

অন্যদিকে সোহেল হোসনাইন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে জনসংযোগ করে পার্টির জনভিত্তি দাঁড় করিয়েছি। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চান আমি নির্বাচন করি। তাই মনোনয়ন চাইব। কেন্দ্র যা ভালো মনে করবে, তা-ই মেনে নেব। ’

নাশকতার মামলা বিচারাধীন থাকলেও হাল ছেড়ে দিতে নারাজ কুড়িগ্রাম পৌরসভার সাবেক মেয়র জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবু বকর। অনেক সতীর্থ তাঁকে ছেড়ে গেলেও যোগ্যতার মাপকাঠি ও ত্যাগী নেতা হিসেবে দলের মনোনয়ন পাবেন বলে তিনি আশা করছেন।

অন্যান্য : বাম দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় নেতা জাহিদুল হক মিলু প্রার্থী হতে পারেন। এ আসনে ইসলামী আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য ভোট রয়েছে। তবে এই দল থেকে কে প্রার্থী হবেন, তা এখনো ঠিক হয়নি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

fifteen − ten =