বেড়িয়ে এলো থলের বেড়াল দূর্ণীতির শীর্ষে সাভারের সাব-রেজিষ্টার!

0
1479

নোমান মাহমুদ
দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর অবশেষে বেড়িয়ে এলো থলের বেড়াল। অপরাধ বিচিত্রার গোপন ক্যামেরায় ধারনকৃত ভিডিও ফুটেজে ধরা পড়লো সাভারের সাব-রেজিষ্টার জাহাঙ্গীর আলম ও তার অনুসারীদের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। জনগণকে সেবা প্রদানকারী দেশের কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান নয়, এ যেন সাভারের সাব-রেজিষ্টার জাহাঙ্গীর আলম ও তার অনুসারীদের অবলিলায় দেশের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক কার্যালয়। অকল্পনিয় দূর্ণীতির ঠিক এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে অপরাধ বিচিত্রার অনুসন্ধানে।
দীর্ঘদিন যাবৎ দূর্ণীতির অভিযোগ অভিযুক্ত সাভারের এই সাব-রেজিষ্টারের কার্যালয়। এ নিয়ে বিভীন্ন গণমাধ্যমে একাধিক বার সংবাদ প্রকাশিত হলেও টনক নড়েনি সরকার বা তদারকির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের। অজ্ঞাত মহলের ইশারায় বারবার পার পেয়ে গেছেন দূর্ণীতিবাজরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, সাভার পৌরসভা ও তার আশে পাশের এলাকার জন্য সরকারি একটি ভূমি মূল্য নিধারণ করা রয়েছে। যা আবার বাড়ি, চালা, বাগান, নাল, বিল, টাট্টি সহ বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত। শ্রেণি অনুসারে ধার্য করা হয়েছে জমির মূল্য, যদিও সরেজমিনে এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জমির বাজার মূল্য সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক উর্ধে। জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে শ্রেণি অনুসারে জমির মোট মূলের শতকরা ১১ শতাংশ রেজিষ্ট্রি ফি সরকারের ঘরে জমা  পড়ার কথা থাকলেও তার ১০ ভাগও জমা পড়ছেনা সরকারের ঘরে। সরকারী রেজিষ্ট্রি ফি ফাকি দিয়ে প্রতিনিয়ত এই বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সাব-রেজিষ্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম ও তার অনুসারীরা। কোন জমি ক্রয়ের সময় নতুন দলিলে জমির শ্রেণি উচু হলে তাকে দলিলে নি¤œ শ্রেণি উল্লেখ করে, যেমন: “বাড়ি” “চালা” শ্রেণির জমি গুলো উচ্চ মূল্যের হওয়ায় এবং শ্রেণি অনুসারে সরকারী রেজিষ্ট্রি ফি মোটা অংক ধারণ করায়, জমির শ্রেণিগুলোকে “নাল”, “বিল”, “টাট্টি” তে রুপান্তর করে কম মূল্যে জমিগুলো রেজিষ্ট্রি করা হয়। এর বিনিময়ে প্রতি ১,০০,০০/- (এক লক্ষ) টাকা রেজিষ্ট্রি ফি ফাকি দিতে সাব-রেজিষ্ট্রার জাহাঙ্গীর আলমকে প্রদান করতে হয় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা এবং তার অনুসারী (পি.এস) রহিমকে ১ হাজার টাকা হারে প্রদান করতে হয়। এছাড়া অফিসের অন্যান্য কর্মচারিদেরও প্রদান করতে হয় নির্দিষ্ট অংকের একটি অর্থ। আর এভাবেই সাব-রেজিষ্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। এছাড়াও রয়েছে নানান অভিযোগ। কোন জমির নামজারি, খারিজ না থাকলেও মোটা অংকের টাকা দিলেই যে কেউ রেজিষ্ট্রি করিয়ে নিতে পারেন যে কোন দলিল। এমনকি প্রয়োজন পড়েনা ক্রেতা বা বিক্রেতার উপস্থিতি। দেশের উন্নয়নে দূর্ণীতির বিরুদ্ধে সরকার যখন কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে একটি সন্ত্রাস ও দূর্ণীতিমুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহুর্তে সাভারের সাব-রেজিষ্টার জাহাঙ্গীর আলমের এহেন দূর্ণীতি দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের প্রশ্নে সন্দেহের সৃষ্টি করছে।
যেভাবে বেড়িয়ে এলো থলের বেড়াল ঃ
২৩/০৮/২০১৬ইং সময় সকাল আনুমানিক ১১.০০ টা। অপরাধ বিচিত্রার এক চৌকস সাংবাদিক গোপন ক্যামেরা ধারন করে জমির ক্রেতা সেজে ছদ্মবেশে পৌছে গেলো সাভারের সাব-রেজিষ্টারের কার্যলয়ে। খোজ নিয়ে জানা গেল সাব-রেজিষ্টার জাহাঙ্গীর আলম কোন একটি আলোচনায় ব্যাস্ত। তারপর শুরু হলো অপেক্ষা।

দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষর এক পর্যায়ে দেখা মিললো সাব-রেজিষ্টার জাহাঙ্গীর আলমের। তার সামনে উপস্থাপন করা হলো সাভারের গেন্ডা মৌজার ৫ শতাংশ জমির একটি দলিল। জমির শ্রেণি “নাল”। যদিও বাস্তবিক অর্থে ঐ দলিলে উল্লেখিত জমির শ্রেণি “বাড়ি”। জাহাঙ্গীর আলমকে অবগত করা হলো এই দলিলে উল্লেখিত জমির খারিজ নাই। ক্রেতা জমি ক্রয়ে ইচ্ছুক এবং খারিজ ব্যাতিত এটি কি রেজিষ্ট্রি করা যাবে কি না তার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানালেন সব কিছুই সম্ভব। এক্ষেত্রে করণীয় কি তা জানতে চাইলে পরিচয় করিয়ে দেন তার পি.এস রহিমের সাথে। বলেন, “আপনি ওর সাথে কথা বলেন ওই বিস্তারিত আপনাকে বলে দিবে”। এরপর রহিম ক্রেতাকে নিয়ে গেল কার্যালয়ের বাহিরে “নানীর হোটেল” নামক একটি খাবারের হোটেলে। শুরু হয় আবার আলোচনা। দলিলটি পর্যালোচনা করে রহিম জানান, দলিলে জমির শ্রেণি “নাল” থাকলেও বাস্তব অর্থে জমির শ্রেণি “বাড়ি”। শ্রেণি তুলনায় যার সরকারী ধার্যকৃত মূল্য সবচেয়ে বেশি। শুধু এই জন্যই তার স্যারকে (জাহাঙ্গীর আলম) একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ প্রদান করতে হবে। আর জমির বর্তমান শ্রেণির “নাল” হওয়ায় সেই হিসেবে রেজিষ্ট্রি করতে মোট খরচের একটি আনুমানিক খসড়া তিনি ছদ্মবেশি ক্রেতাকে দেন। তার খসড়া অনুযায়ী “নাল” হিসেবে এই জমি রেজিষ্ট্রি করতে সরকারী রেজিষ্ট্রি ফি ১,৩২,৫০০/- (এক লক্ষ বত্রিশ হাজার পাঁচশত) টাকা, ষ্ট্যাম্প ২,০০০/-নকল ১,০০০/- টাকা স্যার (জাহাঙ্গীর আলম) ১,০০০/-, সেরেস্তা ৩,০০০/- এবং অফিস খরচ ১,০০০/-, মোট ১,৪০,৫০০/- টাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “নাল” হিসাবে রেজিষ্ট্রি করতেও আপনার প্রায় দেড় লক্ষ টাকা প্রয়োজন। স্যার (সাব-রেজিষ্টার) বলেছেন, এই দলিল এ আমরা জমির শ্রেণি টাট্টি দিয়ে রেজিষ্ট্রি করে দিবে, তাতে করে আপনাদের (ক্রেতার) খরচ প্রায় ১,০০,০০০/- টাকা কমে যাবে। রহিমের দেওয়া ৫ শতাংশ জমিটির “টাট্টি” শ্রেণিতে রুপান্তর করে খরচের খসড়া নি¤œরূপ- সরকারী রেজিষ্ট্রি ফি ১২,০০০/- টাকা, স্যার (জাহাঙ্গীর আলম) লাখ প্রতি ৩,০০০/- টাকা হারে ৩৩,০০০/- ষ্ট্যাম্প ২,০০০/-, নকল ১,০০০/-, সেরেস্তা ১,০০০/-, রহিম ১০,০০০/-, এবং অফিস ১,০০০/- মোট ৬০,০০০/- (ষাট হাজার) টাকা। রহিম বলেন, ন্যায়সঙ্গত ভাবে এই জমিটি রেজিষ্ট্রি করতে হলে আপনার  (ক্রেতা) কয়েক লক্ষ টাকা শুধু সরকারী ঘরেই জমা দিতে হবে। সেই টাকা সরকার পাবে যাতে স্যারেরও লাভ নেই আপনারও লাভ নেই। আর এভাবে টাট্টি শ্রেণিতে রেজিষ্ট্রি করলে স্যারেরও লাভ আমারও লাভ আর আপনারও অনেক টাকা বেঁচে যাচ্ছে। আগামীকাল সকাল সকাল চলে আসুন, কালই রেজিষ্ট্রি করে দিচ্ছি। এর পর ছদ্মবেশি ক্রেতার নিকট থেকে বিদায় নিয়ে রহিম কার্যালেয়ের ভেতরে চলে যায়। যার পুরোটাই ধরা পরে অপরাধ বিচিত্রার গোপন ক্যামেরায়।
সাভারের সাব-রেজিষ্ট্রার কার্যালয়ে প্রতিদিন অসংখ্য দলিল রেজিষ্ট্রি হয়। যা থেকে সরকারী রেজিষ্ট্রি ফি ফাকি দিয়ে সাব-রেজিষ্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম ও তার অনুসারীরা প্রতিনিয়ত হাতিয়ে নিচ্ছে দেশের কোটি কোটি টাকা।
অনতিবিলম্বে এসকল দূর্ণীতি বন্ধ করা না গেলে দূর্ণীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে।
সাভারের সাব-রেজিষ্ট্রারের কার্যালয়ের দূর্ণীতি নিয়ে আরো চাঞ্চল্যকর সব তথ্য জানতে চোখ রাখুন অপরাধ বিচিত্রায়।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

six − 4 =