মৃত শ্রমিকদের টাকা আত্মসাতের পাঁয়তারা পদ্মা ইসলামী লাইফের

0
1592

অপরাধ বিচিত্রাঃ
আমিনা বেগম ক¤িপউটার আপারেটর হিসেবে কাজ করতেন শান্তা এক্সপ্রেশন্স লিমিটেড কো¤পানিতে। যার শ্রমিক তালিকায় ক্রমিক নং-৯৫৪, হাজিরা কার্ড নং-৬৬৯, তিনি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট থানার মোঃ আলম মিয়ার স্ত্রী। তিনি ২৫ নভেম্বর ২০১৪ সালে হৃদযন্ত্র ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। মৃত্যুর পর বীমা দাবি উত্থাপন করা হয় ২০১৫ সালে ১ জুন। আবেদনের দুই বছর পার হলেও মরহুমার বীমা দাবি দুই লাখ টাকা পরিশোধ করেনি বেসরকারি বীমা কো¤পানি পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। শুধু আমেনা বেগম নয়, তার মতো আরও ১৫৫ মৃত শ্রমিকের বীমা দাবি প্রায় তিন কোটি টাকা ঠুনকো অজুহাতে পরিশোধ না করে তা আত্মসাতের পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী পরিবার। এ দাবির টাকা আদায়ে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ তিন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেও সুফল না পাওয়ায় এবার সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে যাবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) নিটওয়্যার কারখানা মালিকদের সংগঠন এবং সরকার নিবন্ধিত একটি সংগঠন। সংগঠনটি সরকারি নীতিমালা অনুসারে সদস্যভুক্ত কারখানার শ্রমিকদের সুবিধা প্রদানের জন্য বেসরকারি বীমা কো¤পানি পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের সঙ্গে গ্রুপ বীমা চুক্তি করে। বীমা পলিসি নং-পিআইএলআইএল/ি বকেএমইএ-১১১/১৪, মেয়াদ : ১১-০৪-২০১৪ থেকে ৩১-১২-২০১৫, প্রিমিয়াম জমার তথ্য  প্রিমিয়াম জমা রশিদ নং-০১-৮১৬৭৭৪, তারিখ, ০৮-০৫-২০১৪, প্রিমিয়াম জমার পরিমাণ
৫০ লাখ টাকা। প্রিমিয়াম জমা রশিদ নং-০১-৮১৬৭৭৩, তারিখ, ০৮-০৫-২০১৪, প্রিমিয়াম জমার পরিমাণ ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। গ্রাহক বিকেএমইএর সদস্য কারখানা শান্তা এক্সপ্রেশনস লিমিটেড। ওই কো¤পানির শ্রমিক ছিলেন আমিনা বেগম। তার মৃত্যুর পর চুক্তি অনুযায়ী বিকেএমইএ যথাযথ কাগজপত্রসহ পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাছে দাবি উত্থাপন করে। মৃত্যুদাবি সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যথাযথভাবে কো¤পানিটির চাহিদামতো দাখিল করা হয়। কিন্তু পদ্মা ইসলামী লাইফ অদ্যাবদি আমিনা বেগমের মৃত্যু দাবি পরিশোধ করেনি। মৃত্যুদাবি উত্থাপনের পর থেকে বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও দাবিটি পরিশোধের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি না বীমা কো¤পানিটি। উল্টো কো¤পানিটি অসৎ উদ্দেশ্যে মৃত্যুদাবিটি পরিশোধ না করার পাঁয়তারা হিসেবে সময়ক্ষেপণ করছে। পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে বিকেএমইএর চুক্তি অনুসারে বিকেএইএর প্রতিটি সদস্য কারখানা সর্বোচ্চ ২০ জন শ্রমিকের মৃত্যুদাবি পাবে। তবে কো¤পানিটির কাছে জমা করা ওই কারখানার শ্রমিক তালিকায় মৃত শ্রমিকের নাম থাকা বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে সদস্য কারখানায় চাকরিরত কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলে সে শ্রমিক বীমা দাবি পাবে। পদ্মা ইসলামী লাইফ বরাবরই বিকেএমইএ থেকে কোনো মৃত্যুদাবি উত্থাপন করা হলে নানা ধরনের অবান্তর, অযৌক্তিক ও বেআইনি প্রশ্ন তুলে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে হয়রানি করে। দাবি নি®পত্তি না করে অসৎ উদ্দেশ্যে ঝুলিয়ে রেখে গ্রাহকের প্রাপ্য টাকা না দেওয়ার পাঁয়তারা করে। অথচ মৃত শ্রমিকের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিকভাবে সুবিধা দিতেই গ্রুপ বীমার এ চুক্তি করা হয়। কিন্তু বীমা কো¤পানিটির টাকা আত্মসাৎ করার হীন প্রচেষ্টায় বেআইনি কর্মকা-রে কারণে আজও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার কোনো টাকা পায়নি। এমনকি বীমার টাকা আদায়ে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ তিন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেও পাওনা টাকা পাচ্ছে না বিকেএমইএ সদস্যভুক্ত কারখানার ১৫৫  শ্রমিকের পরিবার। মৃত্যু দাবির টাকার জন্য তারা গত প্রায় তিন বছর ধরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। এদিকে শ্রমিকদের পক্ষে বাংলাদেশ নিটওয়্যার মেনুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) চেষ্টা করে টাকা উদ্ধার করতে পারছে না। এ প্রসঙ্গে বিকেএমইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলভ চৌধুরী আজকালের খবরকে বলেন, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স শ্রমিকদের দাবির টাকা নিয়ে টালবাহানা করছে প্রায় তিন বছর ধরে। শ্রমিকের টাকা উদ্ধারে আমরা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে গিয়েছি। বীমাখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে অভিযোগ দেওয়া আছে। তিনি বলেন, শ্রমিকের দাবির টাকা না দিয়ে কোনোভাবেই পার পাবে না পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দাবি টাকা না পেয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এর বাইরে বীমা কো¤পানিটির বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে পাঁচটি মামলা করেছে বিকেএমএই এর সদস্যরা। এদের মধ্যে অবন্তি কালার টেক্সটাইল লিমিটেডের মালিক এ এইচ আসলাম সানি, এমবি নিট ফ্যাশনের মালিক মোহাম্মদ হাতেম, রূপসি নিটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার্দী, মডেল ডি ক্যাপিট্যাল লিমিটেডের মালিক মাসুদুজ্জামান ও মিনার ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক  মোহাম্মদ মঞ্জরুল হক। এর প্রেক্ষিতে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও সিইওর বিরুদ্ধে আগামী ২৮ আগস্ট চার্জ গঠনের তারিখ ধার্য করেছেন শ্রম আদালত। মৃত শ্রমিকদের বীমা দাবির টাকা আদায়ে দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে এ চার্জ গঠন তারিখ ধার্য হয়। গতকাল সোমবার শুনানি শেষে প্রথম শ্রম আদালতের বিচারক তাবাসসুম ইসলাম চার্জ গঠন সংক্রান্ত আদেশ দেন। চার্জ গঠনের পরপরই বীমা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ডা. এ বি এম জাফর উল্লাহ ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোহাম্মদ ওয়াসিউদ্দিনের বিচার শুরু হবে। এর বাইরে শ্রম প্রতিমন্ত্রী ও এই মন্ত্রণালয়ের সচিবে কাছে অভিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে বিকেএমইএর পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনেও অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন বীমাখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) বিরোধ নি®পত্তি কমিটিতে অভিযোগ করা হয়েছে। মামলায় প্রত্যেক শ্রমিকের গ্রুপ বীমা দাবি বাবদ দুই লাখ টাকা পরিশোধসহ বিলম্বিত সময়ের জন্য ব্যাংক রেটের ওপর অতিরিক্ত পাঁচ শতাংশ হারে মাসিক ভিত্তিতে সুদ পরিশোধ করার আদেশ প্রার্থনা করা হয়েছে। একইসঙ্গে মামলা পরিচালনার খরচ এবং মৃত শ্রমিকের মৃত্যু দাবির টাকা না পাওয়ায় তার পরিবারের সদস্যদের দুঃখ কষ্টের ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করার আদেশ প্রার্থনা করেছেন মামলার বাদী বিকেএমইএর যুগ্ম সচিব (ফায়ার অ্যান্ড আর্বিট্রেশন) মোহাম্মদ মানিক মিয়া। জানা গেছে, বিকেএমইএর অভিযোগ অযৌক্তিক ও বেআইনি প্রশ্ন তুলে গ্রাহকের প্রাপ্য টাকা না দেওয়ার পাঁয়তারা করছে বীমা কো¤পানিটি। অথচ মৃত শ্রমিকের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিকভাবে সুবিধা দিতেই গ্রুপ বীমার এ চুক্তি করা হয়। বীমা কো¤পানিটির অসহযোগিতা ও বেআইনি কর্মকান্ডের কারণে আজও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার কোনো টাকা পায়নি। এ প্রসঙ্গে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান এ এফ এম উবাইদুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে যেহেতু বিকেএমইএ মামলা করেছে, সেহেতু এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার কিছু নেই। জানা গেছে, বীমা চুক্তির শর্ত অনুসারে, বিকেএইএর প্রতিটি সদস্য কারখানার জন্য বছরে সর্বোচ্চ ২০ জন শ্রমিকের মৃত্যু দাবি পরিশোধযোগ্য। এক্ষেত্রে যে কোনো সদস্যের যে কোনো প্রকার মৃত্যুতে দুই লাখ টাকা বীমা দাবি পরিশোধ করা হবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। দুর্ঘটনার কারণে পক্সগুত্ববরণ করলেও একই সুবিধা প্রদান করা হবে। যেসব কর্মকর্তা/কর্মচারী ও শ্রমিক বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত নিটওয়্যার ফ্যাক্টরির অধীনে পূর্ণকালীন চাকরিতে নিয়োজিত সুস্থ এবং যাদের বয়স-পরবর্তী জন্মদিনে ৬০ বছর উত্তীর্ণ হবে কেবল তাদের জীবন এ চুক্তিনামার আওতাভুক্ত রাখা হয়। তবে কোনো সদস্যের বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর চুক্তিনামার আওতায় আসবে না বলে বীমা চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। ২০১৫ সালের বীমা চুক্তিতে প্রতি সদস্যের বীমাকৃত অর্থের হাজার প্রতি বার্ষিক প্রিমিয়াম হার নির্ধারণ করা হয় ৮ টাকা ৭৫ পয়সা এবং প্রতি ইউনিটের বার্ষিক প্রিমিয়াম ৩৫ হাজার টাকা। এর আগে ২০১৪ সালের চুক্তিতে বীমাকৃত অর্থের প্রতি হাজার টাকার জন্য বার্ষিক প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা হয় ছয় টাকা ২৫ পয়সা হারে। এক্ষেত্রে প্রতি ফ্যাক্টরির জন্য বার্ষিক প্রিমিয়াম নির্ধারিত হয় ২৫ হাজার টাকা। কোনো ফ্যাক্টরির সদস্যদের তালিকা সরবরাহের পর প্রিমিয়াম পরিশোধের প্রক্রিয়ার জন্য বিকেএমইএকে ২০ থেকে ২৫ দিন সময় দেওয়া হয়। বীমা চুক্তির শর্ত অনুসারে, বিকেএমইএর সদস্য কারখানায় চাকরিরত কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলে, সে শ্রমিক বীমা দাবি পাবে। এক্ষেত্রে পদ্মা ইসলামী লাইফের কাছে জমা করা সংশ্লিষ্ট কারখানার শ্রমিক তালিকায় মৃত শ্রমিকের নাম থাকা বাধ্যতামূলক। সব মৃত্যু দাবি উত্থাপন করার পর ১৫ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে তা পরিশোধ করা হবে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। মামলার বাদী বিকেএমইর যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মানিক মিয়া জানান, দীর্ঘ তিন বছর ধরে পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্স আমাদের বীমা দাবি পরিশোধ করছে না। তিনি বলেন, যে সরল বিশ্বাসে চুক্তি মাধ্যমে পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে পলিসি করেছি, সে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে বীমা কো¤পানিটি। এ কারণে আমাদের ন্যায্য এবং আইনসঙ্গত বীমা দাবি পেতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বিরোধ নি®পত্তি কমিটিতে অভিযোগ দাখিল করতে বাধ্য হয়েছি। তিনি বলেন, আমরা মনে করি পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের কর্মকান্ড বীমা আইন-২০১০ এর ৭২ ধারার ১ উপধারা এবং গ্রুপ বীমা বিষয়ে স¤পাদিত চুক্তিপত্রের ছয় দফার ঘ উপদফার লঙ্ঘন। বীমা আইন অনুসারে এটি দন্ডণীয় অপরাধ। এছাড়া বীমা কো¤পানিটি গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে, যা দন্ডবিধি ৪০৬/৪১৮/৪২০ ধারার অপরাধ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

5 × 2 =