‘যমুনার বাবুল কৌশলে মানুষ হত্যা করে’

1
4054

কবরিয়া চৌধুরীঃ
আমার দীর্ঘ ৩২ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এমন কোন হুমকি আর পাইনি। সাংবাদিকতা করতে গেলে ঝুঁকি থাকবে। আবার সর্বদা নিরাপত্তার বিষয়টিও সংবিধান স্বীকৃত। সেখান থেকে সাহস, নীতি-নৈতিকতা, অন্যায় অপরাধের প্রতিকার, দুর্নীতি-জুলুমের খবর পরিবেশন করে যাওয়া। কোন খবর প্রকাশিত হলে সকল মানুষ তথা পাঠক খুশি হয় না। হাছা সংবাদেও কেউ না কেউ বেজার হন। সংবাদের ব্যবস্থাটাই এমন।
গত ১-১১-১৭ থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এমন কোন পরিচিত অঙ্গন পেলাম না যারা বলছেন না যে, একটা খারাপ লোকের পাল্লায় পড়েছ। সাবধান থাকবা। যমুনা গ্রুপের নুরুল ইসলাম বাবুল।

তিনি যমুনার মালিক চেয়ারম্যান। যমুনা টিভি, যুগান্তর পত্রিকা তার। সিকিশতক কোম্পানি, ল্যান্ড ব্যবসা থেকে হরেক রকম ব্যবসা। পানীয় মদতো আছেই। সাবান, সোডা সবই আছে। আর ক্ষমতা বেশ ব্যক্তিগত ক্ষমতা, আর্থিক ক্ষমতা, ব্যবসায়িক ক্ষমতা সব মিলে তিনি ধরাকে সরাজ্ঞান করার লোক। মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশ কাউকে ছাড় দেন না। ভাষাগত ব্যবহারের প্রকটতায় অনেকে মান-ইজ্জতের ভয়ে তটস্থ থাকেন। এমন নানা বিশেষণ তার আছে। আমার আবার কারো ব্যক্তিগত স্বভাব চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করা হয় না। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রবোধ আছে। সুতরাং ব্যক্তিগত ভাষা নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। আমরা ব্যক্তিগত ভাষা নিয়ে ১৯৮৮ সালের সমমনা ছাত্রনেতারা কিছু ভাষার সংস্কার করেছি। যেমন শালাকে স্ত্রীর ভাই অথবা সন্তানের মামা বলে সম্বোধন করতাম। স্ত্রীর বড় ভাইকে সমোন্ধী না বলে, স্ত্রীর বড় ভাই কিংবা ছেলে-মেয়ের মামা, স্ত্রীর ভাই। তার ঘরের সন্তানরা সাধারণ ভাষায় শালার পুত। আমরা সংস্কার করে বলি, ছেলের মামাতো ভাই-বোন ইত্যাদি। এই সংস্কারকৃত ভাষা, বাক্য, বিশেষণগুলো আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। এটা আসলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, মেলবন্ধনের বেষ্টনীতে যারা থাকেন, অর্জন করেন, তারাই চর্চা করতে পারেন। তাই টাকাওয়ালাদের কাছে ভাষা ব্যবহারের কোন বালাই নেই। সবাই এডাল্ট।
আমার কাগজ জাতীয় অর্থনীতিতে যমুনা গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির এনবিআরের দাবিকৃত অর্থের একটি হিসাব দেয়া হয়েছে ৬৫টি মামলা। তার সঙ্গে জড়িত ২৪০ কোটি টাকা। ভ্যাট, কর, শুল্ক। এসব চাইলে, নানা অজুহাত। এনবিআর চাইছে, সমঝোতা, সুব্যবহার করে কর আদায় করতে। কিন্তু করদাতার তাতে সায় নেই। নানা অজুহাত, মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি।
রিপোর্ট ছাপা হলো। ১-১১-১৭ ইং দুপুর ২টা ১০ মিনিট। আমি সচিবালয় থেকে অফিসে এসে বসলাম। হঠাৎ মোবাইল ফোনে কর্কশ কণ্ঠে আমার নামের উচ্চারণ ও বাবান কিবরিয়া চৌধুরী, বিকৃত উচ্চারণ করে বলেন, (কিরবিয়া চৌধুরী) নাকি? আমি যথারীতি সালাম দিলাম। সালামের জবাবও দিল না। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল। যমুনার বাবুলকে চিনো? আমি বললাম, চিনব না কেন? ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, লাল-সবুজে কাজ করার সময় বেশ কয়েকবার ফোন করেছি, কথা বলেছি ইত্যাদি। তিনি বললেন, কয় টাকা খেয়ে যমুনার বিরুদ্ধে এ রিপোর্ট করেছ ব্যাটা? আমি বললাম, আই এম নট দেট পিপল। আর আপনার সমস্যা হলে ১০ লাইনের জায়গায় ৪০ লাইন প্রতিবাদ পাঠান, কাল ছেপে দিব। তিনি বললেন, এসব আমার দরকার নেই। তুই কোথায় আছিস। এক্ষণি আমার অফিসে আয়। না আসলে, লোক পাঠাচ্ছি ধরে নিয়ে আসবে। তুই জানিস না যমুনা গ্রুপের বিরুদ্ধে এই দেশে এক শব্দ লেখা ও বলার কারো সাহস আছে? দেখতো। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আপনি দুটি মিডিয়ার মালিক। আপনার মিডিয়াতে প্রতিদিন এই ধরনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তখন কেউ ক্ষুব্ধ হলে, ক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা কি আপনাকে তুলে নিয়ে যাবার হুমকি দেন। কিংবা তুলে নিয়ে যান। এভাবে যদি একটি রিপোর্টে সম্পাদক তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে তো আপনার একদিনও থাকার কথা নয়। অথচ ১০/১৫ বছর পত্রিকা চালাচ্ছেন? তিনি এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করা শুরু করলেন। বললেন, কোথায় থাকবি? যেখানে থাকবি সেখান থেকে তুলে নিয়ে আসা হবে। বাঁচতে পারবি না।
প্রথমে বিষয়টি বেশ হালকাভাবে নিলাম। একটু চিন্তা করে প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি, সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতাদের ফোনে জানালাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস বিভাগকে জানালাম। সবার এক কথা, আগে জিডি করেন। জিডির কপি দিন। তাৎক্ষণিক একটি জিডি লিখে থানায় গেলাম। থানায় জিডি নিবে নাকি না নিবেÑগড়িমসি। নানা ধরনের বিশেষণ। যমুনার বাবুল। মস্তবড় শিল্পপতি। ডেঞ্জার মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে জিডি নিয়ে পরে কি হবে? আমি বললাম, জিডি নিবেন, এটা পুলিশ স্টেশন সবার জন্য ওপেন। কে বড় কে ছোট সেটি বিচার করার দায়িত্ব আপনাদের নয়। আইনে তা বলেনি। যাক এক পর্যায়ে জিডি নিলেন। এ ব্যাপারে পল্টন মডেল থানা, ডিএমপি’র জিডি নং ৪৪, তারিখ ০১/১১/২০১৭ ইং। বাবুলের মোবাইল নং-০১৭১৩০৮৩৪৫১। এরপর ফিরে আসলাম অফিসে। তারপর জিডির কপি প্রেসক্লাব, ইউনিয়ন অফিস, ডিআরইউ নেতৃবৃন্দের কাছে পাঠালাম। রিপোর্টার সবাইকে অবগত করা হলো। সবাই অবহিতও হলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস প্রধানকে জানালাম, পুলিশ কমিশনার, আইজি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানল। সংশ্লিষ্ট সকলেই ইতোমধ্যে জেনে গেছেন। বৃহস্পতি থেকে শনি সরকারি বন্ধ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আয়কর মেলা নিয়ে ব্যস্ত, তিনদিন ছুটি। তিনদিনের ভয়তো ছিলই। কখন উঠিয়ে নিয়ে যায়। এসব আশংকা। সাংবাদিক, সুশীল সমাজ ও সামাজিক বেষ্টনীতে থাকা মানুষেরা প্রচ- ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল। ৫.১১.১৭ তারিখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যমুনা গ্রুপের কাছ থেকে শুল্ক করের তালিকা, মামলা ইত্যাদি কাহিনী শ্বেতপত্র প্রতিবাদ হিসেবে ২০/২১টি জাতীয় পত্রিকায় ১ পাতা/২ পাতা প্রকাশ করে। পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হলো। রোববারের তথা ৫/১১/১৭ ঘটনা উৎরাতে উৎরাতে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক পর্যন্ত গড়ালো। তারপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দা বিভাগও অবহিত। এসবই শোনা।
কিন্তু একটা বিষয় বেশ পীড়াদায়ক। পরিচিত বন্ধুরা বার বার ইনিয়ে বিনিয়ে বলছিল, বাবুল খারাপ লোক। যে কোন সময়ে যে কোন অঘটন ঘটাতে পারে। অনেকেই নানা গল্পের কথা বললেন। কিভাবে যমুনার বাবুল তার প্রতিপক্ষ কেউ হলে তাকে কিভাবে ঘায়েল, হত্যা, দুনিয়া থেকে গায়েব ও গুম করে? তারা উদাহরণ দিল যমুনার বাবুল কাউকে পাত্তা দেয় না। মন্ত্রী পর্যন্ত ছাড়ে না। তার প্রতিপক্ষকে নিশ্চিন্ন করতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেয়। প্রথমত চোরাগোপ্তা আঘাত করে। প্ল্যান অনুযায়ী লোক দিয়ে গাড়ি চাপা দেয়। বাহিনী দিয়ে উঠিয়ে নেয়। শেষ কথা হত্যা, গুম, অপহরণের কোন সাক্ষ্য পর্যন্ত রাখে না। এতটাই তার মহান কীর্তি রয়েছে। সুতরাং সাবধান। কেন তার সঙ্গে লাগতে গেলে। অনেকেই বলল, আমি বাবুলের কাছে কেন গেলাম না? আমি বললাম, আমি গেলে আমার সাথে তিনি জান্নাতুল ফেরদৌসের ভাষায় ব্যবহার করতেন এমন নিশ্চয়তা কে দিবে? যাক। শংকার মধ্যে থাকলাম। এরইমধ্যে গোটা দেশের সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, শিক্ষক, দেশে-বিদেশে মস্তবড় প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা, বিবৃতি, প্রতিবাদ আসছে। এ পরিস্থিতির মধ্যেও আশংকা কমছে না। কখন কি করে বসে। আমার নিরাপত্তা? একা চলি, কাজ করি, পত্রিকা করি। ব্যক্তিগতভাবে প্রচ- চাপের মধ্যে আছি। নম্বরবিহীন কল আসে। পরিচয় দেয় না। বলে, সাবধান। তোর সময় ফুরিয়ে আসছে, তৈরি থাকিস ইত্যাদি। আবার অনেক হৃদয়বিদারক গল্পও কানে আসে। এক ভদ্রলোক। পুলিশের সার্জেন্ট। এখন অবসরে। নাম বলতে চাননি। তিনি বলেন, দায়িত্ব পালনকালে যমুনার বাবুলের গাড়ি থামালে, বাবুল সাব গাড়ি থেকে নেমে সার্জেন্টকে চড় মারে। প্রতিকারহীন চাকরি থেকে অবসর নিয়ে গেলেন। অথচ সে হৃদয় রক্তক্ষরণ থামেনি। নবাবগঞ্জের ব্যবসায়ী ইউনিক গ্রুপের নূর আলীর কাছে শত সহস্র গল্পতো আছেই। বসুন্ধরা গ্রুপের আহমেদ আকবর সোবহানের কাছে বাবুলের গল্পের ভা-ার রয়েছে। বিভিন্ন সময় উনারা এসব গল্প লিখিয়েছিলেন কারো কারো মাধ্যমে। মেঘনা গ্রুপের গোলাম মোস্তফার কাছেও যমুনার বাবুলের গল্পের পা-ুলিপি আছে। তিনিও বলেছিলেন, এখন উনারা কেউ আর সেসব বলেন না। তবে জানেন, বুঝেন, জমা রেখেছেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 × 5 =