‘ছাত্রলীগ ক্যাডার’ খুঁজতে শেষ চারটি বিসিএসের পুরো প্রক্রিয়া পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষায় কোনো ‘বিশেষ সুবিধা’ দেওয়া হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হবে। তথ্য যাচাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সরকারি কর্ম কমিশনকেই (পিএসসি)। তারা এরই মধ্যে এ বিষয়ে কাজও শুরু করেছে। নতুন করে তথ্য যাচাইয়ের খবরে উৎকণ্ঠায় আছেন ৪৩তম বিসিএস টপকে যাওয়া ২ হাজার ৬৪ প্রার্থী। সর্বশেষ তিন বিসিএস, অর্থাৎ ৪৪ থেকে ৪৬তমের প্রিলিমিনারি, লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে অপেক্ষায় থাকা প্রার্থীদের মনেও ভর করেছে হতাশা।
পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারে তাদের ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটেছে বলে বিএনপি সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে।
বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আট ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে তা যাচাইয়ের কাজও শুরু হয়েছে। বিসিএসের সেই ব্যাচগুলো হলো– ২৮, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৪০ ও ৪১তম। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী বিসিএস পরীক্ষায় নানাভাবে পিএসসির ‘বিশেষ সুবিধা’ পেয়েছেন বলে জোরালো অভিযোগ আছে।
বিএনপি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ একাধিক সংগঠন আমলাতন্ত্রের ভেতরে থাকা ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগীদের বের করে দেওয়াসহ সর্বশেষ বিসিএস পরীক্ষাগুলো তদন্ত করে দেখার দাবি জানায়। বিএনপি দাবি করে, ৪৩তম বিসিএসে যথাযথ প্রক্রিয়া না মেনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যার বেশির ভাগই ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। এ ছাড়া ৪৪, ৪৫ ও ৪৬তম বিসিএসের যেসব কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলো স্থগিত করে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানায় দলটি।
সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বিগত দিনে রাজনৈতিক বিবেচনায়, বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারে বিপুল সংখ্যক প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে সরকারের কাছে অভিযোগ আসছে। এ কারণেই পুলিশ ক্যাডারে ছয়টি ব্যাচের সব নিয়োগ প্রক্রিয়া পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
চারটি বিসিএসের প্রক্রিয়া পর্যালোচনার উদ্যোগের কারণ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে চাননি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম সমকালকে বলেন, কমিশন এখনও পূর্ণাঙ্গ নয় বলে অনেক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। কমিশনের সভার কোরাম পূর্ণ হতে অন্তত সাতজন লাগে। কমিশনে আমিসহ পাঁচজন রয়েছি। ফলে কমিশনের সভা করা যাচ্ছে না। শেষ চার বিসিএসের কার্যক্রম পর্যালোচনার প্রশ্নে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, আগে আমরা কমিশনের সভায় বসি। এরপর আপনাদের (গণমাধ্যম) সবকিছু জানাব। এখনই এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, মূলত পুলিশে থাকা ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতাকর্মী খুঁজে বের করতেই এ উদ্যোগ। এর অংশ হিসেবে পুলিশ কর্মকর্তাদের ‘রাজনৈতিক দর্শন’ খুঁজতে দ্বিতীয় দফা পুলিশ ভেরিফিকেশন শুরু হচ্ছে। এ জন্য গত ২০ অক্টোবর পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।
চিঠিতে উল্লিখিত ছয়টি বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে যারা চাকরি পেয়েছেন, তাদের জীবনবৃত্তান্ত ফের যাচাই-বাছাই করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একজন সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কম নয়, এমন কর্মকর্তাকে দিয়ে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায় রেখে দ্রুত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে কর্মকর্তার নাম, জন্ম তারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র, সচল একাধিক ফোন নম্বর, ই-মেইল, ফেসবুক, টিআইএন নম্বর এবং পাসপোর্ট নম্বর সংযুক্ত করতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, গোপনীয় প্রতিবেদনে কর্মকর্তা যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন, তার নাম, সেশন ও অধ্যয়ন করা বিষয় এবং অবস্থান/আবাসিক হলের তথ্য দিতে হবে। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য ছাড়াও প্রার্থী অন্য জেলায় অধ্যয়ন করে থাকলে সংশ্লিষ্ট জেলায় যোগাযোগ করে তাঁর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়া কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন করে বন্ধুর নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর, সংশ্লিষ্ট থানার রেকর্ড (সিডিএমএসের তথ্য) যাচাই করে দিতে হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। আরও বলা হয়, প্রার্থীর রাজনৈতিক সংশ্লেষ ছাড়াও কোনো রকম জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় জড়িত কিনা, সে তথ্যও দিতে হবে। প্রার্থী সম্পর্কে এলাকার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, গ্রহণযোগ্যতা আছে এমন জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক এবং তাঁর সমসাময়িক বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তাঁর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে।