দেশভৌগলিকরাজনীতি

আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণে আপত্তি নেই, সবাইকে নির্বাচনে চায় বিএনপিঃ দ্য হিন্দুকে ড. ইউনূস

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের কাছে ফেরত চাইবে বাংলাদেশ। তাকে ফেরত আনতে আইনি ব্যবস্থ নেয়া হবে। ভারত যদি এক্ষেত্রে প্রত্যর্পণ বিষয়ক চুক্তির রাজনৈতিক ধারা ব্যবহার করে তাহলে আমাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি করবে না। দ্য হিন্দুকে দেয়া দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আসন্ন নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে তার কোনো আপত্তি নেই। বিএনপি চায় নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ অবশ্যই থাকতে হবে। এর মধ্য দিয়ে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তার রায় দিয়ে দিয়েছে। ড. ইউনূস বলেন, একটি বড় দলের মতামতকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। 

সাক্ষাৎকারে তিনি ভারত-বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলেছেন। দাবি তুলেছেন সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার। বলেছেন, তিনি স্বপ্ন দেখেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো একটি ইউনিয়নের। ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে ঢাকার যমুনায় তার সরকারি বাসভবনে ওই সাক্ষাৎকার দেন। এ সময় তিনি বলেন, ১০০ দিনে তিনি অর্থনীতি, আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করেছেন। অন্যদিকে হিন্দুদের ওপর হামলার বিষয়টিকে প্রপাগাণ্ডা বা অপপ্রচার বলে অভিহিত করেন। এই সাক্ষাৎকারে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন।  

দ্য হিন্দুর পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নেন সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দার। এখানে প্রশ্নোত্তর আকারে তা তুলে ধরা হলো-

প্রশ্ন: বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ১০০ দিন সম্পন্ন করেছেন আপনি। প্রধান দুটি ইস্যু আইনশৃংখলা এবং অর্থনীতি নিয়ে আপনার সরকারকে কীভাবে গ্রেড দেবেন? 
ড. ইউনূস: ভাল কথা। আমরা এখনও আইনশৃংখলার উন্নতি ঘটাচ্ছি। কিন্তু আমি বলবো না যে, আমরা ‘এ’ গ্রেড পেয়েছি। অন্য ইস্যুতে আমি বলবো এটা ‘এ-প্লাস’। কারণ, উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা বিধ্বস্ত একটি অর্থনীতি পেয়েছি। সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকিং সিস্টেম ধ্বংসের কাছাকাছি চলে এসেছিল। এটা এক ‘ক্রেজি’ ব্যাংকিং সিস্টেম। আছে মন্দ ঋণ, শতকরা ষাট ভাগ পেমেন্ট পরিশোধ করা হয়নি। ব্যাংক জানে না কীভাবে একে অন্যের সঙ্গে কাজ করতে হবে, কীভাবে কাস্টমারের সঙ্গে ‘ডিল’ করতে হবে এবং আরও অনেক কিছু। ফলে আমরা প্রায় অকার্যকর একটি আর্থিক ব্যবস্থা পেয়েছি। সেখান থেকে আমরা ব্যাংকিং সিস্টেমকে আবার নতুন করে গড়ে তুলে তাদেরকে কার্যকর করেছি। এখনও পারফেক্ট হয়নি, কিন্তু তারা সামনে অগ্রসর হচ্ছে। আমরা যখন দায়িত্ব নিই তখন বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিম্নমুখী ছিল। কিন্তু গত ১০০ দিনে মাসের পর মাস তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা পাওনা পরিশোধে সক্ষম হয়েছি। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের ভাবমূর্তি উন্নত করেছি। মুদ্রাস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছি। সবচেয়ে ভালো বিষয় হলো, আমরা বৈশ্বিক পর্যায় থেকে বিপুল পরিমাণের সাপোর্ট পেয়েছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। তারা মুক্ত বিনিয়োগে আরও সহযোগিতা ও অনেক কিছুর আশ্বাস দিয়েছে। আমি যখন জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়েছি তখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টসহ অনেক দেশের সরকার প্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তারা আর্থিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমাদের এমন কর্মকর্তারা আছেন, যারা বিনিয়োগকারীদের সমস্যাকে সমাধানে প্রস্তুত, যাতে তারা বাংলাদেশের ব্যুরোক্রেটিক জটিলতায় না পড়েন। সেটা হলো ওয়ান-স্টপ সার্ভিস, যেখানে আপনি সমস্যা সমাধান করতে পারবেন। ফলে আমি বলবো, দেশ খুবই ইতিবাচক পথে এগিয়ে যাচ্ছে। 

প্রশ্ন: সুনির্দিষ্টভাবে খুবই ইতিবাচক চিত্র বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আপনি কি ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন- উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়া নিয়ে, তিনি (ট্রাম্প) বাংলাদেশের সমালোচনা করে খুব কড়া বিবৃতি দিয়েছেন? যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমর্থন অব্যাহত থাকার বিষয়ে আপনি কীভাবে আস্থাশীল?
উত্তর: আমি মনে করি না বাংলাদেশ নিয়ে কোনো বিবৃতি দিয়েছেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। 
প্রশ্ন: তিনি সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে বিবৃতি দিয়েছেন। 
উত্তর: ভালো কথা। সেটা বাংলাদেশ এবং সংখ্যালঘুদের নিয়ে, হয়তো তাকে সঠিকভাবে তথ্য জানানো হয়নি। এটা একটা প্রপাগান্ডা, যা বিশ্বজুড়ে চলছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় যখন তিনি আসবেন, তখন তিনি বাংলাদেশ নিয়ে যে কথা বলেছেন তা থেকে পরিস্থিতি কতটা আলাদা, তা দেখে বিস্মিত হবেন। আমি এটা মনে করি না, কারণ যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট আসা মানে সব কিছু পাল্টে যাওয়া না। প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি এবং দেশের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক সাধারণত পরিবর্তন হয় না। যদি ট্রাম্প ২.০ তে কোনো পরিবর্তন হয়, তাহলে আমাদেরও মনে রাখতে হবে এখন একটি বাংলাদেশ ২.০ আছে, যাকে আমরা নতুন বাংলাদেশ বলি। ফলে আমরা অপেক্ষা করবো এবং দেখবো যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা আসেন এবং আমাদের বিষয়ে খতিয়ে দেখেন এবং আমাদের অর্থনীতি যদি ভালো করতে থাকে, তাহলে তারাও খুব আগ্রহী হবেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সরকারি পর্যায়ের ক্রেতা তারা। সুতরাং আমাদের পক্ষ থেকে খুবই ভালো সম্পর্ক থাকবে, যেটা বছরের পর বছর ধরে গড়ে উঠেছে। আমাদের আশা এই সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। 

প্রশ্ন: ট্রাম্পের বক্তব্যকে আপনি প্রপাগান্ডা বলেছেন। কিন্তু তিনি একাই এটা বলেননি। হিন্দু সম্প্রদায়কে টার্গেট করা হচ্ছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে হত্যা করা হচ্ছে, এমনকি সন্দেহজনক ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে এরই মধ্যে ভারত সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করে বেশ কিছু বিবৃতি দিয়েছে। এ বিষয়ে আপনার জবাব কী? 
উত্তর: (ভারতের) প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আমার প্রথম ফোনকল হয় (১৬ই আগস্ট)। এ সময়ে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে এবং আরও অনেক কিছু। জবাবে আমি তাকে খুব পরিষ্কারভাবে বলেছি, এটা একটা প্রপাগান্ডা। অনেক সাংবাদিক এখানে (বাংলাদেশে) এসেছিলেন। উত্তেজনা নিয়ে কিছু রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু মিডিয়ায় যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তেমন নয়। 

প্রশ্ন: তখন এর নেপথ্যে কারা বলে আপনার মনে হয়েছে? 
উত্তর: আমি জানি না। তবে এই অপপ্রচার বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। সব মামলায় একের পর এক খুব সিরিয়াস গ্রুপের একদল মানুষ ঢুকে পড়ছেন।

প্রশ্ন: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা ভীতিসন্ত্রস্ত বোধ করছেন। তারা মনে করছেন তাদেরকে টার্গেট করা হয়েছে। ফেসবুকে ভিডিও আছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা আছে যে, বাংলাদেশ হবে একটি মুসলিম দেশ। বর্তমান ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের আমরা বলতে শুনছি সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বদলে দেয়া হবে। আপনার সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশে পরবর্তীতে যা আসছে তা ইসলামের অধিক মাত্রায় উগ্রবাদ। এটা গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে আমরা দেখিনি। এসব সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করার জন্য আপনার সরকার কি কিছু করতে পারে? 
উত্তর: এটা (ভাবমূর্তি) কি আমাকে মানাবে? অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে থাকা প্রতিজন ব্যক্তি এক একজন মানবাধিকারকর্মী। তারা নিজেরা ভুগেছেন। অথবা তাদের কেউ পরিবেশবাদী কর্মী, লিঙ্গগত কর্মী এবং অন্য ধরনের অধিকারকর্মী। সুতরাং তারা সবাই অধিকারবাদী। তাদের সামনে যদি এ কথাগুলো আপনি বলেন, তাহলে তারা আপনার প্রতি চিৎকার করবেন, উপদেষ্টা পরিষদের প্রতিজন সদস্যের জীবন সম্পর্কে জানুন। 

প্রশ্ন: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে, আপনার উপদেষ্টা পরিষদের কারোরই ইসলামপন্থি এজেন্ডা নেই? 
উত্তর: তাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্পগুলোর দিকে তাকান। তারা উৎসর্গিত মানুষ। তারা নারী অধিকারকর্মী। 

প্রশ্ন: অন্য বিষয়েও উদ্বেগ আছে। মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ অধিকার-এর মতে, সেপ্টেম্বরে রাজনৈতিক সহিংসতায় আহত হয়েছেন ৮৪১ জন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন আটজন। আমরা শুনেছি অনেক সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল করা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, আপনার সরকারও অতীতের সরকারের আচরণ অব্যাহত রেখেছে। 
উত্তর: জনগণকে বিচার এবং তুলনা করতে দিন এই সরকার কী (কাজ) করেছে এবং অন্য সরকার কী করেছে। আমি বিতর্কে যাচ্ছি না। আমরা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছি। এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। অ্যাক্রিডিটেশন বিষয়ক যে আইন সেটা আমরা তৈরি করিনি। আমরা শুধু সেটা প্রয়োগ করেছি। এটা নিয়ে আপনি বিতর্ক করতে পারেন যে, এটা সঠিক প্রয়োগ হয়েছে কিনা। এই আইন পরিবর্তন করতে চাই আমি। ওটা এমন আইন, যা অন্য রকম শাসকগোষ্ঠীর অধীনে ছিল। 

প্রশ্ন: আর একটি উদ্বেগ আছে। তা হলো- বিগত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন ব্যক্তিদেরকে টার্গেট করা হবে রাজনৈতিক প্রতিশোধ নিতে। এটা হবে না নিশ্চিত করার জন্য আপনি কি কোনো ম্যাকানিজম রাখতে পারেন? 
উত্তর: আমি বলবো আইনের শাসনের জয় হোক। এটাই। 

প্রশ্ন: সংস্কারের জন্য আপনি অনেক কমিশন গঠন করেছেন। সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কোনো কমিশন নেই কেন? 
উত্তর: মানবাধিকার বিষয়ে আমাদের একটি কমিশন আছে। সংখ্যালঘুদের কেন আলাদাভাবে দেখা হবে? আমি (সংখ্যালঘু গ্রুপগুলোকে) বলেছি, আপনারা এ দেশের নাগরিক। সংবিধানে নিশ্চয়তা দেয়া প্রতিটি অধিকার আছে আপনাদের। আমরা চাই সংবিধানে দেয়া সব মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এবং সব অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। সুতরাং আমাদের সংবিধান বিষয়ক কমিশনে কে আছেন, সেদিকে তাকান। কে এর প্রধান (যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শিক্ষাবিদ ড. আলী রীয়াজ) এবং তারপর আপনি যা বলছেন তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করুন। অন্যথায় এর পুরোটাই অপপ্রচার। 

প্রশ্ন: যদি আপনার নিকটপ্রতিবেশী ভারতের মতো বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ মনে করে, তখন আপনার সরকার কি এই অপপ্রচারের বিষয়টি জনগণকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে? 
উত্তর: হতে পারে বিশ্বকে বোঝানোর মতো শক্তি বা আর্থিক শক্তি আমাদের নেই। 

প্রশ্ন: এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আপনি সাক্ষাৎ করেননি, যদিও টেলিফোনে আপনি কথা বলেছেন। 
উত্তর: হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত এটা হয়নি। যখন আমি জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে গিয়েছি, ততক্ষণ মোদি চলে গেছেন। বাকু’তে জলবায়ু বিষয়ক (কপ) সম্মেলনে যোগ দিয়েছি। কিন্তু তিনি সেখানে ছিলেন না। (থাইল্যান্ডে) বিমসটেক বাতিল করা হয়েছে। কমনওয়েলথ সিএইচওজিএম মিটিংয়ে আমাদের (দু’জনের) কেউই যোগ দিইনি। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা সাক্ষাৎ করবো না। আমরা শুধু প্রতিবেশীই নই, একই সঙ্গে ইতিহাস আমাদেরকে একত্রিত করেছে। ভূগোল আমাদেরকে একত্রিত করেছে। ভাষাগত সম্পর্ক আমাদেরকে একত্রিত করেছে। সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আমাদেরকে একত্রিত করেছে। ক্ষমতার প্রথম দিন থেকেই সার্ক’কে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে প্রস্তাব দিয়েছি। কেন এমন একটি সংগঠন মৃত অবস্থায় থাকবে? আমি এমনও বলেছি, সার্কের সব নেতার নিউ ইয়র্কে অন্তত ৫ মিনিটের জন্য হলেও সাক্ষাৎ করা উচিত এবং এর মধ্য দিয়ে একটি বার্তা দেয়া যে, আমরা এখনও সার্কে আছি। 

প্রশ্ন: বিমসটেক, বিবিআইএন-এ এখনও সহযোগিতা করে ভারত ও বাংলাদেশ। তাহলে কেন সার্ক? 
উত্তর: কেন সার্ক নয়? আমরা যত বন্ধু ও সম্পর্ক গড়তে পারবো, ততই ভালো। 

প্রশ্ন: কারণ হলো সার্কে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অমীমাংসিত বিরোধ দৃশ্যমান। 
উত্তর: সার্ক’কে সামনে এগুতেই হবে। মাত্র দুটি দেশের সম্পর্কের কারণে একটি পুরো সংগঠন অদৃশ্য হয়ে যাওয়া উচিত হবে না। আমরা রেজ্যুলুশন পাস করাতে পারি। এজেন্ডা থেকে ভারত-পাকিস্তান বিষয়ক যেকোনো এজেন্ডা বাদ রাখতে পারি। কিন্তু সার্কের ইতি ঘটাতে পারি না। 

প্রশ্ন: সন্ত্রাসবাদের শেষ না হওয়া পর্যন্ত সার্ক’কে স্থগিত রাখায় ভারতকে ২০১৬ সালে সমর্থন দিয়েছিল বাংলাদেশ। এটা কি একটা ভুল ছিল? 
উত্তর: আমরা যদি এমন শর্ত জুড়ে দিই, তাহলে কোনো সম্পর্কই টিকে থাকবে না কখনো। দুটি সদস্য দেশের মধ্যে সম্পর্কের কারণে কেন পুরো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো দুর্ভোগে থাকবে? 

প্রশ্ন: ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়টি যখন আসে, তখন ৫ই আগস্টের ইভেন্টে তা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? এটা কি একটি আঘাত ছিল? 
উত্তর: কেন এটা হবে? বাংলাদেশ যখন এমন একটি শাসন থেকে স্বাধীন হয়েছে, যেখানে মানুষ দুর্ভোগের শিকার হয়েছে, এত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, এত মানুষ গুম হয়েছেন, এত বেশি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে- তখন বাংলাদেশের এই স্বাধীনতাকে একটি বন্ধুপ্রতীম দেশ হিসেবে উদযাপন করা উচিত ছিল ভারতের। আমাদের তরুণদের সঙ্গে যোগ দিয়ে একসঙ্গে উদযাপন করা উচিত ছিল তাদের, যেমনটা অন্য অনেক দেশ করেছে। 

প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, ৫ই আগস্ট থেকে ভারতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি জটিলতা সৃষ্টি করেছে। 
উত্তর: (সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা) ভারতে বসবাস করছেন, ন্যূনতম কিছু সময় ধরে। এটা কোনো সমস্যা নয়। বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলা সমস্যা। তিনি বাংলাদেশি লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন এবং এটা রাজনীতি। তিনি অব্যাহতভাবে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন, এটা সমস্যা। 

প্রশ্ন: কীভাবে?
উত্তর: তিনি তাদেরকে (তার লোকজন) ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন। ঢাকা ও অন্য শহরগুলোর রাস্তায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ করার আহ্বান জানাচ্ছেন। তার অডিও বার্তা প্রচার করা হচ্ছে। তাদেরকে (তার লোকজন) তিনি বলছেন- যুক্তরাষ্ট্রে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ছবিযুক্ত প্লাকার্ডকে (ঢাল হিসেবে) বহন করতে। এর ফলে যখন পুলিশ তাদেরকে থামাবে, তখন তারা বলবে- বাংলাদেশের (বর্তমান) সরকার যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী। এটা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাইরে বিষয়ে হস্তক্ষেপ। 

প্রশ্ন: তাকে (হাসিনা) ফেরত আনার অনুরোধ জানিয়ে ইন্টারপোলের দ্বারস্থ হয়েছে আপনার সরকার। কেন আপনারা সরাসরি ভারতের প্রতি অনুরোধ করলেন না? এক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় মেকানিজম সক্রিয় করার সুযোগ আছে। 
উত্তর: তাকে (হাসিনা) ফেরত আনতে সব রকম আইনি ব্যবস্থা ব্যবহার করবো আমরা। 

প্রশ্ন: এখন পর্যন্ত আপনার সরকার তাকে ফেরত দেয়ার জন্য প্রকৃতপক্ষে কোনো অনুরোধ জানায়নি। প্রত্যর্পণ বিষয়ক চুক্তি আছে তো। 
উত্তর: আমি মনে করি এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ আছে, আমরা সেটার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। কিন্তু এখনও আমরা সেই পর্যায় পর্যন্ত আসতে পারিনি। 

প্রশ্ন: ভারত যদি অনুরোধ না রাখে, যদি (চুক্তিতে থাকা) রাজনৈতিক বিচারের ধারাটি সক্রিয় করে, তখন কী হবে? 
উত্তর: আপনি কি বলছেন, ভারত এই চুক্তি লঙ্ঘন করবে? হ্যাঁ, (চুক্তিতে) এমন ধারা আছে। কিন্তু ভারত সরকার যদি তাকে (হাসিনা) সেখানে রাখার জন্য সেসব ধারা ব্যবহার করে, তাহলে তা আমাদের মধ্যে খুব ভাল সম্পর্ক তৈরি করবে না। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ অল্প সময়ের। ফলে এই সরকার ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সব সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম না-ও হতে পারে। তবে আমাদের পরে যে সরকার আসবে তারা তো এটাকে ভুলে যাবে না।

প্রশ্ন: অন্য ইস্যুগুলোতে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক মসৃণভাবে অগ্রসর হচ্ছে বলে কি আপনি দেখতে পান? সম্প্রতি আমরা বিদ্যুৎ সংযোগ, বাণিজ্যিক সংযোগসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কিছু উদ্যোগ দেখেছি। 
উত্তর: আমাদের স্বপ্ন হলো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (যেখানে চলাচলে স্বাধীনতা  ও বাণিজ্যে স্বাধীনতা আছে) মতো একটি সম্পর্ক কল্পনা করা। আমরা এই দিকেই অগ্রসর হতে চাই। আমরা কোন পথে অগ্রসর হবো এ বিষয়ে আপনি যেটা উল্লেখ করেছেন তা ভালো লক্ষণ এবং নির্দেশনা। কিন্তু তার চেয়েও বেশি আমরা অর্জন করতে চাই, যেটা হবে খুব ঘনিষ্ঠ  সম্পর্কের একটি ইউনিয়ন। আমরা জন্মেছি একত্রিত হওয়ার জন্য। আমরা তো টুইন (বা জমজ)। 

প্রশ্ন: আপনার সরকারের সময় কতটা সংক্ষিপ্ত? কখন নির্বাচন হবে? 
উত্তর: আমাদেরকে যখন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তখন খুব পরিষ্কার করে আমাদেরকে বলা হয়েছে যে, আমরা শুধুই একটি অন্তর্বর্তী সরকার হবো না। অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে থাকে নির্বাচন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের দায়িত্ব। আমাদেরকে বলা হয়েছে যে, আমাদের বড় দায়িত্ব হলো বাংলাদেশ ২.০-এর জন্য সংস্কার করা। আমরা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে চাই না। আমরা ওইসব ফর্মুলা সঙ্গে নিয়ে এসেছি। প্রথম দিন থেকেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এটা আলাদা একটি প্রক্রিয়া। সংস্কারের অন্যান্য প্রক্রিয়াও সমান্তরালে চলছে। এখন, আমরা প্রথমেই নির্বাচন কমিশন সৃষ্টি করেছি। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এর প্রক্রিয়ার খসড়া করা হয়েছে। সামনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমরা এ সম্পর্কে ঘোষণা দিতে পারবো বলে আশা করি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি নিরপেক্ষ এনটিটি গঠন করবেন। কিন্তু অন্য সব সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত তারা নির্বাচন করতে পারবেন না। সংবিধান সংশোধনের জন্য কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে দ্বিপক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট হবে কিনা, পার্লামেন্টে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকবে কিনা, শর্তাবলী এবং আরও অনেক বিষয়ে। আমি বলবো (নির্বাচনের) ট্রেন স্টেশন ছেড়ে গেছে। এই চলার পথে পথে আমাদেরকে ট্রেন থামাতে হবে। জানতে হবে কোনপথে যেতে হবে এবং এ জন্যই আমাদেরকে সংস্কার কমিশনেনর কাছে ফিরে যেতে হবে। 

প্রশ্ন: এতে কি কয়েক বছর সময় লাগবে? 
উত্তর: আমার কোনো ধারণা নেই। জনগণ একটি নির্বাচিত সরকার দেখতে চায়। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঐক্যমতের ভিত্তিতে আমরা এগিয়ে যাবো। 

প্রশ্ন: নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুমতি দেয়া হবে কিনা?
উত্তর: এরই মধ্যে এ ঘোষণা হয়ে গেছে। রাজনৈতিক দলের বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি। বিএনপি সেটা করেছে। তারা বলেছে, নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ অবশ্যই থাকতে হবে। সুতরাং তারা এরই মধ্যে রায় দিয়ে দিয়েছেন। দেশের একটি বড় দলের মতামতকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। 

প্রশ্ন: তাহলে আওয়ামী লীগের (নির্বাচনে) অংশগ্রহণ নিয়ে আপনার কোনো আপত্তি নেই? 
উত্তর: আমি কোনো রাজনীতিক নই যে, একটি পার্টি বা অন্য আরেকটি পার্টিকে বেছে নেবো। আমি শুধু রাজনীতিবিদদের ইচ্ছা পূরণ করছি। 

প্রশ্ন: কয়েক বছর আগে (২০০৭ সালে) আপনি নিজের একটি দল চালু করার চেষ্টা করেছিলেন। 
উত্তর: ওটা ছিল মাত্র ১০ সপ্তাহের। তারপর আমি সংবাদ সম্মেলন করেছি এবং সব বন্ধ করে দিয়েছি। অনেক মানুষ আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, জনগণের জন্য একটি পরিবর্তন প্রয়োজন। এমনকি আমরা পার্টির নামও দিয়েছিলাম এবং এ পর্যন্তই। তার পর থেকে বাকি জীবনভর একটি রাজনৈতিক দল করার জন্য আমাকে অভিযোগ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। 

প্রশ্ন: আপনি নিজেকে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখেন না? 
উত্তর: আমি নিজেকে কখনোই একজন রাজনীতিক হিসেবে দেখি না।

Back to top button