অপরাধদুর্নীতি

ডেসটিনি ফর্মুলায় মাসুদ-সারমিনের যুগলবন্দি প্রতারণা

নিজস্ব প্রতিবেদক:
অস্তিত্ববিহীন জমিতে ৩ কাঠার প্লট। প্রতি কাঠার দাম ৬লাখ ৮০হাজার, কাঠা প্রতি বুকিং মানি ১০হাজার, ডাউন পেমেন্ট ৭ পার্সেন্ট, ৬০ কিস্তিতে মুল্য পরিশোধ, মাসিক ২১হাজার ১শ টাকা হারে ৫৯ কিস্তিতে পরিশোধ প্রায় ১৩লাখ, অবশিষ্ট টাকা ৬০তম কিস্তিতে পরিশোধ করলেই হবেন স্বপ্নধরা আবাসনের গর্বিত প্লট মালিক। এককালীন কিনলে মোট মুল্যের ১০ পার্সেন্ট কম পাবেন। স্বপ্নধরার এমন আরো অনেক চটকদার বিজ্ঞাপনেই ভাসঁছে নেট-দুনিয়া। ফেসবুক, ইউটিউব, টিভি-পত্রিকায় সহ রাস্তার মোড়ে মোড়ে টাঙ্গানো হয়েছে কোম্পানির বড় বড় বিলবোর্ড বিজ্ঞাপন। এসব আয়োজনের মাধ্যমে মানুষকে আকৃষ্ট করার পাশাপাশি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিকে অর্থায়ন করে তাদের দ্বারা আয়োজন করা হয়- “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে স্বপ্নধরার পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও আজীবন সন্মাননা প্রাপ্ত শিল্পী কুশলীদের বিশেষ সন্মাননা”। তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ থেকে শুরু করে গৃহায়ন ও গনপুর্ত প্রতিমন্ত্রী শরিফ আহমেদ হাত থেকে দেয়া হয়েছে- “হাউজিং এন্ড বিল্ডিং গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত পরিবেশ বান্ধব আবাসন নির্মাণে বিশেষ অবদান রাখায় স্বপ্নধরাকে সম্মাননা স্মারক”। ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা হয়েছে মন্ত্রী, এমপি, ওসি-ডিসি, নায়ক-নায়িকা সহ ভিআইপি সিআইপিদের পাশে দাড়িয়ে এমন অসংখ্য ছবি। আর ছবি গুলো কোম্পানীর ফেসবুক ওয়ালে পোষ্ট করে ক্যাপশন লেখা হয়েছে তাদের সখ্যতার গভীরতা। এসব ছবির মাধ্যমে মানুষের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে কোম্পানী যদি খারাপ হতো, তাহলে মন্ত্রী-এমপি ক্যাটাগরির মতো ভিআইপি-সিআইপি লোকেরা কি আমাদের কোম্পানীতে আসতো। এমন সব কথা-বার্তা বলে ফাঁদে আটকানোর একটাই উদ্দেশ্য প্লট বুকিং দেয়া। বুকিং দিলেই পকেটে আসবে কারী কারী টাকা। তবে এমন ধারাবাহিক কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়ার কোন আইন-কানুন আমাদের দেশে আছে কিনা কেউ বলতে পারে না। ডেসটিনি বা ই-ভ্যালি মানুষের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পরে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের মনে হয়েছিলো তাদের কার্যক্রম অবৈধ। পরবর্তীতে সংবাদ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার চাপে পরে ডেসটিনির রফিকুল আমীন ও ই-ভ্যালির রাসেলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু জনগনের কোটি কোটি টাকা হাওয়া। অথচ শুরুতে ব্যবস্থা নিলে জনগনের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যেতো না। শুধু ডেসটিনি বা ই-ভ্যালির মতো কোম্পানীই নয়, এ যাবৎ এমন আরো শতাধিক কোম্পানী জনগনের সাথে চিটিং করে মোটা দাগের টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পরে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রশাসনে চোখের সামনেই চলছে তাদের প্রতারনা। রাষ্ট্রীয় আইনে একটি কোম্পানীর কোন অনুমোদনই নাই। অথচ ঐ কোম্পানীটি মন্ত্রীকে দাওয়াত দিয়ে এনে অনুষ্ঠান করে মিডিয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। মন্ত্রীর মনেই হচ্ছে না সে কার বাড়ীতে দাওয়াত খাচ্ছে। আসলে রহস্যটা কি?। রহস্যের গভীরতা অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ডেসটিনি ফর্মুলায় স্বপ্নধরা এ্যাসেটস্ ডেভেলপন্টে লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদুর রশিদের নিখুত প্রতারণা। কিস্তিতে প্লট বিক্রির ফাঁদে ফেলে আগামী ৩০ সালের মধ্যে ৫হাজার কোটি টাকার হাতিয়ে নেয়ার মিশনে মাঠে নেমেছে তার স্বপ্নধরা। মাসিক সহজ কিস্তিতে প্লট বুকিং। টার্গেট ৫লাখ প্লট বুকিং। এজন্য চলছে টিভিতে পত্রিকায় বাহারি বিজ্ঞাপণ আর দেশ বিদেশের ভিআইপি সিআইপি স্পটে রকমারী আবাসন মেলা। অন্যের জমিতে প্লটের লে-আউট প্ল্যান বানিয়ে প্লট বুকিং দেয়া হচ্ছে। অথচ জমিওয়ালা এর কিছুই জানে না। কোম্পানির লে-আউট ডিজাইনে লোকজনকে দেখানো হচ্ছে শতশত একর জমিতে তাদের হাজার হাজার প্লটের মালিকানা। যার পুরোটাই ঠকবাজিকে ভরপুর প্রতারণা। প্রতারনা এখন আমাদের দেশে এক শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষের কাছে একটি পেশায় পরিনত হয়ে গেছে। ক্লিন সেভ, দামী স্যুট-টাই পড়ে গুলশান বনানী মতিঝিলে এসি ওয়ালা অফিস নিয়ে, ওসি ডিসি এমপি মন্ত্রীর পাশে দাড়িয়ে ছবি তুলে, সাহেদের মতো রাতের টকশোতে বড় বড় নীতি কথার ফুলজুড়ি ছড়িয়ে, সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। ধরা খাইলে এদেরকে বলা হয় প্রতারক জাদুকর সাহেদ আর ধরা না খাইলে এরা বিজনেসম্যান মাসুদ। অনুমোদনহীন স্বপ্নধরা এ্যাসেটস্ ডেভেলপন্টে লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এই মাসুদ-অর-রশীদ। দেখতে খুবই সুদর্শন। তবে একজন ক্ল্যাসিক্যাল প্রতারক। ভাড়া নিয়ে অন্যের জমিতে কোম্পানীর সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে মাসিক কিস্তিতে প্লট বুকিংয়ের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সরেজমিনে অনুসন্ধানে গিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের শ্রীনগর ছনবাড়ী-ষোলঘর নামকস্থানে স্বপ্নধরা এ্যাসেটস্ ডেভেলপন্টে লিমিটেডে প্লট ব্যবসার নামে অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে চটকদার সাইনবোর্ড লাগিয়ে জনগনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে হরদম চালিয়ে যাচ্ছে প্রতারণা। স্বপ্নধারা আবাসন কোম্পানী এ যাবৎ নিজেদের কোম্পানীর নামে শ্রীনগর উপজেলার বিভিন্ন মৌজায় ৫/৬ বিঘা জমি কিনেছেন বলে জানান স্থানীয়রা। অথচ কোম্পানির লে-আউট প্ল্যানের ডিজাইনে দেখানো বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হচ্ছে তাদের পরিমান কয়েক হাজার বিঘা। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে কোন আবাসন কোম্পানীর অনুমোদন নিতে হলে ঐ কোম্পানীর নামে কমপক্ষে ২ হাজার বিঘা জমি থাকতে হয়। যে কারনে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন তালিকায় এই কোম্পানীটি নাম ঠিকানা খুজে পাওয়া যায়নি। তবে কোম্পানির অনুমোদন প্রাপ্তির জন্য গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধন করা হলেও তাতেই কেটে গেছে অন্তত ১৫ বছর। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের শর্তাবলী পূরন করতে না পারায় মিলছে না অনুমোদন। তাহলে অনুমোদন ছাড়া এই কোম্পানী কার্যক্রম কতটুকু বৈধতা রাখে। তবে মাসুদের মতো সুদর্শন প্রতারকরা এটাকে বৈধ বলেই প্রচার করেন। এ কারনে মাসুদের এই কোম্পানীটি প্রতিষ্ঠালগ্ন সময় হতে রাজধানী ঢাকা শহরের নামিদামী হোটেল ও ভিআইপি লাউঞ্জ ভাড়া নিয়ে জমকালো মেলার আয়োজন করে আসছে। সহজ কিস্তিতে এ পর্যন্ত ২০ হাজারের উপরে প্লট বুকিং দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানা গেছে। আগামী ৩০ সালের মধ্যে আবাসন ব্যবসার লাইসেন্সবিহীন এই কোম্পানীটি ৫ লাখ প্লট বিক্রি করার টার্গেট নিয়ে মাঠে কাজ করছে। যার পুরো পরিকল্পনাটাই ঠকবাজি আর প্রতারণায় ভরপুর। কারন এই মুহুর্তে স্বপ্নধরা সহজ কিস্তির মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে প্লট বুকিং দিয়ে যেই টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, সেই টাকা বা প্লট অদুর ভবিষ্যতে কখনোই গ্রাহক ফেরত পাবেনা বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে। আর আসল ঘটনা হলো এই মুহুর্তে যারা স্বপ্নধরার নিকট জমি ভাড়া দিয়েছে সাইনবোর্ড লাগানোর জন্য তাদের জমিও একদিন এই হায় হায় কোম্পানী গ্রাস করবে। যা ইতিপূর্বে দেশের নামিদামী আবাসন কোম্পানীগুলো জনগনের জমি জোড়পূর্বক দখল করে নিয়েছে। জনগনের টাকা হাতিয়ে নিয়ে ঐ টাকা দিয়ে আবার জনগনের উপরই নির্যাতন করার বহু রেকর্ড ভূমিদস্যু কোম্পানীগুলো বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে। জনগনকে নি:স্ব করার এক ডিজিটাল ফাঁদ হচ্ছে স্বপ্নধরা আবাসন কোম্পানী। এই কোম্পানীর চেয়ারম্যান, এমডি সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশের বড় বড় দুর্নীতিবাজ গডফাদারদের নিকট আত্মীয়। তাদের ক্ষমতার জোড় অনেক উপরে। তাদের অন্যায়ে প্রতিবাদ করে কেউ সুবিধা করতে পারেনা। তারা একবার টাকা হাতিয়ে নিজেদের পকেটে নিতে পারলে ঐ টাকা আর কখনোই কেউ ফেরত আনতে পারবে না। কারন তারা খুব সুক্ষ্ম কৌশলে জনগনের নিকট থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। স্বপ্নধরা প্লট বুকিংয়ের মাধ্যমে জনগনের নিকট থেকে যেই টাকাটা নিচ্ছে তার বিপরীতে জনগনকে দিচ্ছে কোম্পানীর নামের উপরে এক টুকরো রশিদ ভাউচার। আর এই ভাউচার তাবিজ বানিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখা যাবে। কোম্পানী টাকা বা জমি বুঝিয়ে না দিলে এই তাবিজ ব্যবহার করে জনগন হাজার বছরেও তার সমস্যার সমাধান পাবে না। কারন ডেসটিনিতে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে এমন তাবিজ অন্তত ২০লাখ গ্রাহক পেয়েছে। ডেসটিনির তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে ২০ লাখ গ্রাহক শুকিয়ে শুটকি মাছ হলেও ডেসটিনির কর্মকর্তারা কিন্তু খুবই আরাম আয়েশে দিন পার করছে। এদের নামে মামলা হয়েছে ঠিকই তবে এরা জনগনের থেকে হাতিয়ে নেয়া ঐ টাকা খরচ করে জামিনে বেরিয়ে এসে এখন আছে মহা সুখে। স্বপ্নধরাও ঠিক একইভাবে জনগনকে নি:স্ব বানাবে এতে কোন সন্দেহ নেই বলে জানিয়েছে স্বপ্নধরায় কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, পত্রপত্রিকায় বা টিভি চ্যানেলগুলোতে স্বপ্নধরা আবাসনের চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে যারা তাদের তিল তিল করে জমানো টাকা স্বপ্নধরা হাতে তুলে দিচ্ছে, ভবিষ্যতে তাদের চোখে কান্না করার মতো পানিটুকু থাকবেনা। তাই সচেতন মহলের প্রতি হুশিয়ারী-স্বপ্নধরার প্রতারণা থেকে সাবধান।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button