ডেনমার্কে আনন্দময় কর্মজীবনের রহস্য কী
ডেনমার্কে কাজ করতে কেমন লাগে?—এই প্রশ্নের জবাবে গ্যাব্রিয়েল হোসেস একটি শব্দ সাতবার পুনরাবৃত্তি করেছেন। আর ওই শব্দটি হলো ‘বিশ্বাস’।
কোপেনহেগেনের একটি প্রযুক্তি সংস্থার জন্য কাজ করেন গ্যাব্রিয়েল হোসেস। তিনি বলেন, ‘এখানে কেউ আপনাকে নিয়ন্ত্রণ বা উঁকি দিয়ে আপনাকে দেখার চেষ্টা করে না। দিনে আপনি আট বা ৯ ঘণ্টা কাজ করছেন, তা দেখার জন্যও বসরা আসছেন না। তাঁরা শুধু দেখেন, আপনি কাজটা ঠিকঠাকমতো শেষ করছেন কি না। এ কারণে ডেনমার্কের ওপর অনেক আস্থা আছে। চাকরিতে আমি কোনো শ্রেণিবিন্যাস অনুভব করি না। এখানে সবকিছুই খুব গণতান্ত্রিক।’
দুই কন্যার বাবা হোসেসের কাছে এটা কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয় যে ধারাবাহিকভাবে কর্ম-জীবনের ভারসাম্য র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে ডেনমার্ক আছে।
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) সাম্প্রতিকতম বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, ডেনমার্কবাসীদের মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশকে সপ্তাহে ৫০ বা তার বেশি ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এটি বিশ্বের গড় ১০ দশমিক ২ শতাংশ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কম অনুপাত। এর বিপরীতে যুক্তরাজ্যের জন্য চিত্রটি ১০ দশমিক ৮ শতাংশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ।
‘দ্য আর্ট অব ড্যানিশ লিভিং’ বইয়ের লেখক মেইক উইকিং দীর্ঘদিন থেকে নিজের দেশকে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাঁর ভাবনা, অন্য দেশগুলোকে তাঁদের কর্মক্ষেত্রের নীতিগুলো অনুকরণ করা উচিত।
বিবিসিকে মেইক উইকিং বলেছেন, ‘কর্মক্ষেত্রে ড্যানিশরা সত্যিই খুশি। প্রায় ৬০ শতাংশ ড্যানিশ জানিয়েছেন, লটারি জিতলে এবং আর্থিকভাবে স্বাধীন হলেও তাঁরা কাজ চালিয়ে যাবেন।’
ড্যানিশ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক দ্য হ্যাপিনেস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান উইকিং ডেনমার্কে একটি শক্তিশালী কর্মজীবনের ভারসাম্য তৈরি করতে সহায়তা করবে এমন বেশ কয়েকটি নীতির কথা বলেছেন। এর মধ্যে আছে—সরকারি ছুটির পাশাপাশি বছরে ন্যূনতম ৫ সপ্তাহের সবেতন ছুটির অধিকার। যুক্তরাজ্যে অধিকাংশ কর্মী বছরে ৫ দশমিক ৬ সপ্তাহের সবেতন ছুটি পান। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এটি মাত্র ১১ দিনের মতো কম হতে পারে।
ডেনমার্কে টানা ছয় মাসের মাতৃত্ব ও পিতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয় ছবি: লিংকডইন থেকে নেওয়া
ডেনমার্কে টানা ছয় মাসের মাতৃত্ব ও পিতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয়। আর যুক্তরাজ্যে বাবা অথবা লালনপালনকারী (নন–বার্থিং পার্টনার) সাধারণত এক থেকে দুই সপ্তাহ সবেতন ছুটি পেয়ে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বাবা–মায়ের অবৈতনিক ছুটির ক্ষেত্রে একটি ফেডারেল গ্যারান্টি আছে। দেশটিতে ফেডারেল কর্মীরা ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত সবেতন ছুটি পেতে পারেন।
উইকিং বসদেরকে তাঁদের কর্মীদের সঠিক কাজ করার জন্য বিশ্বাস করার ধারণাটি উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কোপেনহেগেনের টিভোলি গার্ডেন অ্যামিউজমেন্ট পার্কের কর্মীদের উদাহরণ দিয়েছেন। যেখানে তাঁরা থ্রি–মিটার নিয়ম অনুসরণ করেন।
উইকিং বলেন, ‘এই ধারণাটি হলো, আপনি তিন মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে সবকিছুর প্রধান নির্বাহী (সিইও)। এই তিন মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে আবর্জনা দেখতে পেলে তা তুলে নিন; এবং যদি কোনো অতিথিকে কিছু খুঁজতে দেখেন, তাহলে একটু থেমে তাঁদের জিজ্ঞাসা করুন যে আপনি কোনো সাহায্য করতে পারেন কিনা।’
উইকিং আরও বলেন, কর্মীরা যখন কর্মক্ষেত্রকে নিজের জায়গা বলে ভাবতে থাকে, তখন এটি তাঁদের ক্ষমতায়িত এবং প্রশংসা বোধ করতে সহায়তা করতে পারে। এতে তাঁদের কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে একটি সুস্থ ধারণা তৈরি হয়।
ডেনমার্কে দিনে আপনি আট নাকি ৯ ঘণ্টা কাজ করছেন, তা দেখার জন্য বসেরা নজরদারি করেন না ছবি: লিংকডইন থেকে নেওয়া
কোপেনহেগেন বিজনেস স্কুলের ম্যানেজমেন্ট, সোসাইটি অ্যা কমিউনিকেশন বিভাগের অধ্যাপক জেনিন লেসকে বলেছেন, ডেনমার্কে এমন কাজের সংস্কৃতি নেই যেখানে আপনি কঠোর পরিশ্রম করেন তা দেখানোর জন্য সারা দিন বা সন্ধ্যা পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতে হবে। বরং এখানে বিষয়টা অনেক নমনীয়। যেমন—কর্মদিবসেও কর্মীদের সন্তানকে স্কুল বা ডে–কেয়ার থেকে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া হয়। আর অফিস সময় পাঁচ বা ছয়টায় শেষ হতে হবে—এমনও না।
গ্যাব্রিয়েল হোসেস লক্ষ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে কিছু নিয়োগকর্তা তাঁদের কর্মীদের সপ্তাহান্তে ই–মেইল বা খুদেবার্তার জবাবের জন্য কীভাবে পাওয়া যাবে, সেই চিন্তা করেন। এ ধরনের ওভারটাইম কর্মীর ইতিবাচক কর্মজীবনের ভারসাম্য সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বেমানান।
হোসেস বলেন, ‘সপ্তাহান্তে যদি এভাবে আমার কাজ আশা করা হয়, তবে এটি আমার জন্য ভয়াবহ হবে। আর এ কারণে আমি সম্ভবত চাকরি পরিবর্তন করে ফেলব। তবে এখনও পর্যন্ত আমার বা আমার পরিচিত কারও সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেনি।’
কোপেনহেগেন-ভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্পার্কফোর্সের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ক্যাসপার রাউচম্যান বলেছেন, তাঁর শিথিল নেতৃত্বের নীতি অধিকাংশ ডেনমার্কবাসীর কাছে পরিচিত হবে। তিনি বলেন, ‘অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে আমার অনুমতি নেওয়ার দরকার নেই। আর কেউ আমার এই শিথিলতার সুযোগও নেয় না।’
রাউচম্যান বলেন, ড্যানিশ সংস্কৃতিতে বিশ্বাস ধারণাটি গেঁথে আছে। তিনি ডেনমার্কের উদার কল্যাণ রাষ্ট্রের কথাও তুলে ধরেন। এই রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠানের অপ্রয়োজনীয় কর্মীদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘আপনার যদি চাকরি চলে যায়, তাহলে সাহায্য করার জন্য এই দেশে সরকার আছে।’
রাউচম্যান বলেছেন, এমন ব্যবস্থার কিছু খারাপ দিক আছে। সেউ কেউ এই নিরাপত্তা জালের ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে পারে। এতে অনেককেই ঝুঁকি নিতে হয় না। এ কারণে এই দেশে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় উদ্যোক্তা কম।
মার্কিন মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ সামান্থা স্যাক্সবি বলেছেন, ডেনমার্কের কর্ম-জীবনের ভারসাম্য এত ভালো কারণ দেশটি ‘সম্মিলিত কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেয়’। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তিগত অর্জন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার ওপর জোর দিয়েছে, যা অসাধারণ উদ্ভাবনকে চালিত করেছে। কিন্তু এতে প্রায়ই কর্মজীবনের ভারসাম্য ঠিক থাকে না।
তবে ইউএস ন্যাশনাল হিউম্যান রিসোর্সেস অ্যাসোসিয়েশনের বিপণন পরিচালক সামান্থা স্যাক্সবি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্য কোথাও কোম্পানিগুলো ডেনমার্ক বা অন্যান্য নর্ডিক দেশগুলোর নেতৃত্বকে অনুসরণ করতে পারে।