সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্ক, লোকালয়ে বন্যহাতি!
ইসমাইল হোসেন চৌধুরী, চট্টগ্রামঃ
চট্টগ্রামের আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও বাঁশখালী উপজেলার ৪০টিরও বেশি গ্রামের মানুষ হাতি আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ওইসব এলাকার বনাঞ্চল ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হতে থাকায় লোকালয়ে নেমে আসছে হাতি। খাবারের সন্ধানে পালাক্রমে লোকালয়ে হানা দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে বন্য হাতির দল।
কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠানের দৌলতপুর, দক্ষিণ শাহ মীরপুর এবং আনোয়ারার গুয়াপঞ্চক, বৈরাগ, মোহাম্মদপুর, ফকিরখিল, বটতলী, হাজিগাঁও এবং গুচ্ছগ্রামে গত ৬ বছরে ৩ শতাধিক পরিবারের বসতঘর ভাঙচুর ও শতাধিক একর জমির ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বন্যহাতির তাণ্ডবে। গত ১০ বছরে হাতির আক্রমণে ১৬ জন মারা গেছে। বাঁশখালী উপজেলায় গত কয়েক বছরে হাতির তাণ্ডবে ১৫ জনের মৃত্যু ও অন্তত ৫০ জন কৃষক আক্রান্ত হয়েছে। গত ১০ বছরে ১৯টি হাতির মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে, হাতির আক্রমণের ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন কোরিয়ান ইপিজেডের প্রায় ৩৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। জানা গেছে, সর্বশেষ দায়িত্বরত অবস্থায় মরিয়ম আশ্রম এলাকায় মো. হাকিম নামের এক সিকিউরিটি গার্ডের ওপর হামলা করে বন্যহাতির দল। আহত সিকিউরিটি গার্ডের বাড়ি আনোয়ারা উপজেলার চাতরী গ্রামে। তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর আগে গেল বছরের ৬ সেপ্টেম্বর কেইপিজেডের গলফ কোর্সে হাতির আক্রমণে ডি হাং কং নামে কোরিয়ান একজন বিনিয়োগকারী গুরুতর আহত হন।
জানা যায়, কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) বিদেশি নাগরিকসহ প্রায় ৩৩ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মস্থল। প্রতিদিন রাতে কোরিয়ান ইপিজেড এলাকায় হানা দিচ্ছে বন্যহাতির পাল। যার ফলে সন্ধ্যায় কারখানা ছুটি হলে আতঙ্কে থাকেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। আতঙ্কে রাত কাটান কেইপিজেডের আশেপাশের এলাকার মানুষও। এরইমধ্যে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের নিরাপত্তা এবং এলাকাবাসীর জান-মালের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক চিঠি দিয়েছেন।
কেইপিজেডে কর্মরত ঝর্ণা দাশ নামের এক নারীশ্রমিক বলেন, ‘কাজ শেষে বাসায় ফেরার সময় ভয়ে ভয়ে যেতে হয়। কখন জানি হাতির পাল সামনে পড়ে’।
এবিষয়ে জানতে চাইলে কেইপিজেড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘হাতি তাড়ানোর বিষয়ে ২০২২ সালে ৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আরেকটি কমিটি এসে কেইপিজেড পরিদর্শন করে যায়। কেইপিজেডের পক্ষ থেকে বেতন দিয়ে এআরটি টিম রাখা হয়েছে। এছাড়া হাতিগুলোর কারণে কেইপিজেডের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিনিয়োগকারীরাও ভয়ে আছে। তাই এটা কেইপিজেডের জন্যও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সরকার উদ্যোগ নিলে হাতি অপসারণে সব ধরনের সহযোগিতা করবে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ’।
স্থানীয়রা জানান, হাতিগুলো কর্ণফুলী এলাকায় এসেছে প্রায় ১০ বছর আগে। বিভিন্ন সময় তারা লোকালয়ে নেমে আসে। জমির ফসল ও জানমালের ক্ষতিসাধন করে। কোনভাবেই হাতিগুলোকে দমানো যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনের কাছে কয়েক দফা নালিশও করা হয়েছে।
স্থানীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে হাতগুলোর বিষয়ে সম্প্রতি বেশ কয়েকবার সভা হয়েছে। সেখানে মাননীয় উপদেষ্টাও উপস্থিত ছিলেন। প্রথমে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে আরেকটি সাব কমিটি করা হয়, যাদের দ্রুত সময়ে কিছু নির্দেশনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রায় নির্দেশনা প্রতিপালন হয়েছে। এরমধ্যে একটি হলো চায়না ইকোনমিক জোনের পাশে সরকারি জায়গা হাতির বসবাসের উপযুক্ত করা এবং সেখানে জলাধার খনন করার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়াও পাঁচটি এলিফ্যান্ট রেসকিউ টিম গঠন করা হয়েছে। তারা সার্বক্ষণিক কাজ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাতিগুলোকে সংরক্ষণের জন্য আমাদের নিয়মিত টহল দল কাজ করছে। স্থানীয় জনগণকে আমরা প্রতিনিয়তই সচেতন করছি। যদি হাতিগুলো কারও সম্পদের ক্ষতিসাধন করে, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়াও হাতির আক্রমণে কেউ গুরুতর আহত হলে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে, যদি মারা যান তাহলে ৩ লাখ টাকা পাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার।’
আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। এখানে বিভিন্ন সময়ে হাতির আক্রমণের শিকার অনেক ব্যক্তি আমাদের কাছে বিচার নিয়ে এসেছেন। হাতিগুলো খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে এসে ফসলের ক্ষতিসাধন করে। আমরা এ হাতিগুলোকে কিভাবে অভয়ারণ্যে ফেরানো যায়, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসককে অবহিত করেছি।’