ট্রাম্পের অভিষেক আজ: তিনি প্রেসিডেন্ট, রাজা, নাকি দাগি আসামি
১৭৮৭ সালের কথা। ফিলাডেলফিয়ার কনভেনশন হলে সমবেত হয়েছেন সদ্য স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের আদি স্থপতিরা। হলের বাইরে গিজগিজ করছে উৎসুক নারী-পুরুষ। নতুন রাষ্ট্র কেমন হবে, এ নিয়ে চলছে তুমুল বিতর্ক। একসময় হল থেকে বেরিয়ে এলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। তাঁকে দেখে ত্রস্ত এক নারী প্রশ্ন করলেন, ‘কী ঠিক হলো ডাক্তারবাবু, প্রজাতন্ত্র না রাজতন্ত্র?’ উত্তরে ফ্রাঙ্কলিন বললেন, ‘প্রজাতন্ত্র, যদি আপনারা তা রক্ষা করতে পারেন।’
সে ঘটনার ২৩৮ বছর পর, আজ সোমবার ওয়াশিংটনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই দীর্ঘ ইতিহাসে তিনি প্রথম ব্যক্তি, যিনি আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হয়েও এই দায়িত্ব পাচ্ছেন। অন্য কথায় তিনি একজন দাগি আসামি বা ফেলন।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের উদ্বেগ সত্য প্রমাণিত হয়নি, যুক্তরাষ্ট্র এখনো প্রজাতন্ত্র। কিন্তু ট্রাম্পের অধীনে আগামী চার বছর কাটানোর পর সত্যি এ দেশ প্রজাতন্ত্র থাকবে কি না, সে প্রশ্ন একদম অবান্তর নয়। খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলিয়াম গ্যালস্টোন মনে করেন, ‘পরের চারটি বছর যদি আমরা কোনোক্রমে আমাদের মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহ টিকিয়ে রাখতে পারি, তাহলে তাকেই বড় সাফল্য ভাবব।’
সবাই গ্যালস্টোনের মতো আশাবাদী নন। মার্কিন শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞ ক্যাল জিলসন মনে করেন, ট্রাম্পের প্রথম চার বছর তিনি অনেক কিছু করতে পারেননি প্রশাসনের ভেতরে প্রতিরোধের কারণে। তাঁর দ্বিতীয় দফা প্রশাসনে তাঁকে ঠেকানোর মতো কেউ নেই। ‘প্রথম দফায় তিনি যেমন বিভক্তি সৃষ্টিকারী, অবিবেচক ছিলেন, দ্বিতীয় দফায় এসেও তার কোনো পরিবর্তন হবে না।’
আরও স্পষ্ট করে বলেছেন রিপাবলিকান সিনেটর মিট রমনি। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ট্রাম্প ও তাঁর অনুসারীদের ক্যাপিটল হিলে হামলা ছিল গণতন্ত্রের ওপর সরাসরি হামলা। সে কথা উল্লেখ করে রমনি বলেছেন, ‘৬ জানুয়ারির তুলনায় এখন আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি অনেক বেশি উদ্বিগ্ন।’
হাতে ক্ষমতা পেয়ে তিনি কী করবেন, সে কথা ট্রাম্প নিজেই সুস্পষ্ট করে বলেছেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে পরাজয় তিনি মেনে নিতে পারেননি। এখন দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসে তিনি সেই অপমানের শোধ তুলবেন। প্রয়োজনে তিনি এক দিনের জন্য হলেও ‘ডিক্টেটর’ হবেন। বিচার বিভাগের যেসব কর্মকর্তা গত চার বছর তাঁর অবৈধ কার্যকলাপের তদন্ত করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেবেন। বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টির যেসব নেতা তাঁর সমালোচনা করেছেন, যেমন সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি, তাঁদেরও একহাত দেখে নেবেন। এমনকি সংবাদপত্র ও টিভির যেসব সাংবাদিক/ভাষ্যকার তাঁর সমালোচনা করেছেন, তাঁরাও এই তালিকায় রয়েছেন।
এসব কথা কোনো প্রজাতন্ত্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের হতে পারে না, শুধু একজন রাজা বা সম্রাটের। সে কথা উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মানবাধিকার সংস্থা এসিএলইউ মার্কিন নাগরিকদের উদ্দেশে এক আবেদনে বলেছে, ‘আপনারা কংগ্রেসকে জানান, আমরা একজন প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করেছি, কোনো রাজাকে নয়।’
অনেকে বলছেন, ট্রাম্প যা বলছেন তা শুধু কথার কথা, বাস্তবে এর কিছুই করবেন না। প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট হয়েও ট্রাম্প অনেক কথা বলেছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ঠিক, কিন্তু সে সময় তাঁর মন্ত্রিসভায় এমন অনেক অভিজ্ঞ ও পোড়খাওয়া সদস্য ছিলেন, যাঁদের আমরা ‘অ্যাডাল্টস ইন দ্য রুম’ বলে থাকি, তাঁদের কারণে ট্রাম্পের ক্ষতিকর অভিপ্রায়সমূহ বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু এবার সেসব ‘প্রাপ্তবয়স্ক’দের কেউ নেই। তদুপরি, কংগ্রেসের উভয় কক্ষই এখন রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত। সুপ্রিম কোর্টেও তাঁর সমর্থক হিসেবে বিবেচিত রক্ষণশীল বিচারকদের প্রাধান্য। অন্য কথায়, যাকে আমরা গণতন্ত্রের ‘গার্ড্রেইলস’ বা নিরাপত্তা বেড়ি বলি, তার কিছুই থাকছে না।
এবার ট্রাম্প বেছে বেছে এমন সব লোককে তাঁর মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছেন, যাঁরা অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতার কারণে নয়, শুধু তাঁর প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্যের কারণে এই সুযোগ পেয়েছেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথু ওয়াক্সম্যান উদাহরণ হিসেবে প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রধান পিটার হেগসেথের কথা বলেছেন। প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার বাজেট ও তিন লাখ লোকের প্রতিরক্ষা বিভাগ চালানোর মতো কোনো অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা তাঁর নেই। ‘এই লোকটা প্রতিরক্ষার বদলে আমেরিকার “কালচার ওয়ার” চালাতেই বেশি দক্ষ।’
অথবা স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়রের কথাও ভাবা যেতে পারে। তিনি শুধু কোভিড-১৯–এর জন্য কার্যকর প্রমাণিত টিকাসহ সব রকম টিকার বিরুদ্ধে। পানিতে ফ্লোরাইড ব্যবহারেরও তিনি বিরোধিতা করছেন, অথচ দাঁতের পরিচর্যায় ফ্লোরাইডের ভূমিকা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। মনে করা যেতে পারে, ট্রাম্প নিজেই একসময় কেনেডি জুনিয়রকে ‘পাগল’ বলেছিলেন এবং অত্যন্ত বিরক্তকর এক ভনভনে মাছির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই তিনি সোয়া কোটি অবৈধ অভিবাসীকে বহিষ্কার শুরু করবেন। এর সিকি মাত্রও যদি তিনি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন, তার ফলে সারা দেশে এবং দেশের বাইরেও অভাবনীয় মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। এসব অবৈধ অভিবাসীর অধিকাংশই এ দেশে দীর্ঘদিন থেকে বাস করছেন, তাঁদের ছেলেমেয়েদের জন্ম এ দেশে, যাঁরা এ দেশের বৈধ নাগরিক। ‘সব অবৈধ খেদাও’ বলে ট্রাম্প হয়তো তাঁর কট্টর সমর্থকদের মন জয় করবেন, কিন্তু তাতে দেশের ভেতরে যে বিশৃঙ্খলা নেমে আসবে, তা বহু বছরেও মেটানো সম্ভব হবে না। নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, পুরো ব্যাপারটাই বিপজ্জনক।
চীন ঠেকাও ধোয়া তুলে ট্রাম্প আমদানি শুল্ক আরোপের যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন, অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ তাকেও মস্ত ভুল মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্র যদি শুল্কের ঢিলটি ছোড়ে, তাহলে চীন যে পাল্টা পাটকেলটি ছুড়বে, তা নিশ্চিত। সে কথার ইঙ্গিত করে ওয়াশিংটনে চীনের মুখপাত্র লিউ পেনগুই বলেছেন, ‘শুল্কযুদ্ধ বা বাণিজ্যযুদ্ধে আমরা কেউই জিতব না।’
শুধু বাণিজ্যযুদ্ধ কেন, ট্রাম্প পানামা খাল ও গ্রিনল্যান্ড দখলের কথাও ভাবছেন, প্রয়োজন হলে শক্তি প্রয়োগ করে। যে লোক সব রকম যুদ্ধের বিরোধিতা করে ক্ষমতায় এসেছেন, তিনি এখন ১৯-শতক ধাঁচের নতুন ঔপনিবেশিক যুদ্ধের জন্য হাতের আস্তিন গোটানো শুরু করেছেন।
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ অবশ্য সবকিছুই ‘ঘন আঁধারময়’ সে কথা মানতে নারাজ। পুরোনো ও পোড়খাওয়া গণতন্ত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার নিজস্ব ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ ব্যবস্থা রয়েছে। বিগত সোয়া দুই শ বছর এই ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা কখনো কখনো ব্যর্থ হলেও তা চিরস্থায়ী ক্ষতি করতে পেরেছে, তা বলা যাবে না। নিক্সনের ওয়াটারগেট, ট্রাম্পের ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গা, অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের সুপ্রিম কোর্টের রায় অগ্রাহ্য অথবা জর্জ বুশের সময় প্যাট্রিয়ট অ্যাক্টের মাধ্যমে নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন—এসবই মার্কিন গণতন্ত্রের মুখে কালো দাগ; কিন্তু দেশটি রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ট্রাম্পের কথায় বিশ্বাস করে ভোট দিয়ে তাঁকে নির্বাচিত করেছেন। সেই বিশ্বাসের দাম ট্রাম্প কীভাবে চুকান, তা দেখতে আমাদের হয়তো বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।