ওয়াসার এমডি তাকসিমের অপকর্ম নিয়ন্ত্রণে চার সদস্যের সিন্ডিকেট

0
1691

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
অপকমের্র কাহিনীর শেষ নেই ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের। তিনি নিজের আধিপত্য কায়েম করতে ওয়াসায় গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তাদের মাধ্যমেই করেন সব অনিয়ম, দুর্নীতি। ওয়াসায় তিনি এতটাই ক্ষমতাধর যে, প্রধানমন্ত্রীর একটি আদেশও অমান্য করেছেন নিজের স্বার্থে। বিতর্কিতভাবে নিয়োগ পাওয়া এই এমডি চার বছরেরও বেশি সময় ধরে জেঁকে বসে আছেন ওয়াসায়। বড় বড় প্রকল্প থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। বলে বেড়ান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার টিকিটির নাগালও পাবে না। এ কথা বলতেও ভোলেন না যে, তিনি তত দিনই ওয়াসায় থাকবেন, যত দিন আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকবেন। আর আওয়ামী লীগ সরে গেলে তিনিও পাড়ি জমাবেন সুদূর আমেরিকায়। অভিযোগ আছে, তিনি বেশির ভাগ সময়ই থাকেন না দেশে। সরকারি কাজের নামে সরকারের টাকায় আমেরিকান পাসপোর্টে ঘোরেন দেশ-বিদেশ। সরকারি অর্থ ব্যয় করে এ পর্যন্ত শতাধিকবার বিদেশ গেছেন। যে দেশেই যান না কেন, প্রতি ট্যুরে আমেরিকায় টুঁ মারতেই হয় তাকে। ওয়াসার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে এবং স্থানীয় সরকার বিভাগসূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ওয়াসার একজন নির্বাহী প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম-দুর্নীতির শেষ নেই। তিনি খোদ প্রধানমন্ত্রীর কথাও পাত্তা দেননি। ওই কর্মকর্তা বলেন, ওয়াসার ডিএমডি (অর্থ) পদে জনতার মঞ্চের জন্য মামলার শিকার, বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী ওয়ালিউল্লাকে নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমডি তাকসিম এ খানকে গণভবনে ডেকে নিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সে নির্দেশনার প্রতি থোরাই কেয়ার করেছেন এমডি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সামনে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে এলেও ডিএমডি (অর্থ) পদে নিয়োগ দেন জামায়াতে ইসলামীর একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে পরিচিত সৈয়দ গোলাম আহমদকে। ওয়াসা সূত্র জানায়, শুধু ডিএমডি (অর্থ) নয়, ওয়াসার আরও দুটি ডিএমডি পদে তাকসিম এ খান নিয়োগ দিয়েছেন কম যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থী, বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের। এর মধ্যে ডিএমডি (অপারেশন অ্যান্ড মেনটেইন্যান্স) কামরুল ইসলাম ও ডিএমডি (রিচার্স, প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) সিরাজ উদ্দিন দুজনই বিএনপির সমর্থক।
চার সদস্যের সিন্ডিকেটই
দেখভাল করে সবঃ
ওয়াসার বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এমডি তাকসিম এ খান ওয়াসায় নিজের অনুসারী ‘চার খলিফা’ তৈরি করেছেন। ওয়াসায় যত ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অথের্র লেনদেন হয় তার সবই ঘটে এ চার খলিফার হাত দিয়ে। এমডি তাদের বাইরে আর কারও মাধ্যমে কোনো ধরনের অবৈধ লেনদেন করেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওয়াসায় যত বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে সেগুলোয় ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে। আর এগুলো করছেন এমডির সিন্ডিকেটের এ চার সদস্য। এদের মধ্যে রয়েছেন পদ্মা (জশলদিয়া) পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্পের ডিপিডি প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম, এমডির ব্যক্তিগত স্টাফ এবং আরও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী আকতারুজ্জামান, বিভিন্ন কনস্ট্রাকশনের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী মহসিন এবং ওয়াসার ক্রয় বিভাগের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী আনোয়ার সাত্তার সবুজ। এ চারজনই সব প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ করেন, টাকা-পয়সার লেনদেন করেন। জানা গেছে, বর্তমানে ওয়াসায় বড় কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পদ্মা (জশলদিয়া) পানি শোধনাগর নির্মাণ প্রকল্প, তেঁতুলঝরা-ভাকুর্তা ওয়েলফিল্ড নির্মাণ প্রকল্প, এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত একাধিক প্রকল্প। এর মধ্যে পদ্মা প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় হচ্ছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। বাকি প্রকল্পগুলোর প্রতিটিতে বরাদ্দ হাজার কোটি টাকার ওপরে। ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে এসব প্রকল্পে লুটপাট চলছে। এদিকে ওয়াসার এমডি পদে তাকসিম এ খানের নিয়োগের বিষয়ে আরও কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। ওয়াসার বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, প্রথমবার যখন ওয়াসার তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা এমডি পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য তাকসিম এ খানকে দেশে নিয়ে আসেন, তখন ওই পদে প্রার্থী হওয়ার মতো তার কোনো যোগ্যতাই ছিল না। এমডি পদের জন্য আবেদন করলে প্রথম দফা মৌখিক পরীক্ষায় তিনি অযোগ্য হয়ে যান। পরে তৎকালীন চেয়ারম্যান কৌশলে চার-পাঁচ জনের নামে মৌখিক পরীক্ষার জন্য পুনরায় চিঠি পাঠান। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন তাকসিম এ খান। কিন্তু দ্বিতীয় দফা মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েও তিনি যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। সেখানে প্রথম হন মোঃ আবদুল্লাহ। যিনি বর্তমানে খুলনা ওয়াসায় এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিদেশ ঘুরতেই
ভালোবাসেন তাকসিমঃ
আমেরিকান পাসপোর্টধারী ওয়াসা এমডি তাকসিম এ খান ২০০৯ সালে এমডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর এ পর্যন্ত শতাধিক দেশে গিয়েছেন সরকারি টাকায়। ওয়াসার বিভিন্ন কাজের অজুহাতে তিনি যখনই সুযোগ পেয়েছেন তখনই ছুটে গেছেন দেশের বাইরে। তার এ বিদেশ ভ্রমণের সব অর্থই জোগান দিতে হয়েছে ওয়াসার কোষাগার থেকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা জানান, তাকসিম এ খান যখনই কোনো দেশে সফরে গেছেন, ফেরার পথে তিনি নিউইয়র্ক হয়ে দেশে ফিরতেন। কারণ সেখানে তার স্ত্রী ও সন্তান রয়েছেন। শুধু তাই নয়, ওয়াসা এমডি যখন শুধু স্ত্রী-সন্তানদের দেখতে আমেরিকা যান, তখন তার সব খরচও বহন করতে হয় ওয়াসাকে। কিন্তু তিনি এতটাই ক্ষমতাধর যে তার এসব অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলে কথা বলার সাহস এখনো পান না।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

3 × 2 =