হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স বাড়ি বানাতে কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে ….দেবাশীষ চক্রবর্তী, এমডি, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন

0
2209

অপরাধ বিচিত্রাঃ
আবাসন সংকট নিরসনে আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে ঋণ দিচ্ছে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি)। সুদের হারও কমিয়ে এক অঙ্কে নামিয়ে আনা হয়েছে। প্রবাসী ও পল্লী এলাকার গ্রাহকদের জন্য আবাসন ঋণ এবং বাড়ি সম্প্রসারণ ও মেরামতের জন্যও নতুন চারটি ঋণপণ্য চালু করেছে। ঋণের কিস্তি আদায় পদ্ধতিও আধুনিকায়ন হচ্ছে। এত সব সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও প্রচারণার অভাবে অনেকেই অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি খরচে ঋণ নিচ্ছে। এ কারণে গ্রাহক আকৃষ্ট করতে ঋণ সুবিধা বাড়ানো ও প্রতিষ্ঠানের অটোমেশনের পাশাপাশি প্রচারণায় মনোযোগ দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেবাশীষ চক্রবর্তী। ১ জানুয়ারি হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্সে যোগদানের পর ২১ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১০০ দিনের একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন দেবাশীষ চক্রবর্তী। ঋণ মঞ্জুরি ও বিতরণ, খেলাপি ঋণ আদায় এবং মামলা নিষ্পত্তির একটি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এতে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির এমডি বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় বাড়ি নির্মাণের জন্য ঋণের সীমা ৫০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ কোটি টাকা করা হয়েছে। অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা সদরে একজন গ্রাহককে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হবে। পল্লী অঞ্চলেও এখন বাড়ি নির্মাণের জন্য ঋণ দেওয়া হবে। একজন গ্রাহক পাবে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা। গ্রুপভিত্তিক ঋণের ক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রাম এলাকায় বাড়ি নির্মাণে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা, অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা সদর এবং পল্লী এলাকায় ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম এলাকায় ফ্ল্যাটের ঋণ ৪০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ লাখ টাকা করা হয়েছে। অন্যান্য এলাকায় সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হবে। ফ্ল্যাটের জন্য সুদের হার ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। বাড়ি নির্মাণে করা হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া অন্যান্য এলাকায় সুদের হার সাড়ে ৮ শতাংশ। এ ছাড়া বাড়ি সম্প্রসারণ ও মেরামত করার জন্যও নতুন ঋণ পণ্য চালু করা হয়েছে। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে নতুন এই ঋণ সুবিধাগুলো পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের এখনকার লক্ষ্য পল্লী এলাকা, বিশেষ করে উপজেলাগুলোতে ঋণ সম্প্রসারণ করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা শাখার সংখ্যা ১০০তে উন্নীত করার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যেই আমরা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবও দিয়েছি। ঋণ বিতরণে বিএইচবিএফসির সক্ষমতা দ্রুত বাড়বে  প্রতিষ্ঠানটির এমডি বলেন, সরকার থেকে পাচ্ছি ৫০০ কোটি টাকা। আইডিবি থেকে ৮০০ কোটি টাকা পাব। বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের ২০০ কোটি টাকার ডিবেঞ্চারের মেয়াদ নবায়ন করে দেবে। প্রতিবছর ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার মতো ঋণ আদায় হচ্ছে। ৫৩৫ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য আছে। ১০০ দিনের কর্মসূচিতে ঋণ মঞ্জুরির ৯৫ শতাংশ লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। ১৪১টি মামলা নি®পত্তি হয়েছে। মে-জুন মাসে খেলাপি ঋণ আদায়ের একটি লক্ষ্য নিয়েছি। আশা করছি এটাও অর্জিত হবে। মামলা থাকায় খেলাপি ঋণ আদায়ে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। বর্তমানে খেলাপি ঋণ আছে ৪৩৫ কোটি টাকার মতো। এমডি বলেন, একই সঙ্গে ঋণের সীমা বাড়ানো এবং সুদের হার কমানো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাতে হলে এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ অটোমেশন। হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন অটোমেশনের দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এখন প্রায় সব ব্যাংকই অটোমেশনে চলে এসেছে। সম্প্রতি আমাদের পর্ষদও নিজস্ব ডাটা সেন্টার ও সেন্ট্রালাইজ ডাটা বেইসড সিস্টেম করার অনুমোদন দিয়েছে। ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের কিস্তি জমা দিতে সোনালী ব্যাংকে আসতে হচ্ছে। এখন থেকে এই সমস্যায় আর পড়তে হবে না। ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে কিস্তির টাকা নেওয়ার ব্যবস্থা করছি। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অর্গানোগ্রাম অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। এখানে শাখা বলতে বোঝায় আঞ্চলিক অফিস। আঞ্চলিক অফিসকে নিয়ন্ত্রণকারী অফিস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করছেন এমডি। শাখার সংখ্যা ১০০তে উন্নীত হলে এটা করা সম্ভব হবে। যোগদানের পরপরই সুদ্ধাচার কর্মসূচির আওতায় প্রধান কার্যালয়ের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু করেন। আমরা ঋণ দিই বাড়ি নির্মাণের জন্য, কিন্তু আমাদের বাড়ি যদি নোংরা থাকে তাহলে গ্রাহক এসে কি বলবে? দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন, বিভিন্ন সময় বিদেশে গিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের মুখে শুনেছি বিদেশে থাকায় তারা বাড়ি নির্মাণের জন্য দেশের কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ পান না। কিন্তু তাঁদের জমি আছে দেশে। আমি এখানে যোগদানের পর প্রবাসীদের জন্য ঋণ উন্মুক্ত করেছি। প্রবাসীরা যাতে বিদেশে বসেই রেমিট্যান্স পাঠিয়ে ঋণের কিস্তি দিতে পারে সে জন্য সরকারি ব্যাংক ও ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। বিএইচবিএফসির ঋণের কোনো সার্ভিস চার্জ নেই। দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন, আমরা শুধু আবেদন ফি ও ইন্সপেকশন ফি নিই। ঋণসংক্রান্ত এসব তথ্য যাতে ঘরে বসেই পাওয়া যায় সে জন্য সরকারের এটুআই প্রকল্পের আওতায় আমরা বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রেও আমরা অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের থেকে আলাদা। আমরা কোনো ক্ষেত্রেই চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আদায় করি না। ব্যাংকগুলোর মতো খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে সুদের ওপর সুদ আরোপ না করে শুধু মূল বা আসলের ওপরই সুদ আরোপ করি। যে জমিতে বাড়ি নির্মাণ করা হবে সেটিই বন্ধক রাখলে হবে। ফ্ল্যাট কিনতে হলে ফ্ল্যাটের দলিল বন্ধক রাখলেই ঋণ পাওয়া যাবে। প্রচারণার অভাবে এই সুবিধার কথা অনেকেই জানে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন্যান্সে অনার্স স¤পন্ন করে ইউনিভার্সিটি অব র্ব্যাসেলস থেকে এমবিএ করেন দেবাশীষ চক্রবর্তী। কর্মজীবন শুর করেন মাইডাস ফাইন্যান্সে। এরপর বিএইচবিএফসিতে যোগ দিয়ে মহাব্যবস্থাপক পর্যন্ত হয়ে চলে যান রূপালী ব্যাংকে। সেখানে ডিএমডি পর্যন্ত হন। কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পালন করেন। বাড়ি নির্মাণে ও ফ্ল্যাট কেনায় আগের চেয়ে বেশি ঋণ দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি)। কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ঋণের সুদের হারও। সংস্থাটি সুন্দর নামের নতুন নতুন ঋণ কর্মসূচি নিয়ে এসেছে। এগুলো হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য প্রবাস বন্ধু, উপজেলা পর্যায়ের লোকদের জন্য পল্লীমা, শহরের লোকদের জন্য নগর বন্ধু ইত্যাদি। বিএইচবিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন, আবাসন খাতের উন্নয়নে আমরা যথাসম্ভব উদারভাবে দুয়ার খুলেছি। সামান্য শর্ত পূরণ করে আমাদের থেকে ঋণ নিয়ে যে কেউ একটা ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারেন। বাড়ি নির্মাণ, সম্প্রসারণেও ঋণ নিতে পারেন যে কেউ। বিএইচবিএফসিতে এত দিন সাধারণ, গ্রুপ, ফ্ল্যাট, বর্ধিত, ২০ বছরমেয়াদি মধ্যবিত্ত ও নিুমধ্যবিত্ত, ৫ বছরমেয়াদি বিশেষ এবং সেমি-পাকা এমন সাত ধরনের ঋণ চালু ছিল। ১ জুলাই থেকে বাড়ি নির্মাণে একক, বাড়ি নির্মাণে গ্রুপ এবং ফ্ল্যাট কেনা ইত্যাদি ঋণ কর্মসূচি চালু করেছে সংস্থাটি। বিএইচবিএফসির ঋণে আবেদন ফি (মাশুল) ও পরিদর্শন মাশুল আছে। যে জমিতে বাড়ি নির্মাণ করা হবে, সেটি বন্ধক রাখলেই হয়। ফ্ল্যাট কিনতে হলে ফ্ল্যাটের দলিল বন্ধক রাখলেই চলে। এককভাবে বাড়ি নির্মাণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনভুক্ত অতি উন্নত এলাকার জন্য ঋণের পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ কোটি টাকা, দুই মহানগরীর অন্যান্য উন্নত এলাকার জন্য ৫০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৮০ লাখ এবং টঙ্গী, সাভারসহ দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা শহরের জন্য ৪০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৬০ লাখ টাকা করা হয়েছে। গ্রুপ বা দলগতভাবে বাড়ি নির্মাণে ঋণের সীমা ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর অতি উন্নত এলাকায় গ্রুপের প্রত্যেকের জন্য বর্তমানের ৫০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৬০ লাখ টাকা করা হয়েছে। দুই মহানগরীর অন্যান্য এলাকার জন্য আগের মতোই ৫০ লাখ এবং টঙ্গী, সাভারসহ বিভাগীয় বা জেলা পর্যায়েও আগের মতোই ঋণসীমা ৪০ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। ফ্ল্যাট কেনার জন্য আগে সব এলাকার জন্যই সর্বোচ্চ ৪০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হতো। এখন দেওয়া হবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য ৮০ লাখ টাকা। টঙ্গী, সাভারসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরে ফ্ল্যাট কিনতে দেওয়া হবে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ। বাড়ি নির্মাণের সুদের হার ১২ থেকে কমিয়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ আর ফ্ল্যাট কেনার সুদের হার ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। টঙ্গী, সাভারসহ সব বিভাগীয় শহরে বাড়ি নির্মাণে ঋণের সুদের হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে । বাড়ি সম্প্রসারণ ও মেরামত করার জন্যও নতুন ঋণ পণ্য চালু করেছে বিএইচবিএফসি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার ক্ষেত্রে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা, দুই মেট্রোপলিটন বাদে বিভাগীয় ও জেলা সদরের ক্ষেত্রে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যাবে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত। বিএইচবিএফসি ঋণ বিতরণে বিএইচবিএফসির সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে এবং খুব শিগগির আরও বাড়বে। বছরে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার ঋণ আদায় করে সংস্থাটি। সরকার এ বছর সংস্থাটিকে আবাসন খাতে ঋণ দিতে ৫০০ কোটি টাকা বাড়তি দিচ্ছে। এদিকে ঋণপত্রের মেয়াদ বাড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও দিচ্ছে আরও ২০০ কোটি টাকা। বিএইচবিএফসির এমডি দেবাশীষ চক্রবর্তী জানান, এর বাইরেও বড় আকারের তহবিল আসছে বিএইচবিএফসির জন্য। জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) পর্ষদ সভায় বাংলাদেশের পল্লি ও উপশহর এলাকায় আবাসন খাতে ঋণ দিতে ৯ কোটি ৫২ লাখ ৪০ হাজার ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। প্রতি ডলার ৮০ টাকা হিসাবে তা দাঁড়ায় ৭৬২ কোটি টাকা।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

19 − three =