অপ্রতিরোধ্য অর্থপাচারকারীরা সঠিক পরিসংখ্যান নেই কোথাও প্রতিরোধে নেই কঠোর ব্যবস্থা জড়িত প্রভাবশালীরা

0
741

প্রতিবছর দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার হচ্ছে। প্রতিবছর হাজার থেকে লাখো কোটি টাকা পাচার হচ্ছে-এমন আশঙ্কার কথা অর্থনীতিবিদরা বললেও অর্থপাচার প্রতিরোধে কঠিন বা কঠোর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ দেখা যায়নি কখোনো। অভিযোগ রয়েছে- এই অর্থপাচার করছে প্রভাবশালীরা। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর

সদস্যসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা রয়েছেন এই প্রভাবশালী মহলের তালিকায়। অর্থ পাচারকারীরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপ, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থ নামে-বেনামে বিনিয়োগ করছেন। তাদের অনেকেই বিদেশে গড়ে তুলছেন ‘সেকেন্ড হোম’। অর্থপাচারে বেশি জড়িয়ে পড়ছেন উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী মানুষ। তাদের যারা প্রতিরোধ করবেন, তাদের বিরুদ্ধেও অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে। ফলে কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না অর্থপাচার।

সূত্র মতে, দেশে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকা ও বিনিয়োগ সুরক্ষার অভাব আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সম্পদশালীদের অনেকেই বিদেশে অর্থপাচার করে বাড়ি বানাচ্ছেন, জমি কিনছেন, কারখানা গড়ছেন। অভিযোগ রয়েছে ব্যবসায়ীরা আমদানি-রফতানির আড়ালে অর্থপাচার করছেন। আমদানি পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে আর রফতানি পণ্যের দাম কম দেখিয়ে এই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি মধ্যম সারির কর্মকর্তা থেকে উচ্চপর্যায়ের আমলা, বেসরকারি চাকরিজীবীরাও নগদ অর্থপাচার করছেন বিভিন্নভাবে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে_ হুন্ডি। এছাড়া ব্যবসায়ী ও বিদেশে বসে ঘুষের অর্থ লেনদেনে জড়িত ব্যক্তিরাও অর্থপাচারে।

কারা এই অর্থপাচার করছেন এবং তাদের ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে কিনা- এই প্রশ্নের জবাবে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা হতাশা ব্যক্ত করেন। তারা জানান, তদন্ত হলেও অর্থপাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। পাচারকারী, সহায়তাকারী এবং যারা বেআইনিভাবে অর্থ আয় করছেন তারা সবাই প্রভাবশালী। যে কারণে তাদের বিষয়ে কেউ সঠিকভাবে তদন্ত করতে পারছে না। কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত শুরু হলেও একটি পর্যায়ে গিয়ে তা থেমে যাচ্ছে।

তারা আরো জানান, বিদেশে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারের একাধিক সংস্থা কাজ করছে। এই সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। যে কারণে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। সমপ্রতি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধবিষয়ক কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের এক সভায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও দেশ থেকে অর্থপাচার বন্ধে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট, এটর্নি জেনারেলের অফিস, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সিআইডি কাজ করছে। কিন্তু এই সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। এছাড়া সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও অনেক সময় তদন্ত কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা একটি জটিল প্রক্রিয়া। ফলে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে কোনো সফলতা আসছে না। বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তে বেশকিছু অর্থ পাচারের ঘটনা ধরা পড়লেও ফেরত আনার বিষয়ে তেমন অগ্রগতি নেই। সামান্য কিছু টাকা ফেরত আনলেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নতুন করে কোনো অর্থ ফেরত আনতে পারছে না।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে জানতে পেরেছে গত কয়েক বছরে প্রায় ৪ হাজার বাংলাদেশি মালেশিয়ায় বিনিয়োগ করে ‘সেকেন্ড হোম’ গড়েছেন। তারা সঠিক নিয়মকানুন অনুসরণ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ মালেশিয়ায় নিয়ে গেছেন- এমন কথার সত্যতা নেই। দুদক ঐ সকল ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে ঠিক, তবে অর্থপাচার রোধে এই প্রতিষ্ঠান কতদূর সফল হবে- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

অর্থপাচার কারা করছেন- এমন প্রশ্নের সঠিক জবাব না থাকলেও সরকার বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের নাম ইতোমধ্যে উঠে এসেছে। তবে দেশ থেকে যে নিয়মিত ও বেপারোয়াভাবে অর্থপাচার হচ্ছে, এ নিয়ে অকাট্য দালিলিক প্রমাণ সংশ্লিষ্ট কারো কাছেই পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার তদন্তে অর্থপাচারের ঘটনা বেরিয়ে আসছে। যা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।

সমপ্রতি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাস উদ্দিন বলেছেন, বিগত ১০ বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর আগে ২০১৭ সালের ৩ মে জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল- গত ১০ বছরে ৬ লাখ কোটি পাচার হয়েছে। একইদিন দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল- গত ১০ বছরে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এছাড়া একইদিনে দৈনিক আমাদের সময়-এর সংবাদে বলা হয়েছিল-বাজেটের চেয়ে অর্থ পাচার বেশি।

এদিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) ২০১৪ সালে জানিয়েছিল ঐ বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯শ ১১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। টাকার অংকে যা প্রায় ৭২ হাজার ৮শ ৭২ কোটি টাকা। সর্বশেষ, পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারি, প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারির মাধ্যমেও দেশ থেকে টাকা পাচারের কথা ফাঁস হয়েছে। সুইস ব্যাংক, এইচএসবিসি ব্যাংকেও বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের নজির রয়েছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে তথ্য রয়েছে।

এদিকে, দেশি-বিদেশি আইটি বিশেষজ্ঞ বা দুর্বৃত্তদের সংঘবদ্ধ কারসাজিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার হাতিয়ে নেয়ার (হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে) ঘটনাটিও অর্থপাচারের মধ্যে পড়ে। এই অর্থ চুরির জন্য আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সিস্টেম সুইফকে ব্যবহার করা হয়েছিল। চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার রাখা হয়েছিল ফিলিপাইনের রিজাল কর্মাশিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন (আরসিবিসি)-এ। বিগত দু’বছরেও সেই অর্থ পুরোপুরি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। যদিও রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ভূমিকার জন্য আরসিবিসি’র বিরুদ্ধে মামলা চলছে। কিন্তু, বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো এর কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না।

এদিকে, দুদকের একটি সূত্র জানায়, অর্থ পাচার করে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন এমন ১৫ জনের নাম পেয়েছে দুদক। তাদের মধ্যে ৭ জন রাজনীতিবিদ, ৭ জন ব্যবসায়ী এবং ১ জন পেশাজীবী আছেন; কিন্তু তাদের ব্যাপারেও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।

সূত্রটি আরো জানায়, গত ১৫ বছরে প্রায় ৩ হাজার ৩শ’ ৪৫ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম সুবিধা নিয়েছেন। এতে পাচার হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। মালয়েশিয়া সরকার ২০০২ সালে বিশেষ কর্মসূচির আওতায় ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্প শুরু করে। ঐ বছর কোনো বাংলাদেশি এ সুবিধা না নিলেও ২০০৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩ হাজার ৬শ ৯১ জন সেকেন্ড হোম সুবিধা নিয়েছেন। তালিকাভুক্ত বাংলাদেশিরা দেশ থেকে টাকা সরিয়ে সেকেন্ড হোমে বিনিয়োগ করেছেন।

এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ বলেন, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা একটি জটিল প্রক্রিয়া। এছাড়া এটি সময়সাপেক্ষ। দীর্ঘ সময় ধরে এর ফলোআপে থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এটি হয় না। সরকার বদল বা সংশ্লিষ্ট ডেস্কের কর্মকর্তা বদলি হওয়ার কারণেও হয়ে যায়। ফলে ফলোআপ সেভাবে হয় না। যে কারণে পাচার হওয়া টাকা ফেরানো যাচ্ছে না।

দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, আইনানুগ প্রক্রিয়ায় যাতে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনা যায়, সেজন্য উদ্যোগ নিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। এছাড়া এনবিআর এবং দুদককেরও উদ্যোগ নিতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 × two =