বাংলাদেশে দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে : আইন করেও সমাধান করা যাচ্ছে না

1
2056

অপরাধ বিচিত্রা:দেশের বায়ুদূষণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।বায়ু, পানি, মাটি, সবক্ষেত্রেই দূষণ বাংলাদেশের মানুষের কাছে নতুন কোন বিষয় না হলেও পরিস্থিতি এখন মহাসঙ্কটে রূপ নিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন । কৃষিকাজে বিষাক্ত রাসায়নিক বা কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় দূষণের ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে মানুষের খাদ্যে।আমাদের খাদ্যে দূষণের প্রভাব খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে।এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হলেও সেগুলো দূষণের প্রভাব মুক্ত করতে অনেক সময় লেগে যাবে।ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে বায়ু এবং শব্দ দূষণের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু এবং বয়স্করা।তাদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, বা এ্যাজমার মতো রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া পরিবেশ দূষণের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে।

 

 

চিকিৎসকদের কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।এছাড়া বাংলাদেশের বহু গ্রামে আর্সেনিকযুক্ত পানি খেতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ।এখনও সারাদেশে সাড়ে পাঁচকোটির বেশি মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি ব্যবহার করছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বলা হচ্ছে।ঢাকার একটি ব্যস্ত সড়কে ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলছিলেন, দূষণের কারণে তারা যে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বা অনেক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, সেটা তাদের আতঙ্কিত করে তুলেছে।

পরিস্থিতি কতটা খারাপ হলে দেশবাসী সবার টনক নড়বে, সেটা কেউ অনধাবন বুঝতে পারছেন না।এছাড়া পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের অনেকের মাঝে হতাশাও কাজ করছে।

সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক কাজী সারোয়ার ইমতিয়াজ হাশমীও দূষণের মাত্রা বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে তিনি দূষণ রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কথাও তুলে ধরেন।তিনি বলেন, দূষণ বাড়ছে। যেহেতু জনসংখ্যা বাড়ছে শহরগুলোতে। উন্নয়ন কর্মকান্ড বাড়ছে এবং গাড়ির সংখ্যাও বেড়ে গেছে। তবে সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। ট্যানারি কারখানাগুলো ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।ইটের ভাটায় বিকল্প ব্যস্থা নেয়া হচ্ছে।এ ধরণের বিভিন্ন পদক্ষেপ আমরা নিচ্ছি।

একইসাথে পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, শুধু সরকারি পদক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব নয়। পরিবেশ রক্ষায় মানুষের সচেতনতাও প্রয়োজন।

শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শব্দ, বায়ূ পানি দূষণ। বহুমাত্রিক এসব দূষণে কানে কম শোনা, হৃদরোগ, উচ্চ-রক্তচাপ, স্থায়ী মাথাব্যথা, ক্ষুধামন্দা, অবসাদগ্রস্ততা, নিদ্রাহীনতাসহ নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। এর মধ্যে শব্দ ও বায়ু দূষণ শিশু স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। বাতাসের বিষাক্ত শিশা, কার্বন ডাই অক্সসাইড, কার্বন মন অক্সসাইড, সালফার বাতাসের ধূলি কনায় নিঃশ্বাসের সাথে শ্বাস প্রণালীতে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ফুসফুস ক্যানসার, কিডনি ডেমেজ, লিভারে সমস্যা থেকে শুরু করে নানা ধরনের সংক্রামক ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। নানা ধরনের জটিল রোগ আক্রান্ত হয়ে পড়ায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে আক্রান্ত শিশুরা।

চলতি বছরের ৬ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক পরিবেশ দূষণের ফলে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কমবয়সী প্রায় ১৭ লাখ শিশু অকাল মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। কারণ হিসেবে অনিরাপদ পানি, স্যানিটেশনের অভাব, দরিদ্র স্বাস্থ্যবিধির অনুশীলন ও পারিপার্শ্বিক দূষণের পাশাপাশি আহত হওয়াকেও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে সংস্থাটি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সূত্রে আরও জানা গেছে, এক থেকে পাঁচ মাস বয়সী শিশুর মধ্যে প্রতি চারজনের মধ্যে অন্তত একজনের মৃত্যুর ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী এই কারণগুলো।

এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশু মৃত্যুর সাধারণ কারণ হিসেবে বিবেচনাকারী পূর্বেও ধারণাগুলো এখন অনেকটাই মানুষের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এর ফলে ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া এবং নিউমোনিয়াসহ এ ধরনের মহামারি রোগ যা মশারি, পরিচ্ছন্ন রান্নার জ্বালানি ও বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে সহজভাবেই প্রতিরোধ করা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. মার্গারেট চ্যান এক বিবৃতিতে বলেন, বর্তমান সময়ে শিশুর মৃত্যুর সবচেয়ে অন্যতম কারণ হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। দূষিত বাতাস ও পানি শিশুদের কোমল অঙ্গ, ইমিউন সিস্টেম এবং শ্বাসনালীর পরিপক্বতায় বাধা সৃষ্টি করে শারীরিকভাবে দুর্বল করে দেয়। এ ছাড়া শিশুর স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও কমে যায়।

বিশ্বা স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ-এর একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০টি বড় বড় রোগের কারণ ১২ ধরনের পরিবেশ দূষণ। তার মধ্যে শব্দ দূষণ অন্যতম। একাধিক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের শব্দ দূষণের মাত্রা ৬০ থেকে শুরু করে কোনো কোনো স্থানে ১০৬ ডেসিবল পর্যন্ত রয়েছে। যা মানুষের শারীরিক-মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সাধারণত শব্দকে মাপা হয় ডেসিবলে বা ডিবিতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-এর মতে, বসতি এলাকা দিনের বেলা ৫৫ ডিবি, রাতে ৪৫ ডিবি হওয়া উচিত। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডিবি, রাতে ৫৫ ডিবি, শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডিবি, রাতে ৬৫ ডিবির মধ্যে শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। আর হাসপাতালে সাইলেন্স জোন বা নীরব এলাকায় দিনে ৫০, রাতে ৪০ ডিবি শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। অর্থাৎ এই মাত্রার মধ্যে থাকা আমাদের মধ্যে সহনীয়। এর বেশি হলেই দূষণ হিসেবে তা চিহ্নিত হয়।

রাজধানীতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক জরিপে দেখা যায়, নীরব এলাকার আওতাভুক্ত হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতের আশেপাশে দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৭৫-৯৭ ডেসিবল যা মান মাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ বেশি।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের অধিকাংশ এলাকার রাস্তা ও অলিগলিতে আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে। খোলা ট্রাক ও কনটেইনারে আবর্জনা পরিবহনের ফলে পথে পথে ছড়িয়ে পড়ছে আবর্জনা, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধসহ নানা রোগ ব্যধির জীবাণু। ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)-এর কর্মকর্তা বলছেন, জাইকার সহায়তায় আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বেশ উন্নতি হবে। তবে এ মহাপরিকল্পনা রাজধানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কতটুকু সুফল বয়ে আনবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডিসিসি’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজ দায়িত্ব পালনে যত্নবান না হলে রাজধানীর আবর্জনা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

সারা বিশ্বের প্রায় এক চতুর্থাংশ রোগের বোঝার (গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিস) কারণ পরিবেশ সংক্রান্ত দূষণের ঝুঁকি থেকে বলে ধারণা করা হয়। আর এর মধ্যে ৪০ শতাংশ রোগের বোঝায়। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাঁচ বছরের নিচের শিশুরা। অথচ জনসংখ্যার অনুপাতে এরা হচ্ছে মাত্র ১০ শতাংশ। সারা বিশ্বেও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা যে পাঁচটি রোগকে শিশুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নির্ধারণ করেছেন তা হচ্ছে জন্মপূর্ব অসুস্থতা, শ্বাসরোগ, ডায়রিয়া এবং শারীরিক আঘাত (ব্রিগস, ২০০৩)। পরিবেশ দূষণের কারণে জন্মপূর্ব অসুস্থতা সারাবিশ্বে শিশুমৃত্যুর এবং শিশুদের অসুস্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা বলেন, দূষণগুলো বর্তমানে সাংঘাতিকভাবে বেড়ে গেছে। পাড়া-মহল্লাও শব্দ দূষণ বেড়ে গেছে। শব্দ ও বায়ূ এ দু’টি দূষণ যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে আরো বলেন, পরিবেশের বিভিন্ন দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে সরকার বিভিন্ন সময়ে নানা কার্যক্রম হাতে নিলেও তা বাস্তবে কোনো কাজেই আসেনি। সরকার এখনই যদি পরিবেশের এ দূষণগুলো রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে দূষণগুলো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে গোটা বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে তুলবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশে পরিবেশসংক্রান্ত একগুচ্ছ আইন আছে। পরিবেশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত আইনের সংখ্যা প্রায় ২০০টি। প্রথম অংশে বলা হয়েছেথ পরিবেশ দূষণ বলতে মাটি, পানি ও বায়ুর দৈহিক, রাসায়নিক বা জৈবিক দূষণ ও পরিবর্তনকে বোঝাবে এবং যার মাধ্যমে এগুলোর তাপমাত্রা, স্বাদ, ঘনত্ব বা অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়থ সেগুলোও দূষণের অন্তর্ভুক্ত হবে।

মোটরযানে কালো ধোঁয়া নির্গমন পরিবেশ আইনভঙ্গের আরো একটি দৃষ্টান্ত। যে বাহন কালো ধোঁয়া নির্গমন করে, তা কেউ চালালে তার মালিক বা ড্রাইভার উভয়কেই শাস্তি প্রদানের বিধান আছে। অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি মন্ত্রণালয় এবং প্রকল্পের গাড়িগুলোই সব থেকে বেশি দূষিত কালো ধোঁয়ার নিঃসরণের সঙ্গে জড়িত। তবু পুলিশ থাকে নির্বিকার। জরিমানা করার বা কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়ার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। যদি আইনের বাস্তবায়নই না হয়, তবে কাগজ-কলমে আইনের ধারাগুলো থেকে কী লাভ?

 

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

six − 3 =