মানসম্মত নয় বর্তমানের চা

0
781

উন্নত ও উৎকর্ষতায় চা পাতার দাম ওঠানামা করে। রঙ, ঘ্রাণ ও স্বাদ এই তিনটি বিষয়ই হচ্ছে চায়ের গুণগত মানের প্রধান শর্ত। গত ১২ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) মওসুমের ৩২তম চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক চা নিলামবাজারে বিশেষভাবে বাছাইকৃত ব্রান্ডের (ডিএমপিএফ বিটি-২) চা প্রতিকেজি ৩১৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। উত্তর জনপদে সৃজন করা নতুন প্রজন্মের বাগানে

আবাদ ও উৎপাদিত কাজী অ্যান্ড কাজী কোম্পানির কোন কোন প্যাকেটজাত সীমিত কিছু ব্রান্ডের চা পাতা (গ্রীন টী, বø্যাক টী, অরগানিক টী) প্রতিকেজি এক হাজার থেকে ১৭শ’ টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে। এমনকি বিদেশের বাজারেও যাচ্ছে।
অথচ সাধারণ নিম্মমানের চা পাতার দর উঠছে প্রতিকেজি মাত্র ১৪০ টাকায়। তাছাড়া এবারের নিলাম বাজারে বাছাইকৃত উঁচুদরের ব্রান্ডের চায়ের মধ্যে মধুপুর জিবিওপি ক্লোন প্রতিকেজি ৩১১ টাকা, পিএফ ক্লোন ২৭৪ টাকা, ডিএমসি-রাঙ্গাপানি ২৪৬ টাকা, মধুপুর-আরডি ২৭৫ টাকা, আমতলী আরডি ক্লোন ২৩৫ টাকা, মধুপুর জিবিওপি ২৮২ টাকা, ডিএম ২৪৯ টাকা। চায়ের বাজার বিশ্লেষক কাজী মোঃ কেফায়েত উল্লাহ দৈনিক ইনকিলাবকে গতকাল (বুধবার) এ প্রসঙ্গে জানান, চায়ের আবাদ ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুণগতমানের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর এবং সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নেয়া হলে চায়ের বাজার সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল।
এদিকে সর্বশেষ ৩২তম চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক চা নিলাম বাজারে বিকিকিনির জন্য মোট ৪২ হাজার ৬৪২ ব্যাগ পাতা চা এবং ৬ হাজার ৬৮৪ ব্যাগ গুঁড়ো চা আনা হয়। এরমধ্যে যথাক্রমে ৩৩ এবং ১৭ শতাংশ চা অবিক্রিত থেকে গেছে। বিক্রিত চায়ের মধ্যে সাধারণ বা নি¤œমানের চায়ের দর ছিল প্রতিকেজি ১৪০ থেকে ১৫৫ টাকা, মাঝারি মানের ২১৫ থেকে ২২৬ টাকা, ভাল মানের ২৪৭ থেকে ২৮২ টাকা।
শীতের আগমনী শুরু হয়েছে। সেই সাথে এক কাপ চায়ের কদরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামনে ভোটের মওসুম। বাড়বে চায়ের চাহিদা। জমবে আড্ডা। বিশ্বে এখনও পর্যন্ত দামে সবচেয়ে সস্তা আর সুলভ অথচ বনেদী পানীয় হিসেবে আদর-কদর রয়েছে চায়ের। স্বাস্থ্যবিজ্ঞান মতে, চায়ের রয়েছে হরেক ধরনের উপকার।
এ বছর সার্বিকভাবে চায়ের দরদাম আগের বছরের তুলনায় বেশ চাঙ্গা রয়েছে। চট্টগ্রামে অবস্থিত দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক চা নিলামবাজারে (৩১তম ট্রেড পর্যন্ত) মোট ৫ কোটি ৪৫ লাখ ৫৮ হাজার ৭০৬ কেজি চা পাতা বিক্রি হয়েছে। কেজিপ্রতি গড় মূল্য ২১৫ টাকা ১৮ পয়সা। গতবছর একই সময়ে চা বিক্রি হয়েছে ৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৫ হাজার ৬২৬ কেজি। তখন গড়মূল্য ছিল ২১২ টাকা ০৮ পয়সা। অর্থাৎ গতবছরের তুলনায় চায়ের বিপণন বৃদ্ধি পেয়েছে পরিমাণগতভাবে ১৪ লাখ ১৩ হাজার ৮০ কেজি। আর গড়মূল্য বেড়েছে কেজিতে ৩ টাকা ১০ পয়সা হারে। চলতি মওসুম পর্যন্ত চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ট্রেডে প্রায় ১ হাজার ২শ’ কোটি টাকার চা বিক্রি হয়েছে।
তবে চলতি বছরে চায়ের আবাদ ও উৎপাদনে যেখানে সুখবর ছিল প্রত্যাশিত বাস্তবে সেখানে হচ্ছে তার বিপরীত। কেননা বছরের প্রায় গোড়া থেকে বৃষ্টিপাতে বিশেষত চা বাগানের এলাকাগুলো রয়েছে এখন পর্যন্ত সজীব ও সতেজ। অতিবর্ষণ চায়ের ফলনে উপকারই বয়ে আনে। কিন্তু উন্নততর জাত আবাদের ক্ষেত্রে যুগোপযোগী প্রচেষ্টার অভাবে উৎপাদন মার খাচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে চা উৎপাদিত হয়েছে ৫ কোটি ৯৩ লাখ কেজি। অথচ গতবছর একই সময়ে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ৫৪ লাখ কেজি। অর্থাৎ ৬১ লাখ কেজি পিছিয়ে গেছে চা উৎপাদন। অনুকূল আবহাওয়াও সেখানে তেমন সুফল বয়ে আনেনি। চা শিল্পখাতের বিশেষজ্ঞরা জানান, মান্ধাতা আমলের চা গাছ বা প্রজাতিগুলোর পরিবর্তে বিশ্বের উন্নততর জাত-প্রজাতির বিশেষ করে গুণগতমানে উৎকর্ষতা রয়েছে এমন ক্লোন জাত বাছাই করে আবাদ (প্রতিস্থাপন) না করা পর্যন্ত দেশে চায়ের উৎপাদন নাটকীয়ভাবে বাড়বে না। দামেও পিছিয়ে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ভারতের আসাম, দার্জিলিংয়ের উন্নতজাতের সৃজন করা চা বাগানগুলো হতে পারে অনুসরণীয়। আধুনিক প্রযুক্তি, যুগোপযোগী উৎকৃষ্ট জাত বাছাই ও প্রতিস্থাপন করে ভারত ছাড়াও মালয়েশিয়া, কেনিয়া, শ্রীলংকার মতো চা উৎপাদনকারী দেশে চা শিল্প বেশ এগিয়ে গেছে। উদ্যোগের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে দেশ।
অন্যদিকে চায়ের আবাদ, ফলন, প্রযুক্তি ও উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ পিছিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের চা উৎপাদনকারী দেশগুলোর মাঝে। এতে করে দেশের ঐতিহ্যবাহী রফতানি পণ্য, অর্থকরী চায়ের বর্তমান রফতানি বাজার বলতে গেলে শূণ্যের কোটায় নেমে গেছে। চলতি বছরের মওসুম পর্যন্ত চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রিত মোট ৫ কোটি ৪৫ লাখ কেজি চা পাতার মধ্যে মাত্র ৩৯ হাজার ৯৬১ কেজি চা রফতানি কোটায় বেচাকেনা হয়েছে। যা মাত্র শূণ্য দশমিক শূণ্য ৭৩ শতাংশ। দেশে উৎপাদিত চা দুই দশক আগে ২০টি দেশে রফতানি হতো নিয়মিত। এরমধ্যে ছিল পাকিস্তান, আফগানিস্তানন, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সিআইএসভূক্ত দেশসমূহ, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ, মিসর, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ড। সেসব দেশ দীর্ঘদিন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ঝুঁকেছে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে।
দেশে মোট ১৬৩টি চা বাগান কম আর বেশি সচল রয়েছে। এরমধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় ৯০টি, হবিগঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রামে ২২টি, সিলেটে ১৯টি, পঞ্চগড়ে ৭টি, রাঙ্গামাটিতে ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি চা বাগান রয়েছে। বাংলাদেশে চা একটি অভ্যন্তরীণ স্থায়ী চাহিদাপূর্ণ, রফতানিমুখী, শ্রমনিবিড় এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প। ঐতিহ্যের ধারক এ শিল্পে ১ লাখ ৪ হাজার ৪৯৭ জন স্থায়ী শ্রমিক, ২৮ হাজার ৩১৩ জন অস্থায়ী শ্রমিক এবং ৫ হাজার ৭২৬ জন কর্মচারী রয়েছেন। তাদের পোষ্য সংখ্যা ২ লাখ ৬৯ হাজার ১৩৩ জন। দেশে চা পানের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বৃহৎ চা বাগানের পাশাপাশি ২০০২ সাল থেকে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে পঞ্চগড় ও এর আশপাশ এলাকা, ঠাকুরগাঁও, বান্দরবান জেলায় ক্ষুদ্র পরিসরে সফল চা আবাদ হচ্ছে। এর পেছনে আছেন অর্ধ লাখ ক্ষুদ্র চাষী। ছোট ছোট চা বাগান চট্টগ্রাম, পার্বত্যাঞ্চল ও উত্তর জনপদে আরও প্রসারের সুযোগ রয়েছে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

18 + 1 =