অবৈধ ইটভাটা চলছেই প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে

0
818

নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা না করে ইটভাটা তৈরিতে সারাদেশে চলছে চরম নৈরাজ্য। হচ্ছে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ। কমছে আবাদি জমি। সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে প্রশাসনের সিদ্ধান্তও মানছেন না ইটভাটার মালিকরা। সবমিলিয়ে এ খাতে এখন চরম নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে। তথ্য ও সূত্র মতে, রাজধানীসহ সারাদেশে বৈধ প্রায় ৬ হাজার

ইটভাটা রয়েছে। অবৈধ রয়েছে আরো কয়েক হাজার। এসব ইটভাটা থেকে বছরে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ইট তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির মতে, সরকারিভাবে দেশে বর্তমানে ইটভাটার সংখ্যা ৬ হাজার ৯৩০টি। আর বছরে দেশে ইটের চাহিদা দেড় হাজার কোটি। এই ইট প্রস্তুত করতে ১২৭ কোটি সিএফটি মাটির দরকার হয়। যার বেশির ভাগই কৃষিজমির উপরিভাগ (টপ সয়েল) থেকে সংগ্রহ করা হয়। তিনি বলেন, ইট প্রস্তুত খাত দেশের গ্রিন হাউস গ্যাসের সবচেয়ে বড় উৎস। এ খাতে বছরে ২২ লাখ টন কয়লা ও ১৯ লাখ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়, যা বছরে ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে। তিনি বলেন, ভারতে ইটভাটার জন্য মাটি তুলতে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করতে হয়। বাংলাদেশেও তা করা উচিত, কিন্তু করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, নিয়ম নীতি না মানা ইটভাটাগুলো বন্ধের জন্য আমরা বার বার তাগিদ দিয়েছি। কোনোটি মানা হয়েছে, কোনোটি মানা হয়নি। অবৈধভাবে চলা ইটভাটাগুলো দ্রুত বন্ধের দাবি জানান তিনি। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। ভাটায় নিচু মানের জ্বালানি ও অনুপযুক্ত চিমনি ব্যবহারের কারণে আশপাশের পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। ইটভাটার চারপাশ ছড়িয়ে পড়ছে ছাই, ধুলা ও সালফার-ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস। আক্রান্ত এলাকায় এসিড বৃষ্টির মতো ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ ছাড়া ইটভাটাগুলো শস্যহানি, ধাতব পদার্থে মরচে সৃষ্টি, বর্ণক্ষয়, ভূমিক্ষয়, ভূমিধস ও ভূমির উর্বরতা হ্রাসে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইটভাটায় ব্যবহৃত জমি দীর্ঘ সময় কৃষিকাজের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। জমির উর্বরতাশক্তি এমনভাবে নষ্ট হয় যাতে আর কোনো ফসল হয় না। কিছু জমিতে ফসল ফলালেও ফলন ভালো হয় না। এই জমিগুলোতে উর্বরতাশক্তি ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের তথ্য মতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ একক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, ১৯৮৪ সালে দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার একক। ১৯৯৭ সালে এসে কমে তা ১ কোটি ৭৪ লাখ ৪৯ হাজার একরে এবং সর্বোপরি বর্তমানে বাংলাদেশের আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ কোটি ৫৪ হাজার একরে। সূত্র জানায়, শতাধিক অবৈধ ইটভাটা মালিককে তাদের ভাটা বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও আদালত। কিন্তু কোনো বিধি নিষেধই মানছে না ভাটা মালিকরা। পাবনার ঈশ্বরদীতে লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নের পদ্মার চরাঞ্চলের তিনটি গ্রাম জুড়ে রয়েছে ৫০টি ইটভাটা। এ ইটভাটাগুলো তৈরিতেও কোনো ধরনের নিয়ম মানা হয়নি। ইটভাটার ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে স্থানীয় লোকজনের দেয়া অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইটভাটাগুলো বন্ধের নির্দেশ দেয় প্রশাসন। কিন্তু বন্ধ হয়নি ইটভাটাগুলো। এ ছাড়া নাটোর, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, মানিকগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলার অন্তত ৫০টি ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দেয় আদালত। কিন্তু আদালতের নির্দেশ অমান্য করে এখনো চলছে ইটভাটাগুলো। সম্প্রতি কুমিল্লা সদরের কুমিল্লা ইরা ব্রিকস ফিল্ড ইটভাটার কার্যক্রম চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত। ইটভাটা তৈরির সময় স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদফতর, বনবিভাগ এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কোনো ছাড়পত্র না থাকায় কুমিল্লা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আজিজুর রহমানের আদালত এ নিষেধাজ্ঞা দেন। কিন্তু প্রশাসনের এ আদেশ না মেনে মালিক বিল্লাল অবলিলায় ভাটা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা উচ্চ আদালতে যাওয়ার চিন্তা করছি। নিম্ন আদালত থেকে বন্ধের কথা বলা হয়েছে। উচ্চ আদালত বন্ধের নির্দেশ দিলে আমরা বন্ধ করে দেব। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নে মেসার্স এসএনবি ব্রিকস নামের আরেকটি ইটভাটাকে একই অনিয়মের কারণে নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত। কিন্তু এর মালিক শামছুল আলমও আদালতের নিষেধ উপেক্ষা করে চালিয়ে যাচ্ছেন ভাটা।
এদিকে অবৈধভাবে চলা ইটভাটার বিষয়ে শিগগিরই অভিযান শুরু হবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক রইছউল আলম মণ্ডল। তিনি বলেন, কোনোভাবেই অবৈধ ইটভাটা চলতে দেয়া যাবে না। যেসব অবৈধ ইটভাটা মালিকদের সতর্ক করার পরও তা বন্ধ করেনি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

12 + one =