কত দাম সংরক্ষিত বনের

0
1020

মাত্র ৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকায় কক্সবাজারের মহেশখালীর ১৯১ একর সংরক্ষিত বনভূমি পেতে চায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বন কেটে সেখানে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল রাখার টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এতে গভীর

উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা ওই এলাকার প্রকৃতিতে বিপর্যয় নামার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
সরকারের নথিপত্র অনুযায়ী, বন বিভাগ শুরুতে বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের মূল্য নির্ধারণ করে ২৭৭ কোটি টাকা। এরপর তা ৪৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। বিপিসি এখন বলছে, বনজ সম্পদের ক্ষতিপূরণ বাবদ করপোরেশন ১ কোটি ৩৬ লাখ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য ৩ কোটি অর্থাৎ মোট ৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা দিতে রাজি আছে।
তবে পরিবেশবাদীরা মনে করেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই বনকে আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করা ঠিক নয়। তা ছাড়া আর্থিক মূল্য হিসাবে প্রথমে ২৭৭ কোটি ও পরে ৪৭ কোটি টাকা যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, তা দেশের সংরক্ষিত বন সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে। আর বিপিসি ৪ কোটি টাকায় বনভূমির জায়গা নেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা খারাপ উদাহরণ তৈরি করবে।
বিপিসি সূত্র জানায়, প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্পের আওতায় ওই বনে তেল টার্মিনাল ও টানেল নির্মাণ করা হবে। সেখান থেকে আমদানি করা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ২২২ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে নেওয়া হবে। ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ শীর্ষক এই প্রকল্পে চীনের এক্সিম ব্যাংক অর্থায়ন করছে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মহেশখালী দ্বীপের ওই বনে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী ও ২৭ প্রজাতির পাখি বসবাস করে। এ ছাড়া বনটিতে ৭০ প্রজাতির বৃক্ষ ও লতাগুল্ম রয়েছে। এই প্রাকৃতিক বনে দেশ থেকে বিলুপ্তপ্রায় অজগর সাপ ও মায়া হরিণের বসতি রয়েছে।
সরকারের কয়েকটি বড় প্রকল্প ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রকল্পে পরিবেশ বিষয়ে পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা প্রকৃতি ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. আনিসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বড় উন্নয়ন প্রকল্প ও অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত বনগুলো সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। কারণ, মন্ত্রণালয়ে কয়েকটি চিঠি চালাচালি এবং তাতে স্বাক্ষর দিয়ে অনুমোদন দিলেই শত বছর ধরে গড়ে ওঠা একটি বন ও পাহাড় ধ্বংস করা যায়।

বন কিনতে দরকষাকষি
বন কেনাবেচা নিয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন থাকলেও তাঁদের বিস্ময় দর-কষাকষির প্রক্রিয়া নিয়ে। বন বিভাগের প্রথম হিসাবে ক্ষতির অর্থ মূল্য ২৭৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ওই হিসাব পুনর্মূল্যায়ন করে ৪৭ কোটি টাকায় নামানো হয়।
গত ১২ নভেম্বর বিপিসির চেয়ারম্যান আবু হেনা মোহাম্মদ রহমাতুল মুনিম পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি চিঠিতে বলেন, তাঁদের কাছে ভূমি ইজারা বাবদ ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। জানতে চাইলে ওই প্রকল্পের পরিচালক মো. শরিফ হাসনাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পটির বাজেট ঠিক করার সময় আমরা ভেবেছিলাম যেহেতু সেটি বন বিভাগের জমি, সেহেতু এর জন্য কেবল ইজারামূল্য দিতে হবে। কিন্তু এখন জীববৈচিত্র্য ও বনজ সম্পদের যে হিসাব করা হয়েছে, তা আমাদের বিবেচনায় ছিল না।’এ প্রসঙ্গে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ওই বনভূমি দিচ্ছি না। দেশের প্রয়োজনে আরেকটি সরকারি সংস্থা এটি নিচ্ছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, বিপিসি ওই বনের জন্য যে টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে চাইছে, তা পর্যালোচনার জন্য আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

স্বতন্ত্র গবেষণায় বনের আর্থিক মূল্য
মহেশখালীর ওই বনভূমির জীববৈচিত্র্যের মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে সরকার একটি কমিটি করেছিল। বন বিভাগ, বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল বিভাগের ছয়জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত ওই কমিটি স্বতন্ত্র গবেষণার মাধ্যমে বনের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করে।
২০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়, মহেশখালী দ্বীপে ২৮ হাজার ২৮৬ একর বনভূমি রয়েছে। বনের পাশেই বঙ্গোপসাগর। ফলে সেখানকার বনভূমির একটি বড় অংশ শ্বাসমূলীয় বা ম্যানগ্রোভ প্রজাতির। সেখানে একটি বড় এলাকাজুড়ে রয়েছে ঔষধি গাছ।
বনজ সম্পদের আর্থিক মূল্য নির্ধারণের পাশাপাশি ওই তেলের টার্মিনাল নির্মাণ হলে মহেশখালী দ্বীপের কী ধরনের পরিবেশগত ক্ষতি হতে পারে, তাও হিসাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই টার্মিনাল নির্মাণের ফলে বিশাল অবকাঠামো তৈরি হবে, শুরু হবে মানুষের বসতি। এতে ওই দ্বীপে পানিনিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। জাহাজ আসা-যাওয়া এবং তেলের টার্মিনালের যান্ত্রিক তৎপরতার কারণে শব্দদূষণ হবে। একই সঙ্গে ডিপো থেকে রাসায়নিক বর্জ্য দ্বীপ ও সাগরে পড়বে, এতে পানি দূষিত হয়ে পড়বে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই দ্বীপের বাসিন্দাদের দীর্ঘমেয়াদি জীবিকার উৎস অর্থাৎ বন ও সমুদ্রে তাদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যাবে। তারা দারিদ্র্যের মধ্যে পড়বে। দূষণের কারণে তারা রোগবালাইয়ের শিকার হবে।
কমিটির অন্যতম সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক কামাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহেশখালীর এই প্রাকৃতিক বনে গর্জন, চাপালিশ, অশোকসহ ৪৬ প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে, যা অন্য বনগুলোতে খুব একটা নেই। এ ছাড়া এই বনের অজগর সাপ ও মায়া হরিণ দেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। সার্বিক ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে আমরা ২৭৭ কোটি টাকার আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করেছিলাম। এখন বিপিসি যদি ৩-৪ কোটি টাকা ওই বনের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব করে, তাহলে তা বনভূমি রক্ষার ক্ষেত্রে খারাপ উদাহরণ তৈরি করবে।’

বন বিভাগ থেকে আপত্তি ছিল
সংরক্ষিত বনভূমি ইজারা দেওয়ার ব্যাপারে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বন বিভাগ থেকে আপত্তি তুলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রায় ২৫ হাজার গাছ কাটা পড়বে। পাহাড় ও বনভূমিতে যে নির্মাণকাজ করা হবে, তাতে দ্বীপটির ভূমিক্ষয়, মাটি ও পানিদূষণ এবং তেল নিঃসরণসহ (অয়েল স্পিল) নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় হতে পারে। এতে ওই এলাকার বন ও বন্য প্রাণীর ব্যাপক ক্ষতি হবে।  জানতে চাইলে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন, বাংলাদেশের এদেশীয় পরিচালক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই নানা প্রাকৃতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের বনভূমি বিপদে আছে, এই পরিস্থিতিতে বন রক্ষার উদ্যোগ না বাড়িয়ে আমরা একের পর এক সংরক্ষিত বনকে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বরাদ্দ দিলে বিভিন্ন মহল সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতেই থাকবে।’ পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপিসির উচিত ছিল খরচ বাড়লেও মহেশখালীতে সংরক্ষিত বনের বাইরে অন্য জমিতে এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা। ড. আনিসুজ্জামানের মতে, মহেশখালীতে বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ বন রয়েছে, যা দেশের অন্য কোথাও নেই। এভাবে পাহাড় কেটে বন ধ্বংস করে তেলের টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ায় দ্বীপের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং পর্যায়ক্রমে উপকূলীয় এলাকায় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

17 − thirteen =