এরশাদের জাপা ঘুরেফিরে আলোচনায়

12
815

পহেলা জানুয়ারি ২০১৭ দলের মহাসচিব এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদারের নেতৃত্বে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিশাল সমাবেশ দিয়ে বছর শুরু করে এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে ৫৮টি দল নিয়ে রাজনৈতিক জোট গঠন করে

আলোচনার জন্ম দেন দলটির চেয়ারম্যান এরশাদ। ২১ ডিসেম্বর বিজয়ের মাসে বিপুল ভোটে ‘রংপুর সিটি মেয়র’ জিতে বছর শেষে দেশের রাজনীতিতে আলোচনার শীর্ষে উঠে আসে জাতীয় পার্টি।
মূলত: ২০১৭ সাল এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির ঘুরে দাঁড়ানো ও সুনাম অর্জনের বছর। সফলতার পাশাপাশি হতাশা, সঙ্কট, বিতর্ক ও সাংগঠনিক ব্যর্থতাও কম ছিল না দলটির। তারপরও সবকিছু ছাপিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতির ‘রংপুর জয়’ এখন দেশের প্রধান আলোচ্য বিষয়। বছর শেষে রাজনীতির ময়দানে নাটকীয়ভাবে ফিরে এসেছে জাতীয় পার্টি। এই জয়ের মধ্য দিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন এরশাদ। আশাবাদী হয়ে উঠেছেন আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার। সবকিছু নিয়ে ২০১৭ সালে ঘুরে ফিরে আলোচনায় ছিল এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি।
জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা ও জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ এমপি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি দীর্ঘ ২৭ বছর ক্ষমতার বাইরে। এর মধ্যে নানা প্রতিকূলতা-সীমাবদ্ধতা ডিঙ্গিয়ে পল্লীবন্ধুর নেতৃত্বে ইতিবাচক রাজনীতির মাধ্যমে আমরা এগিয়ে চলছি।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি গণমানুষের দল। আমরা দেশ ও জাতির স্বার্থে রাজনীতি করি। মানুষ পরিবর্তন চায়, আমরা তাদের সেই প্রত্যাশা পুরণের জন্য কাজ করছি। আজীবন দেশ ও জাতির সেবা করতে চাই।’
‘ইতিবাচক রাজনীতির মাধ্যমে আমরা দেশবাসীর আস্থা অর্জন করেছি। আমাদের চেয়ারম্যানের প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা রংপুর জয়ের মধ্য দিয়ে প্রমান হয়েছে। দেশ ও জাতির কল্যাণে জাতীয় পার্টির পতাকাতলে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে আমরা ক্ষমতায় যেতে চাই। মানুষের প্রত্যাশা পুরণ করতে চাই’, বলেন বিরোধী দলীয় নেতা।
জাপাকে সত্যিকার বিরোধী দল উল্লেখ করে রওশন এরশাদ বলেন, ‘সংসদ কার্যকর ও প্রাণবন্ত রাখতে জাপার ভূমিকা ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অকারণে বিরোধিতার খাতিরে জাপা বিরোধিতা করেনি। ফাইল ছোড়াছুড়ির মত নোংরামি করে অযথা আমরা সময় নষ্ট করিনি। একদিনের জন্য সংসদকে আমরা অকার্যকর করতে দেইনি। ভাল কাজে সরকারকে সহযোগিতা করেছি, ঠিক তেমনি গঠনমূলক সমালোচনা করেছি ও সরকারকে ছাড় দেইনি। সংসদের ভেতরে বাইরে আমরা সরকারের মন্দ কাজে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছি। এইভাবে ইতিবাচক রাজনীতির মাধ্যমে আমরা এগিয়ে চলছি।’ জনগণের ভালবাসা নিয়ে এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বে আগামীতে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন দলটির অন্যতম এই প্রতিষ্ঠাতা। জাতীয় পার্টির এই এক বছরের ভাল-মন্দের বিচার করার ভার জনগণের উপর ছেড়ে দিয়ে দলটির মহাসচিব এবিএম রহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘আমরা আল্লাহর মেহেরবাণীতে দেশের মানুষের দোয়ায় পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে দলকে সংগঠিত করার চেষ্টায় অনেকটা সফল হয়েছি। সফলতা-ব্যর্থতা দুটোই পাশাপাশি থাকে কিন্তু সফলতার ভাগ যদি বেশি থাকে তাহলে সেটাই অর্জন। সেটা আমি দেশবাসীর কাছে আবেদন করব, আমরা কেমন করছি- তারা যেন বিচার বিবেচনা করে। তারা আমাদের ভাল মন্দ দেখার বিবেক।’
এই বছরের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে আমরা অনেক জনসভা করেছি। জেলা-উপজেলায় ছুটে গিয়েছি, কাউন্সিল করেছি। বর্ধিত সভা, যৌথ সভা করেছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, রমনা-ডিপ্লোমায় বড় বড় সভা করেছি, মহাসমাবেশ করে নেতাকর্মী ও দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রেসিডিয়াম সভা হয়েছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভা হয়েছে। আমাদের ২৬ বছরের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো বিরোধী দলে থেকেও আমরা একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রংপুর সিটিতে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে মেয়র পেয়েছি।’ হাওলাদার বলেন, ‘প্রত্যেক দলের একটি লক্ষ্য ও প্রত্যাশা থাকে। আমাদের দলের একটি ভিন্নতা আছে, গত ২৬ বছরে আমরা উপেক্ষিত, নেতাকর্মীরা বঞ্চিত, আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা নির্যাতিত। তিনি মিথ্যা মামলা ও ষড়যন্ত্রের শিকার। তাকে হাজারো বার কোর্টে হাজির হতে হয়েছে। তারপরও আমরা দমে যাইনি। পল্লীবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমাদের পার্টি আজ সুসংগঠিত ও শক্তিশালী। তিনি নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে আমাদের দলকে এখানে নিয়ে এসেছেন, একটি সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচন করেছেন। আল্লাহ চাইলে দেশের মানুষের সমর্থনে জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে। সেই পরিস্থিতিকেও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আর যাই হোক জাতীয় পার্টিকে বাদ দিয়ে কারো পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব নয় বলে বিজ্ঞজনের অভিমত রয়েছে।’ ‘দেশবাসীর প্রত্যাশা পুরণে আগামীতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে কীভাবে সরকার গঠন করা যায়- সেটাই আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এছাড়া আমরা আর কিছুই ভাবতে পারিনা। ‍তারপরও বিধাতার লিখন যায় না খণ্ডন। আল্লাহ যা চান তাই হবে। লক্ষ্য একটাই, পল্লীবন্ধুর শেষ জীবনে তার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে সুখী সমৃদ্ধশালী একটি সুন্দর বাংলাদেশ উপহার দেওয়া।
বছরজুড়ে জাপার শোডাউন : জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ দলের চেয়ারম্যান, বিরোধী নেতা রওশন এরশাদ জ্যেষ্ঠ কো চেয়ারম্যান, জিএম কাদের কো চেয়ারম্যান ও এবি এম রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার পর নতুন নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ঘুরে দাঁড়ায়। ২০১৭ সালের পহেলা জানুয়ারি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে বিশাল সমাবেশ করে বছরের প্রথম দিনে ব্যাপক শোডাউন করে দলটি। এরপর বছর জুড়ে জাতীয় পার্টি রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে মহাসমাবেশ করে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়। এমনকি বিদেশ ফেরত এরশাদকে বরণ করতে নেতাকর্মীরা বিমান বন্দর এলাকায় শোডাউন করে এই বছর খবরের শিরোনাম হয় দলটি। মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ও অঙ্গ সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীরা চলতি বছর দলীয় কর্মসূচিতে ব্যাপক সক্রিয় হয়ে উঠেন। কেন্দ্রীয় যৌথসভা আয়োজন করে তৃণমূলের নেতাকর্মীদেরও সংগঠনমুখী করে তোলা হয়। জেলা সম্মেলন করতে এরশাদ-হাওলাদার ছুটে যান দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। এরশাদসহ উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের উপস্থিতিতে এসব কর্মসূচিতেও ব্যাপক শোডাউন করে জাতীয় পার্টি। রাজধানী ঢাকাসহ জাতীয় পার্টির প্রত্যেক কর্মসূচিতে নেতারা অনুসারি নেতাকর্মীদের নিয়ে ‘আলাদা শোডাউন’ করে পার্টির চেয়ারম্যানের নজরে পড়ার চেষ্টা করেছেন। তবে রাজধানী কেন্দ্রিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে ‘লোকসমাগমে’ বেশি ভূমিকা পালন করেছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি। প্রায় প্রত্যেক কর্মসূচিতে তার নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও নির্বাচনী এলাকা ঢাকা-৪ আসনের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তাছাড়া প্রত্যেক অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং উচ্চ পর্যায়ের নেতারা পার্টির কর্মসূচিতে সাধ্যমত শোডাউনের চেষ্টা চালিয়েছেন। সবমিলিয়ে কর্মসূচিতে শোডাউনে বছরটিতে আলোচিত ছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি। সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি বলেন, ‘পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি যে কোন সময়ের চেয়ে এখন শক্তিশালী দল। ৩০০ আসনে নির্বাচন করে আমরা আগামীতে ক্ষমতায় যেতে প্রস্তুত।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সারাদেশে আমাদের শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে। ঢাকায় আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তুলনায় কোন অংশে কম নই। জাতীয় পার্টির প্রত্যেক কর্মসূচিতে ব্যাপক লোকসমাগমই তার বড় প্রমাণ।’ ঢাকার মাটি এরশাদের ঘাঁটি দাবি করে এমপি বাবলা বলেন, ‘পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের নির্দেশে নেতাকর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। আগামী নির্বাচনে রংপুরের মত ঢাকায়ও ‘লাঙলের চমক’ দেখবে দেশবাসী।’
বিরোধী দলের ভূমিকায় আলোচনাসমালোচনা: জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়েও আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে এরশাদের জাতীয় পার্টি। সরকার ও দলটির একটি অংশ মনে করে বিরোধীতার খাতিরে বিরোধীতা না করে গঠনমূলক সমালোচনা করে সংসদকে প্রাণবন্ত রেখেছে জাপা।
সত্যিকার বিরোধী দলের ভূমিকার জন্য তারা দলটির প্রশংসা করলেও বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনার মুখে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তাদের মতে, জাপা সরকারের গৃহপালিত বিরোধী দল। আর এ কারণে সারা বছর বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের কাছে জাপাকে ‘গৃহপালিত বিরোধী দলে’র অপবাদ শুনতে হয়েছে। তবে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে খোদ দলটির চেয়ারম্যান এরশাদের সমালোচনামূলক বক্তব্য। বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতির বক্তব্য জাপাকে আরো সমালোচনার মুখে ফেলেছে। এজন্য নেতাকর্মীদেরও পড়তে হয়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে এরশাদ একাধিকবার বলেছেন, ‘জাপা প্রকৃত বিরোধী দল হতে পারেনি। সরকার ও বিরোধী দলে থেকে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা যায় না।’ এইভাবে আক্ষেপ প্রকাশ করে সত্যিকার বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করার জন্য মন্ত্রিসভা থেকে দলের নেতাদের বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে এ ব্যাপারে একাধিকবার সরকারের সহযোগিতাও কামনা করেন তিনি। কিন্তু এরশাদের সেই মনোবাসনা এখনও পুরণ হয়নি। এই ব্যর্থতা নেতাকর্মীদেরও হতাশ করেছে। বছরজুড়ে প্রশ্ন ফাঁস, সন্ত্রাস-জঙ্গি, খুন-গুম-ধর্ষণ, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধী নেতা রওশনের নেতৃত্বে সংসদ উত্তপ্ত করা হলেও রাজপথে তেমন কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি বিরোধী দলটিকে। তবে মাঝে মাঝে বেশ কিছু ইস্যুতে জাতীয় পার্টি রাজপথে কর্মসূচি পালন করায় আলোচিত হয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান এরশাদ। রোহিঙ্গা ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে নেতাকর্মীদের নিয়ে সাবেক এ রাষ্ট্রপতি মাঠে ছিলেন। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম এমপি বলেন, ‘জাতীয় পার্টির তারাই সমালোচনা করে যারা দেশের ইতিবাচক রাজনীতি করতে পছন্দ করেন না। জাতীয় পার্টি এদেশে ইতিবাচক রাজনীতির মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আমাদের পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও বিরোধী নেতা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি সংসদে ও সংসদের বাইরে সত্যিকার বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। তারা দেশবাসীর আস্থা ও ভরসার আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছেন। এ কারণে জাতীয় পার্টিকে মানুষ আগামীতে ক্ষমতায় দেখতে চায়।
৫৮ দল নিয়ে এরশাদেরবিশালজোট’ : ২০১৭ সালের ৭ মে ৫৮টি দল নিয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এমপি। জাপার নেতৃত্বে তার এই বিশাল জোট রাজনীতিতে আলোচনার জন্ম দেয়। এনিয়ে বড় দুটি রাজনৈতিক জোটের নেতারাও আলোচনা-সমালোচনায় মেতে উঠেন। জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রণ্টসহ ৫৮ দলের এই জোটের নাম দেওয়া হয় ‘সম্মিলিত জাতীয় জোট। দুটি নিবন্ধিত দল ও দুটি জোটসহ মোট ৪টি শরীক দল নিয়ে এ জোট গঠন করা হয়। জোটের শরীক দলগুলো হলো- জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, জাতীয় ইসলামী মহাজোট এবং বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ)। এদের মধ্যে ইসলামী মহাজোটে আছে ৩৪টি ইসলামী দল এবং বিএনএতে আছে ২২টি অনিবন্ধিত দল। সব মিলিয়ে ৫৮ দলের জোট।
আল্লাহর প্রতি সর্বোচ্চ বিশ্বাস, আস্থা রেখে দেশ ও জাতীর স্বার্থে এবং একসঙ্গে কর্মসূচি, একসঙ্গে নির্বাচন করে আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন রাজনৈতিক জোটটি গঠিত হয়। এই জোটের চেয়ারম্যান হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। আর জোটের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জাপা মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এমপি। এরশাদের নেতৃত্বাধীন এই রাজনৈতিক জোটকে চৌদ্দদলীয় জোট ও বিশদলীয় জোটের বিকল্পজোট হিসেবে দেখছেন দলটির নেতাকর্মীরা। তবে নতুন একটি জোট গঠন করলে জোটের ব্যানারে এই বছর সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতা বেশি। তারা সারা দেশে এখনও লিয়াজো কমিটি গঠন করতে পারেনি, জোটগতভাবে নির্বাচনের তেমন প্রস্তুতিও লক্ষ্যনীয় নেই। জোটগতভাবে এখনও ঠিক হয়নি আসন বিন্যাস ও প্রার্থী তালিকা। এসব নিয়ে অস্বস্তি ও সন্দেহ কাজ করছে জোটের শরিক দলগুলোর মধে। শেষ পর্যন্ত এই জোট নিয়ে সারা দেশে এরশাদের একক নির্বাচন কতটুকু নিশ্চিত এখনি বলতে পারছেন না নেতাকর্মীরা।
জোটের লিয়াজোঁ কমিটি এবং জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফয়সল চিশতী বলেন, ‘আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা পল্লীবন্ধুর নেতৃত্বে যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে জোট গঠিত হয়েছে সেই উদ্দেশ্য পুরণে আমরা কাজ করছি। জোটের শরিকদলগুলোতে কোনও আস্থার সঙ্কট নেই। বরং আমাদের পার্টির চেয়ারম্যানের নেতৃতে সবাই ঐক্যবদ্ধ। তার নেতৃত্বে জোটগতভাবে দেশব্যাপী নির্বাচনের জোরালো প্রস্তুতি চলছে।’ তিনি বলেন, ‘জোটের এমন প্রস্তুতি দেখে অনেকেই আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছেন। এটাও জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র। এই চক্রান্ত নতুন নয়। সব ষড়যন্ত্র অতীতের মত মোকাবেলা করে আমরা সাবেক রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে ইনশাআল্লাহ আগামীতে ক্ষমতায় যাব।’  জোটের শরিক ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব এম এ মতিন বলেন, ‘ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলে নয়, দেশ ও জাতির কল্যাণে তাদের স্বার্থে আমরা সাবেক সফল রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে এই জোটে শামিল হয়েছি। কোন ষড়যন্ত্র-অপপ্রচারে আমরা বিভ্রান্ত নই, দেশবাসীও বিভ্রান্ত হবেন না। আমরা আমাদের কাজ করছি। জোটগতভাবে দেশব্যাপী নির্বাচন হবে। আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
সাংগঠনিক ব্যর্থতা বিতর্কের মধ্যে যোগদানের চমক : ২০১৭ সালে দেশের সবকটি জেলা-উপজেলায় কাউন্সিল ও সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি জাতীয় পার্টি। তৃণমূল পর্যায়ে এখনও কোন্দল রয়ে গেছে। সাংগঠনিক ব্যর্থতার মধ্যে গাইবান্ধায় সরকার দলীয় এমপি লিটন হত্যাকান্ডের ঘটনায় দলের সাবেক এমপি কর্ণেল কাদের খানের গ্রেপ্তার এবং খুলনায় দলীয় নেতাকর্মী হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত এক ব্যক্তিকে জাতীয় পার্টিতে পদ-পদবি দেওয়া ও এখানকার নেতাকর্মীদের গণপদত্যাগের ঘটনায় জাতীয় পার্টির ভাবমূর্তি চরম ক্ষুন্ন হয়েছে।
তবে বিতর্ক ও সাংগঠনিক ব্যর্থতার মধ্যেও যোগদানের চমক দেখিয়েছে এরশাদের দলটি। বছরের শেষ সময়ে সাবেক স্বাস্থ্যসচিব এম নিয়াজ উদ্দীন মিয়া ও পিরোজপুর-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজীকে দলে ভিড়িয়ে আলোচিত হয়েছেন এইচ এম এরশাদ। গত একবছরে নতুন নতুন পেশাজীবী রাজনীতিকের যোগদানে নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়েছে, তেমনি শক্তিশালী হয়েছে জাতীয় পার্টি। সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছে এরশাদ পরিবারের ঐক্য। আগে এরশাদ, রওশন ও জিএম কাদের এর মধ্যে মান অভিমানের কারণে দলে বিভক্তি দেখা গেলেও ২০১৭ সালে তেমন কোন ঘটনা ঘটেনি। এতে দলের নেতাকর্মীরাও খুশি। এরশাদ পরিবার ঐক্যবদ্ধ থাকলে জাতীয় পার্টির আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়া অসম্ভব নয় বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা।
সুস্থ্য হয়ে এরশাদের ফিরে আসা এবং রংপুর জয় : বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে পড়েন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরশাদের অসুস্থ্যতা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েন দলের নেতাকর্মীরা। সুস্থ্য হয়ে তিনি আদৌ ফিরতে পারবেন কিনা অনিশ্চয়তায় ছিল সবাই। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় তার সুস্থ্যতা কামনায় মিলাদ ও মোনাজাতের আয়োজন করেন নেতাকর্মীরা। অবশেষে আল্লাহর রহমতে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে দেশে ফিরেন। স্বস্তি নেমে আসে দলে ও নেতাকর্মীদের মাঝে। তারপর নেমে পড়েন আগের মত সাংগঠনিক কর্মসূচিতে। সর্বশেষ তার নেতৃত্বে রংপুর সিটি জয় করে চমক সৃষ্টি করে জাতীয় পার্টি। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ বলেন, ‘আমাদের পার্টির চেয়ারম্যান সুস্থ্যভাবে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন- এটাই মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা। তার সুস্থ্যতা ও দীর্ঘায়ু প্রার্থণা করছি। দেশ ও জাতির সেবা ও মঙ্গলের জন্যই মহান আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ইনশআল্লাহ তিনি দেশবাসীকে মুক্তি দেবেন।’ সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জ্যেষ্ঠ কো চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ ও দলের মহাসচিব এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদারের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি বছর শেষে নাটকীয়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের ব্যর্থতা, সঙ্কট কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে আগামী নির্বাচনে এরশাদের জাতীয়পার্টি রংপুর জয়ের মত শেষ হাসি হাসতেই পারে এমনটাই মনে করেন নেতাকর্মীরা। পর্টির যুগ্ম মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি বলেন, ‘পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে দলের মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের অক্লান্ত পরিশ্রমে ২০১৭ সাল জাতীয় পার্টির সাফল্য ও জয়যাত্রার বছর। এজন্য মহান আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া জ্ঞাপন করছি। সেই জয়যাত্রার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আমরা আগামীতে ক্ষমতায় যেতে চাই। তিনি দেশবাসীকে এরশাদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

sixteen + 3 =