অপর দুটি কমিউনিটি সেন্টারে খাবার সংকটের গুজব থেকে মানুষের ঢলে প্রয়াত রাজনীতিক এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানিতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। রীমা কমিউনিটি সেন্টারে দুর্ঘটনার সংক্রান্ত জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি এই তথ্য জানিয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার জন্য ৪টি
কারণ চিহিৃত করা হয়েছে। তারমধ্যে গুজবের ঘটনাটি ছিল উল্লেখযোগ্য।
গতকাল বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের কাছে এই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কমিটি। দুর্ঘটনার জন্য কাউকে এককভাবে দায়ী করা হয়নি। ৫ কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে দায়ী করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী পূর্বকোণকে বলেন, ‘কাউকে এককভাবে দায়ী করা হয়নি। কমিউনিটি সেন্টারের প্রবেশপথ ঢালু হওয়ায় এক ব্যক্তি পড়ে যায়। তার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পেছনে আরও কয়েকজন পড়ে যায়। প্রবেশপথ ঢালু থাকায় অতিরিক্ত মানুষের চাপে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
দুর্ঘটনার জন্য ৫টি কারণ চিহিৃত করেছেন তদন্ত কমিটি। এরমধ্যে রয়েছে ১. কমিউনিটি সেন্টারে অতিরিক্ত মানুষের চাপ। ২. স্মরণিকা ও ভিআইপি ব্যাংকুয়েট হলে খাবার সংকটের গুজব তোলা হয়। দুটি কমিউনিটি সেন্টারে গুজব সৃষ্টির কারণে রীমা কমিউনিটি সেন্টারে মানুষের চাপ বেড়ে যায়। ৩. কমিউনিটি সেন্টারে প্রবেশপথ ঢালু থাকায় ভেতরে ঢোকার সময় হুড়োহুড়িতে সিটকে পড়ে অতিথিরা। ৪. রীমা কমিউনিটি সেন্টারে শুধুমাত্র সনাতন ধর্মীবলম্বীদের খাবারের আয়োজন ছিল। কিন্তু অন্য ধর্মের লোকজনও সেখানে খাবার খেতে যায়। এতে মানুষের ভিড় বেড়ে যায়।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, রীমা কমিউনিটি সেন্টারে ৭ হাজার লোকের খাবারের আয়োজন ছিল। একসঙ্গে ৭২০ জন লোকের খাবারের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু দুপুর একটার পর থেকে মানুষের চাপ বেড়ে যায়। ২০–২৫ হাজার লোকের সমাগম হয়ে যায়। অতিরিক্ত লোকের চাপ ধারণ করার মতো জায়গা ছিল না কমিউনিটি সেন্টারে। অন্য দুটি কমিউনিটি সেন্টারে খাবার সংকটের গুজব থেকে মানুষের চাপ বেড়ে যায়। বিপুল সংখ্যক লোককে সামাল দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থাও ছিল না।
তদন্ত কমিটি সূত্র জানায়, রীমা কমিউনিটি সেন্টারে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল। আয়োজনের বিষয়টি আগ থেকে পুলিশকে অবহিত করা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ প্রশাসন স্বপ্রণোদিত ১০ সদস্যকে নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রদান করেন।
দুর্ঘটনার সময় কমিউনিটি সেন্টারে চতুর্থ ব্যাচের খাবার প্রায় শেষ পর্যায়ে। এমন সময়ে দোতলা থেকে গেট খুলে দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু গেটের বাইরের অপেক্ষামাণ লোকের অবস্থা আঁচ করতে না পেরে গেট খুলে দেওয়া নির্দেশনা দেয়া হয়। পাঞ্জাবি পরিহিত এক লোক গেট খুলে দেওয়ার পর ভেতরে ঢোকার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। প্রায় দুই শতাধিক মানুষ পার হয়ে যায়। একজন লোকের কী যেন পড়ে যায়। তা তুলতে গিয়ে মানুষের ভিড়ে পড়ে যান তিনি। তার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আরও কয়েকজন পড়ে যায়। এছাড়াও ঢালু অংশের ডান দিকেও নামতে গিয়ে কয়েকজন পড়ে যায়।
আয়োজনের বিষয়ে তদন্ত কমিটি বলেন, প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী বড় ছেলে ব্যারিস্টার মহিবুল আলম চৌধুরী নওফেলের বৌভাত অনুষ্ঠানের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদাভাবে খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে খাবারের পর আরও দুই হাজার লোকের খাবার উদ্বৃত্ত ছিল। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে রীমা কমিউনিটি সেন্টারে ৭ হাজার লোকের খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। দলীয় লোকের মাধ্যমে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। সনাতন পল্লীগুলোতে অনেকটা ঢালাওভাবে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। এতেও লোকের চাপটা বেড়ে যায়।
কমিউনিটি সেন্টারের প্রবেশপথের নির্মাণ ত্রুটি সরানো, বড় আয়োজনে পুলিশ প্রশাসন বিস্তারিতভাবে অবহিত করা, বিপুল লোকের খাবারে জন্য কমিউনিটি সেন্টারের বদলে খোলা মাঠে করাসহ ৬ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
গত ১৪ ডিসেম্বর দিনগত রাত ৩টায় নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৮ ডিসেম্বর মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানিতে তার পরিবার নগরীর বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে মেজবানের আয়োজন করে। মেজবানিতে এসে নগরীর এস এস খালেদ সড়কে রীমা কমিউনিটি সেন্টারে পদদলিত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন অন্তত ২০ জন।
ঘটনার পর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাশহুদুল কবীরকে প্রধান ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মো. হুমায়ুন কবির, সহকারী পুলিশ কমিশনার নোবেল চাকমা, গণপূর্ত বিভাগের উপ–বিভাগীয় প্রকৌশলী এসএম শাহরিয়ার নেওয়াজ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান।
গত ২১ ডিসেম্বর পুলিশের তদন্ত কমিটিও প্রতিবেদন জমা দেন। পুলিশের তদন্ত কমিটিও হতাহতের ঘটনায় এককভাবে কাউকে দায়ী করেনি। কমিউনিটি সেন্টারের নির্মাণ ত্রুটি, আয়োজকদের অব্যবস্থাপনা, পুলিশ–স্বেচ্ছাসেবক এবং কুলখানিতে আসা লোকজন সবারই এই দুর্ঘটনার জন্য দায় আছে, এমনটাই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।