নওগাঁয় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই তালিকায় বাদ,শরীরে গুলি

0
1153

সংসারে অভাব-অনটন সইতে না পেরে সন্তানদের নিয়ে চলে গেছেন স্ত্রী। শরীর জুড়ে বুলেটের আঘাত। পৈতৃক সম্পত্তির ১৮ বিঘা জমি স্বল্প মূল্যে বিক্রি করে চিকিতসা নিয়েছেন ব্যাংককে। শরীর থেকে কয়েকটি স্প্লিন্টার বের করতে পারলেও এখনো পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া আস্ত দুটি বুলেট রয়ে গেছে মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দীন শেখের শরীরে। অথচ নওগাঁর মান্দা উপজেলার ২০১৭ সালের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি তাঁর নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। শুধু তিনি নন, ১৭ জন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, টাকা দাবি করেছিলেন মান্দা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আফসার আলী।

 

সেই টাকা না পেয়ে তিনি এমনটা করেছেন। তালিকা থেকে বাদ পড়াদের মধ্যে রয়েছেন শহীদ নহির উদ্দীনের যুদ্ধাহত ছেলে সাবেদ আলী। মান্দা উপজেলার পাকুড়িয়া ও আশপাশের গ্রামের অধিবাসীরা অভিযোগ করে, ১৯৭১ সালের ২৮ আগস্ট পাকুড়িয়া গ্রামের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে ১২৮ জন নিরীহ ব্যক্তিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যা করে। তাদের সহযোগিতা করে মান্দা থানার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান চককুসুম্বা গ্রামের মো. আহম্মদ আলীর সহযোগী মো. আহাতুল্যা প্রামাণিক, শান্তি কমিটির সেক্রেটারি হাজী গোবিন্দপুর গ্রামের মো. সমতুল্যা মণ্ডল ও বাদলঘাটা গ্রামের মো. নাজির উদ্দীন মণ্ডল। অভিযোগ উঠেছে, গোবিন্দপুর গ্রামের মৃত সমতুল্যা মণ্ডলের ছেলে বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. আফসার আলী মণ্ডল। তিনি যাচাই-বাছাই কার্যক্রমের অন্য সদস্যদের প্রভাবিত করে টাকার বিনিময়ে ৪৯ জন অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুপারিশ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা আরো অভিযোগ করেন, আফসার তাঁর ভাই মো. সাহাদত হোসেনকে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য বাবার পক্ষে অনলাইনে আবেদন করেন। সেখানে তাঁর জন্ম তারিখ ১৯৩২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি লেখা। যুদ্ধাহতের পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, মান্দা উপজেলার ২০১৭ সালের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের যাচাই-বাছাই কমিটি যে তালিকা প্রস্তুত করেছে তা সঠিক নয়। পাকুড়িয়া গ্রামের ১২৮ জন শহীদ নিরীহ ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির সুপারিশ করা হয়নি। এ বিষয়ে যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল মান্নান বলেন, আফসার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মান্দা উপজেলার বড়পই গ্রামে তাঁর মামা লুত্ফর রহমানের বাড়িতে থাকতেন। তখন তাঁর বয়স সাত-আট বছর হবে। স্থানীয় দেলুয়াবাড়ী বাজারে প্রফুল্ল ডাক্তারের ঘরে শান্তি কমিটির অফিস ছিল। সেখানে নিয়মিত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আহম্মদ আলী ও আফসার আলীর বাবা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি সমতুল্যা মণ্ডল বসতেন। যুদ্ধের সময় সেখানে একবার আক্রমণের জন্য যাওয়া হয়েছিল। এ অফিসের নির্দেশে পাকুরিয়া গ্রামের সাবেদ আলী মণ্ডল, আব্দুস সামাদ, জসিম উদ্দীন, শংকর ও শৈলেনের বাড়িতে লুটপাট করা হয়। এবারের তালিকায় যাদের বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে দেলুয়াবাড়ীর আফসার আলী ও বড় বেলালদহ গ্রামের ভগিরত তাঁতির বয়স ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিন-চার বছর। তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা খোদা বকস বলেন, ‘আফসার সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আজ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হয়ে গেছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর যাঁরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম তাঁরা তৎকালীন সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে গাঢাকা দিয়েছিলাম। তখন ফাঁকা মাঠে গোল দিতে হাজির হন আফসার। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে তিনি প্রসাদপুর বাজারে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে একটি ঘরে বসতে শুরু করেন। সেখানে ধীরে ধীরে অনেকে বসতে শুরু করে। ভুলভাল বুঝিয়ে তাঁর সপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কয়েকটি প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করেন। ’মুক্তিযোদ্ধা মৃত পিয়ার উদ্দীনের ছেলে মোজাম্মেল হক মুকুল আক্ষেপ করে বলেন, ‘সব কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও গেজেটে বাবার নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আফসার আমার কাছে টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে না পরায় বাবার নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ মা ভাতা পেয়ে আসছিলেন। ’ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দীন শেখ আভিযোগ করে বলেন, ‘মুক্তিবার্তায় নাম ও নম্বরসহ সব কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও আফসারের চাহিদামতো টাকা দিতে না পরায় আমার নাম সুপারিশ করা হয়নি। আমি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে যুদ্ধ করেছি। এ বিষয়ে শিবগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের প্রত্যয়নপত্র রয়েছে। ’প্রসাদপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইব্রাহীম হোসেন বলেন, ‘রাজাকারের ছেলে কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হয়?’নওগাঁ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ইউনিট কমান্ডার হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছি। ’মান্দা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আফসার আলী মণ্ডল বলেন, ‘আমাকে নিয়ে যাঁরা বিতর্ক করছেন তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা কি না ভেবে দেখা দরকার। আমি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে যুদ্ধ করেছি। সেখানে ডাক্তার মন্টু ও শহজাহান আমার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। আমি কাশিয়াবাড়ী ও গোমস্তাপুরের অভিযানে ছিলাম। আমার বাবার সমন্ধে যা বলা হচ্ছে, তা প্রপাগাণ্ডা মাত্র। বাবা কুসুম্বা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ ও ১৯৭২ সালে নৌকা প্রতীকের এজেন্ট ছিলেন। ’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

3 × four =