ফারমার্স ব্যাংক ফেরত দিচ্ছে না জলবায়ু ফান্ডের ৫০৮ কোটি টাকা

0
818

ফারমার্স ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রেখে চরম বেকায়দায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের গচ্ছিত রাখা ৫০৮ কোটি টাকা ফেরত চেয়ে মন্ত্রণালয় আবেদন করলেও সাড়া মিলছে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের

হস্তক্ষেপ চেয়েছে বন মন্ত্রণালয়। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের গচ্ছিত এ টাকা উঠাতে গত বছর নভেম্বরে আবেদন করা হয়েছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে উল্লেখ করেছে, ফারমার্স ব্যাংকে এক বছর মেয়াদি স্থায়ী আমানত রাখে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড। ৯.১০ শতাংশ  সুদে রাখা তহবিলের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০৮ কোটি ১৩ লাখ ২৯ হাজার টাকা। ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখায় রক্ষিত অর্থের মধ্যে গুলশান শাখার ৯ কোটি ২৬ লাখ ২০ হাজার টাকা মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে গত ২৩শে নভেম্বর। আর মতিঝিল শাখার ১৭ কোটি ৯ লাখ ৯৯ হাজার ৩৬০ টাকার মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে ২৪শে নভেম্বর। একই শাখায় ১৬০ কোটি ৫৯ লাখ ১৬ হাজার ৪৮০ টাকা এবং ৩৩ কোটি ৭৪ লাখ ৩৫ হাজার ৮৪০ টাকার মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে গত ২৯শে নভেম্বর। এসব অর্থ তোলার জন্য গত ২৩শে নভেম্বর চিঠি দিয়েও ট্রাস্ট কোনো টাকা পায়নি। বিষয়টি অবহিত করে অর্থ তোলার জন্য নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে (বিএফআইডি) একটি চিঠি দেয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের স্থায়ী আমানত ফারমার্স ব্যাংক পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে সরকার। সর্বশেষ নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে বন মন্ত্রণালয় ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠালেও ব্যাংকটি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। চিঠিতে বলা হয়, বন মন্ত্রণালয় থেকে অনেকবার শাখা ব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হয়েছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন  ট্রাস্ট ফান্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দীপক কান্তি পাল বলেন, টাকা তোলার জন্য আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কবে ফেরত দেবে তা স্পষ্ট করেনি ফারমার্স ব্যাংক। ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, টাকা তোলার জন্য বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড আবেদন করেছিল। আমরা তাদের সঙ্গে বসে সময় বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া বন্ডের অনুমোদনও মিলেছে। ব্যাংকের শেয়ার ছেড়ে মূলধন বাড়ানোরও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ফলে হাতে টাকা আসলে কিছু কিছু করে হলেও আমারা দেয়ার চেষ্ট করবো। ইতিমধ্যেই ট্রাস্ট ফান্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসার জন্য সময় নিয়েছি। আশা করছি তাদের সঙ্গে বসলেই বিষয়টি সমাধান হয়ে যাবে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা রয়েছে ফারমার্স ব্যাংকে। এর মধ্যে ১ কোটি ৭ লাখ টাকার মেয়াদ পূর্ণ হয় গত নভেম্বরে। পুরো অর্থ তুলে নেয়ার চেষ্টা করেও না পেয়ে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছেন বলে করপোরেশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এর আগে আমানতের অর্থ ফেরত না পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে গত ১৯শে নভেম্বর আমানতের ৩৫ কোটি ৪৪ লাখ ৫৫ হাজার ১০১ টাকা ফেরত পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এখন আর অর্থ ফেরত দেয়ার পরিস্থিতি এই ব্যাংকের নেই বলে জানা গেছে। কারণ তারল্য সংকট ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে। সূত্র জানিয়েছে, তারল্য সংকটের কারণে অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে ফারমার্স ব্যাংক। দুই মাস আগে যেখানে ব্যাংকটির ৫ হাজার ৬৬০ কোটি টাকার আমানত ছিল। এখন তা কমে ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকায় নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের আস্থা ফেরাতে নবগঠিত পরিচালনা পর্ষদকে ২০০ কোটি টাকা জোগানের জন্য গত ২৮শে নভেম্বর এক সপ্তাহ সময় দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সেই টাকা তারা দেয়নি। এসব কারণে প্রতিদিনই ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান টাকা তোলার চেষ্টা করেও পাচ্ছেন না। চেক ক্লিয়ারিংয়ের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এসব ক্লেইম এলেও ব্যাংকটির অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকায় কিছুই করতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা। দায়-দেনা নিরূপণের লক্ষ্যে ফারমার্স ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, গুলশান ও মতিঝিল শাখার ওপর একটি বিশেষ পরিদর্শন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেসিক ব্যাংকের মতো কমিশনসহ বিভিন্ন অনিয়মে সংশ্নিষ্টতার দায়ে ইতিমধ্যে চেয়ারম্যানের পদ থেকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে এবং অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে গত ২৭শে নভেম্বর পদত্যাগ করেন তারা। এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফারমার্স ব্যাংক আর্থিক খাতে ‘সিস্টেমেটিক রিস্ক’ সৃষ্টি করছে। এই ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই। এ কারণে ব্যাংকটির ওপর আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট হতে পারে বলে মনে করে মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, ফারমার্স ব্যাংক ২০১৩ সালে তাদের কার্যক্রম শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই ঋণ নিয়মাচার অনুসরণ ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শিথিলতা দেখা দেয়। তারা নীতিমালা অনুসরণ না করে গ্রাহকদের ঋণ দিয়েছে। ঋণ নিয়মাচার লঙ্ঘন করে নিজ ব্যাংক ও অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছর ধরে ফারমার্স ব্যাংকে তারল্য সংকট রয়েছে। বর্তমানে তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির মোট ৫৪টি শাখার মধ্যে ২৮টি শাখাই লোকসানে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ফারমার্স ব্যাংক শুধু জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের টাকা নয়, কারো টাকাই দিতে পারছে না। মূলত ব্যাংকটি তারল্য সংকটের কারণে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। তিনি বলেন, যতটুকু জানি ব্যাংকটি শেয়ার বিক্রি করে গ্রাহকদের পাওনা টাকা পরিশোধের চেষ্ট করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমতিও দিয়েছে। এখন দেখা যাক ব্যাংকটি গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারে কি না। সংশ্নিষ্টরা জানান, ফারমার্স ব্যাংকে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক আমানত রয়েছে, তার বেশিরভাগই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের। আগে কোনো ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ৫ বছর পার না হলে সেখানে সরকারি আমানত রাখার সুযোগ ছিল না। তবে ২০১৩ সালে নতুন ৯ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর শর্ত শিথিল করে এসব ব্যাংকে টাকা রাখার সুযোগ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই নির্দেশনার কারণে স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় সরকার থেকে পাওয়া তহবিলের ২০ শতাংশ এসব ব্যাংকে রাখতে পারে। আর সরকারি, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা নিজস্ব আমানতের ২৫ শতাংশ রাখতে পারে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 × four =