তৈরি করা হবে অপহরণ নিখোঁজ আত্মগোপনের পৃথক চিত্র এবার গুমের যোগসূত্র খুঁজবেন গোয়েন্দারা উদ্ধারের ঘটনা ফলাও করে প্রচারে গুরুত্ব দেবে সরকার অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিতকরণে তৎপরতা

0
688

ক্ষমতার মেয়াদের শেষ সময়ে একের পর এক নিখোঁজ, অপহরণ ও গুমের ঘটনায় দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠায় এবার এর যোগসূত্র খুঁজতে মাঠে নামছেন গোয়েন্দারা। বিশেষ করের্ যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে যাদের তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠছে, তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত্ম করে প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনে তৎপরতা চালাবে তারা।

একই সঙ্গে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনের পর অপহরণের ধুয়া তুলে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করা হবে। খোঁজা হবে এর নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারীদেরও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গুম, অপহরণ, নিখোঁজ ও আত্মগোপনের রহস্য উদ্ঘাটনে রাজধানী ঢাকাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হবে। তবে গোয়েন্দারা প্রতিটি মেট্রোপলিটন এলাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় সমান গুরম্নত্ব দিয়ে কাজ করবেন। গ্রামগঞ্জ, এমনকি প্রত্যন্ত্ম এলাকায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটলে এক বা একাধিক টিম সেখানেও ছুটে যাবে। গোয়েন্দা এসব টিম তাদের রম্নটিনমাফিক অন্যান্য কাজ নিয়মিত পরিচালনা করলেও গুম, অপহরণ, নিখোঁজ ও আত্মগোপনসংক্রান্ত্ম তথ্য সংগ্রহ এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তৎপরতা চালানোই তাদের মূল দায়িত্ব থাকবে। তবে এ সংক্রান্ত্ম গোয়েন্দা টিম এবং প্রতিটি ইউনিটের সদস্য সংখ্যা কত হবে সে সম্পর্কে দায়িত্বশীলরা কেউ সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানাতে পারেননি। সংশিস্নষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন কয়েক মাস পর পরই নিখোঁজ, অপহরণ ও গুমের বিশাল তালিকা প্রকাশ করে। যা বছরান্ত্মে যোগ করে শেষে বিশাল অংকে এসে দাঁড়াচ্ছে। অথচ এদের মধ্যে অনেকে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে রাগ বা অভিমান করে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর স্বেচ্ছায় ফিরে আসছে। অনেক সময়র্ যাব-পুলিশ তাদের উদ্ধার করছে। এ ছাড়া ঠকবাজ ও নানামুখি দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত বিভিন্ন পেশার মানুষ স্বেচ্ছায় গা ঢাকা দিয়ে খবরের শিরোনাম হচ্ছে। বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসীরা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে অপহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। যার দায় সরকারের ঘাড়ে এসে চাপছে। তাই এ ধরনের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত্মে পৃথক গোয়েন্দা টিম নামানো হচ্ছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। এদিকে নিখোঁজ কিংবা অপহরণের পর ফিরে আসা ও উদ্ধার হওয়া প্রতিটি ঘটনা বিভিন্ন মাধ্যমে ফলাও করে প্রচারের ব্যাপারেও গুরম্নত্ব দেবে সরকার। কেননা বিগত সময়ে নিখোঁজ-অপহরণের ঘটনার পর তাদের উদ্ধারসংক্রান্ত্ম ইতিবাচক কোনো খবর প্রকাশিত না হওয়ায় জনমনে বিভ্রান্ত্মি সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে নানাভাবে আতঙ্কও ছড়িয়েছে। যা স্বার্থান্বেষী দুষ্টচক্র নানাভাবে কাজে লাগিয়ে ফায়দা তুলেছে। ক্ষমতার পালাবদলের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসবে, সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ততই এ পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করবে বলে মনে করেন সংশিস্নষ্টরা। গোয়েন্দাদের ধারণা, অপহরণ-গুম, নিখোঁজ ও আত্মগোপনের প্রকৃত চিত্র পৃথকভাবে তুলে ধরা হলে এ নিয়ে দেশে-বিদেশে যে তোলপাড় শুরম্ন হয়েছে, তা অনেকাংশে কমবে। এ ছাড়া দ্রম্নত প্রতিটি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করা হলে এ অপতৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্তদের মুখোশ উন্মোচিত হবে। এতে এ হিড়িক অনেকাংশে কমবে। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দুর্ধর্ষ অপরাধী বা রাষ্ট্রবিরোধী বড় ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের আটক করার পর অনেক সময় তা তাৎক্ষণিক তাদের স্বজনদের জানানো হয় না। কেননা এতে তাদের সহচরদের গ্রেপ্তার করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে নির্ধারিত সময়ে তাকে আদালতে হাজির করে রিমান্ড গ্রহণ কিংবা জেল কারাগারে পাঠানো হয়। এ সুযোগে অনেকে আটকের এ ঘটনাকে গোপন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরম্নদ্ধে অপহরণ কিংবা গুমের অভিযোগ তোলেন। অপরাধ পর্যবেক্ষকরা বলেন, নিখোঁজ, অপহরণ, গুম ও আত্মগোপনের ঘটনাগুলো অনেকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন। অথচ এসবের মধ্যে বিশাল ফারাক রয়েছে। যা পৃথকভাবে চিহ্নিত করা গেলে আইনশৃঙ্খলার বাস্ত্মবিক অবস্থা নিরূপণ করা যাবে। এতে সাধারণ মানুষের বিভ্রান্ত্মিও দূর হবে বলে মনে করেন তারা। এদিকে আতঙ্কে ভরা এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঘুরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন বিশিষ্টজনরা। তাদের ভাষ্য, এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো বিভেদ থাকলে চলবে না। তাদের পাল্টাপাল্টি দোষারোপের খেলাও বন্ধ করতে হবে। তা না হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকবে। অপরাধী কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে তা গোপন না করে দ্রম্নত আইনের আওতায় নিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তারা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এস এম শাহজাহান বলেন, রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বেস্নম গেমের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সঠিকভাবে তদন্ত্ম করে আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশকে সহায়তা করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও এখন মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এ জন্য প্রকৃত আসামি যে-ই হোক, তাকে গ্রেপ্তারের পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আদালতে উপস্থিত করতে হবে। তা না হলে এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন সাবেক এই পুলিশ প্রধান। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, গুম, খুন ও অপহরণ রোধে প্রয়োজন রম্নল অব ল’র বাস্ত্মবায়ন। প্রয়োজনে রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম, আইনজীবীসহ সংশিস্নষ্ট সবাইকে রম্নল অব ল বাস্ত্মবায়নে মার্চ করা উচিত। নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে গ্রাম-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে পোস্টার, লিফলেটসহ নানা প্রচারসামগ্রী বিতরণ করা উচিত। সবাই সচেতন হলেই কেবল এসব অপরাধপ্রবণতা কমতে পারে।সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম বলেন, অপহরণের ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অ্যাকশনে নামতে হবে। এখন যে অ্যাকশন নেয়া হচ্ছে, তা আরও আগে নেয়া উচিত ছিল। এলাকায় এলাকায় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা যেতে পারে বলেও মত দেন তিনি। এদিকে গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, গুম-অপহরণ ও আত্মগোপনের বিষয়ে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলেই চলবে না, দেশের সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। এ দায় শুধুর্ যাব-পুলিশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলে ভোগান্ত্মি আরও বাড়বে। ওই পুলিশ কর্মকর্তা রাজধানী থেকে নিখোঁজ ব্র্যাক ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার নাইমুল ইসলাম সৈকতকে চট্টগ্রাম থেকে উদ্ধারের ঘটনা উলেস্নখ করে বলেন, স্রেফ আত্মগোপনে থাকা একজন মানুষ সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেন। অথচ উদ্ধার হওয়ার পর জানা গেছে, তিনি ব্র্যাক ব্যাংক থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা নিয়ে মানুষের কাছে সুদে লাগাতেন। এই টাকা মানুষের কাছ থেকে উদ্ধার করতে না পেরে তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে আত্মগোপন করেছিলেন। দেশে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটার নজির রয়েছে দাবি করে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আত্মগোপনকারীদের উদ্ধার করতে না পারলেও তার দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঘাড়েই চাপছে। কখনো এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হচ্ছে। এ তালগোলে অনেক সময় প্রকৃত অপহরণের ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

fifteen − 13 =