৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে উত্তরাঞ্চলে ঠাণ্ডাজনিত রোগে হাসপাতালগুলোতে শিশু ও বৃদ্ধ রোগীদের ভিড়

0
772

টানা  ৪ দিনের শৈত্যপ্রবাহে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্নস্থানে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শীতজনিত রোগবালাই বাড়ছে আশংকাজনক হারে। কাজের অভাবে দরিদ্র মানুষ অসহায়। কনকনে শীতে আর হিমেল হাওয়ায় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন । কুড়িগ্রামে

শীতজনিত রোগে শিশুসহ মারা গেছে ৫ জন। পাবনায় নভেম্বর থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত শিশু-বৃদ্ধসহ ৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত। : পাবনা : জেলা প্রতিনিধি জানান, অব্যাহত শীতের তীব্রতায় পাবনায় ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক শিশু ও বৃদ্ধ ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। গতকাল  শনিবার পর্যন্ত শীতের কারণে নিউমোনিয়া ও ডায়েরিয়াসহ ঠান্ডাজনিত রোগে নভেম্ব^র থেকে এরই মধ্যে জেলায় ৭৫ জন শিশু ও বৃদ্ধ মারা গেছেন। এর মধ্যে চারজন বৃদ্ধ। বাকিরা শিশু। হাসপাতাল সূত্রে গেছে, গত দু মাসে সাড়ে ৩ হাজার শিশু নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ৭১ জন। এদিকে গত কয়েকদিন ধরে সারাদেশে বেড়েছে শীতের তীব্রতা। তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় উত্তরের জেলা পাবনায় বইছে শৈত্যপ্রবাহ। এ কারণে জেলায় দেখা দিয়েছে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া রোগের প্রকোপ। এ রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা ছুটছেন বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ পাবনা জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু সেখান থেকেও মিলছে না কাক্সিক্ষত চিকিৎসাসেবা। প্রতিদিনই অন্তত ৩/৪ জন শিশুকে রাজশাহী অথবা ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর করা হচ্ছে। সেই সাথে জেনারেল হাসপাতালে দেখা দিয়েছে অক্সিজেনের সংকট। একত্রে তিন শিশুর জন্য ১টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট পাবনা জেনারেল হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে শয্যা সংখ্যা মাত্র ৩৩টি। অথচ ফটো থেরাপি মেশিন বিকল থাকায় একটি বাল্ব জ্বালিয়ে তিনটি শিশুকে থেরাপি দেয়া হচ্ছে। পাবনা জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স রাবেয়া খাতুন জানান, শীতের শুরুতে গত নভেম্ব^রে এ হাসপাতালে ২ হাজার ২৫ জন শিশু ভর্তি হয়। এর মধ্যে ৪৪ জন শিশুর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ডিসেম্বরে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৩৫ জন শিশু। মারা যায় ২৮ জন শিশু। এর মধ্যে ৬ জন শিশু নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। বাকিদের মৃত্যু হয় ডায়েরিয়ায়। আর জানুয়ারির ৬ তারিখের মধ্যে মৃত্যু হয় ২ শিশুর। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ১০/১৫ জন শিশু ও বৃদ্ধ ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতাল সূত্র জানায়, একই সময়ে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চারজন বৃদ্ধ মারা গেছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, শীত মৌসুমের শুরুতে এবং শীতের শেষদিকে ঠান্ডাজনিত রোগে শিশু আক্রান্ত বৃদ্ধি পায়। : কুড়িগ্রাম : স্টাফ রিপোর্টার জানান, টানা ৪ দিনের শৈত্যপ্রবাহে প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে কুড়িগ্রামের মানুষের জীবন-যাত্রা। সকালে তীব্র ঠান্ডায় কাজে বের হতে পারছে না মানুষ। এছাড়াও বিকেল থেকেই তাপমাত্রা নিম্নগামী হওয়ায় সন্ধ্যার পরপরই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার ও দোকানপাট। খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানুষজন। গরম কাপড়ের অভাবে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষেরা। কাজে বের হতে না পারায় পরিবার পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। এ পর্যন্ত শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে জেলায় শিশুসহ ৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে রাজারহাট উপজেলায় মারা গেছে ৩ জন। মৃতদের মধ্যে গত শুক্রবার সকালে নয়ন মনি ও বৃহস্পতিবার মীম সদর হাসপাতালে মারা যায়। বাকি ৩ জন রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১২ টায় মধ্যে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসে বলে জানায় কুড়িগাম সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. জাহাঙ্গির আলম। : তিনি আরো জানান, সদর হাসপাতালে গতকাল শনিবার ২৪ ঘন্টায় ৯৮ জন ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। আক্রান্তদের মধ্যে নিউমোনিয়া ও শ্বাস কষ্টে ৩৫ জন শিশু, ডায়রিয়ায় ২০ জন ও অন্যান্য রোগে ৪৩ জন ভর্তি হয়েছে। গতকাল শনিবার কুড়িগ্রাম জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। মৃতরা হলো, মীম (দেড় বছর) পিতা বুলবুল শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মীমকে রাজারহাট উপজেলা থেকে কুড়িগ্রাম হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তি করায়। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত মেয়েটি আধাঘন্টা পর মারা যায়। দুলালী (২১দিন) পিতা আব্দুর ছাত্তার গ্রাম চতুর্ভূজ রাজারহাট, নয়নমনি (১দিন), পিতা খোকন, কুড়িগ্রাম পৌরসভা, বিশ্ব দেব রায় (৩০) রাজারহাট ও আনোয়ার হোসেন (৫৫), পিতা আমুর উদ্দিন, গ্রাম মহিষপুরি রাজারহাটকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। : সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কনকনে ঠান্ডা আর হিমেল হাওয়ায় খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘর হতে বের হচ্ছে না মানুষ। গরম কাপড়ের অভাবে শীত কষ্টে ভুগছে শিশু, বৃদ্ধসহ নিম্ন আয়ের কর্মজীবী মানুষ। সন্ধ্যা থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকছে পুরো জনপদ। দিনের বেশির ভাগ সময় সুর্যের দেখা না মেলায় তাপমাত্রা নিম্নগামী হচ্ছে। এ অবস্থায় শীত কাতর মানুষেরা খড়-কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারনের চেষ্টা করছে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তাসহ ১৬টি নদ-নদীর অববাহিকায় ৪শ ২০টি চরের মানুষ গরম কাপড়ের অভাবে তীব্র শীত কষ্টে ভুগছে। তীব্র ঠান্ডা ও শৈত্যপ্রবাহে কাজে বের হতে পারছে না কর্মজীবী মানুষেরা। দুর্ভোগ বাড়তে থাকায় বিপাকে পড়েছে এসব হতদরিদ্র মানুষ। কুড়িগ্রাম কৃষি আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক মোফাখখারুল ইসলাম জানান, গতকাল শনিবার বিকালে জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।  জেলা প্রশাসকের ত্রাণ কার্যালয় সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ৯ উপজেলায় ৫৭ হাজার কম্বল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এগুলোর বিতরণ কাজ চলছে। : রংপুর : স্টাফ রিপোর্টার জানান, রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় হানা দিয়েছে শীত। বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। কনকনে শীত আর হিমেল হাওয়ায় কাহিল হয়ে পড়েছে প্রায় ২৫ লাখ দরিদ্র মানুষ। শীত মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসনের প্রস্তুতি খুব সামান্য। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। বিশেষ করে চরাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত নদী বেষ্টিত এলাকার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। এ ছাড়া শীতজনিত রোগবালাইও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। : রংপুর আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, গতকাল শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত রংপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস কিন্তু ভোরের দিকে তা ১০.০৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। গেল কয়েকদিনের থেকে গতকাল শনিবার শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কাহিল হয়ে পড়েছে এই উত্তরের জনজীবন। শীতের তীব্রতা আর সূর্যের লুকোচুরি খেলার সাথে চলমান মৃদু হাওয়া দেখে মনে হয় বৃষ্টি নামবে। কিন্তু বৃষ্টি নেই। তবে তীব্রতা যেন বেড়েই চলেছে। এতে নগরীর হাট বাজারেও কমেছে লোকের আনাগোনা। জরুরি কাজ ছাড়া কেউ কেউ বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। এমন অবস্থায় দিনমজুর হিসেবে জীবন যুদ্ধে অংশ নেয়া হদ দরিদ্র মানুষগুলোর জীবনে নেমে এসেছে অসহনীয় কষ্ট। রংপুর সদর উপজেলাসহ পীরগাছা, গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, মিঠাপুকুর উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানকার বেশির ভাগ মানুষ নিম্নশ্রেণির হওয়ায় শীতে তাদের জীবনযাত্রায় নেমে এসেছে স্থবিরতা। অনেকেই সারাদিন কাজের আশায় থেকে কাজ না পেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে। : এদিকে রংপুর মহানগরীর তপোধন, উত্তম, তামপাট, দর্শনাসহ  বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, কয়েকদিনের শীতে এখানকার অনেকেই কাজে বের না হয়ে ঘরে বসে আছে। নগরীর ৩২নং ওয়ার্ডের শ্রমজীবী আলতাফ হোসেন, সামসুল আলম ও নুর মিয়া জানান, ‘হামার গ্রামোত কাজ না থাকায় এবং ঠান্ডাত শহরোত যাবার না পেয়া বাড়িত বসি আছি।’  তিস্তাপারের ধামুর এলাকার সত্তর বছরের ওমর আলী বলেন, ‘নদীপারের ঝুপড়ি ঘরোত হু হু করি বাতাস ঢোকে। ঠান্ডাত সারা রাইত নিন (ঘুম) ধরে না।’ একই এলাকার শহর বানু ও জাহানারা বেগম বলেন, ‘দুই দিন না খ্যায়া থাকা যায়, তয় ঠান্ডা কষ্ট আর সওয়া যায় না।’ পৌষ মাসের মাঝামাঝি হঠাৎ করে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের অভাবী মানুষজন। রংপুর নগরীর বাহাদুরসিংহ এলাকার দিনমজুর সেকেন্দার আলী বলেন, ‘থাকি থাকি এবার এমন জারোতে শরীল (শরীর) দুর্বল হয়া গেইছে। কাম (কাজ) করি ক্যামনে!’ জারের কারণে শ্রম বিক্রি করতে না পারায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে আছেন বলে জানান তিনি। : এদিকে প্রচন্ড শীতের কারণে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে সহায়-সম্বলহীন হতদরিদ্র লোকজন। শীতবস্ত্রের অভাবে তারা চরম দুর্ভোগে পড়েছে। শীতের কারণে কোল্ড ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, টাইফয়েট জ¦র, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপেক্স সূত্রে জানা গেছে, শীতজনিত কারণে আগের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি শিশু ও বৃদ্ধরা। রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. আবু মো. জাকিরুল ইসলাম জানান, মূলত শিশু ও বৃদ্ধরাই শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়। শিশুদের গরম কাপড় পরানো এবং সকালে ও সন্ধ্যার পর তাদের ঘরের বাইরে বের না করার পরামর্শ দেন তিনি। : এদিকে রংপুর আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানা যায়, একটু দেরিতে হলেও চলতি সপ্তাহ থেকে এ অঞ্চলে শীত হানা দিয়েছে। অনেক স্থানে দুপুর পর্যন্ত মানুষ সূর্যের মুখ দেখছে না। কোথাও বা দেখা গেলেও তা ছিল খুব অল্প সময়ের জন্য। দু-এক দিনের মধ্যে তাপমাত্রা আরো কমবে বলে নিশ্চিত করে আবহাওয়া অফিস জানায়, একই সঙ্গে পশ্চিমা বাতাস বইবে। তখন মৃদু থেকে মাঝারি শৈতপ্রবাহ বইবে এ অঞ্চলে। : স্টাফ রিপোর্টার দিনাজপুর জানান, দিনাজপুরে প্রবল শৈত্য প্রবাহে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাপমাত্রা নেমে সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। গতকাল শনিবার দিনাজপুরে চলতি মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তরের হিমেল হওয়া ও কনকনে শীতের কারণে মানুষসহ গবাদী-পাখি পর্যন্ত কাবু হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শ্রমজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষগুলো পড়েছে চরম বিপাকে। বাতাসের গতি ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার। দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া দফতরের পর্যবেক্ষক মো. আজাদুর হক মন্ডল জানান, শনিবার দিনাজপুরে চলতি মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৭ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত শুক্রবার ছিল ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া গত ১ জানুয়ারি সোমবার হতে ৪ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাপমাত্রা ৯ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে উঠানামা করে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। শৈত্য প্রবাহের কারণে শীতে কাবু হয়ে পড়েছে গোটা উত্তর জনপদ। প্রচন্ড শীতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। শৈত্য প্রবাহের কারণে দিনের বেলায় সূর্যের দেখা মেলে না। দুপুরে দিকে সামান্য সময়ের জন্য সূর্যের দেখা মিললেও কিছুক্ষণ আবারো হারিয়ে যায়। প্রচন্ড শীতের কারণে শিশু, বৃদ্ধসহ নানান বয়সী মানুষ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ফলে দিনাজপুর এম অব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজুপুর জেনারেল হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে লোকজন কাজকর্ম করে দ্রুত বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। একেবারে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। রাতের বেলায় ঘনকুশায় যানবাহনগুলো চলাচলে বিঘœ ঘটছে। সকালের দিকেও রাস্তায় যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে পথ চলাচল করতে দেখা গেছে। এদিকে হাড় কাঁপানো শীতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ বেড়েছে অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষের। বিশেষ করে শ্রমজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষগুলো বেশি বিপাকে পড়েছেন। তীব্র শীতের কারণে কাজ করতে না পারায় পরিবার-পরিজন েিন বিপদে পড়েছেন এসব মানষ। শহরের রেল স্টেশনসহ বস্তি এলাকায় অবন্থানরত ছিন্নমূল মানুষকে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে দেখা গেছে। এছাড়া প্রচন্ড শীতে শিশু ও বৃদ্ধরাও কষ্ট পাচ্ছেন। দিনাজুপর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. ওয়ারেস আলী সরকার এই শীতে শিশুদের গরম কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে ও শিশুর গায়ে যাতে শীত না লাগে সেদিকে বিশেষ যতœবান হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। : নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, শৈত্য প্রবাহ শুরু হয়েছে নীলফামারীতে। গত মঙ্গলবার রাত হতে শুরু হওয়া ঘন কুয়াশার সাথে উত্তরের হিমেল বাতাস আর কনকনে শীতে জবুথুবু হয়ে পড়েছে এখানকার লোকজন। আর এই কনকনে শীতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ। তীব্র শীতের কারণে খেটে খাওয়া মানুষজন কাজে যেতে না পেরে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। শৈত্য প্রবাহ আর ঘন কুয়াশার কারনে গতকাল শনিবার সারা দিনে সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। দিনের বেলাতেও কুয়াশার কারণে ভারী যানবাহনগুলো হেড লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। রাস্তা-ঘাটে লোকজন চলাচল কমে গেছে। প্রয়োজন ছাড়া লোকজন ঘরের বাহিরে বের হচ্ছে না। গ্রামে ও হাট-বাজারগুলোতে দেখা দেছে লোকজন খড়-কুটে জ্বালিয়ে শীত নিবারনের চেষ্টা করছেন। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান ও ট্রেন চলাচলের সিডিউলের বিপর্যয় ঘটছে। ঘন কুয়াশার কারনে সৈয়দপুরে বিমান চালকদের নির্দিষ্ট দৃষ্টিসীমা দুই হাজার মিটারের মধ্যে না থাকায় ঢাকা-সৈয়দপুর রুটে বিমান চলাচলে প্রায়ই বিঘœ ঘটছে। রাতের বেলায় চলাচলকারী ট্রেনগুলো কুয়াশার কারনে গন্তব্য পৌছাতে ২ থেকে ৬ ঘন্টা দেরি হচ্ছে। গত দু’দিনে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর ট্রেন সীমান্ত এক্সপ্রেস নীলফামারী স্টেশনে ৬ ঘন্টা দেরীতে পৌঁছে। ঢাকা-চিলাহাটি রেলপথের নীলসাগরসহ অন্যান্য ট্রেনগুলো ২ ঘন্টা দেরিতে চলাচল করছে। : সৈয়দপুর স্টেশন মাস্টার রেজাউল করিম জানান, ঘন কুয়াশার কারনে ট্রেনের গতি প্রতি ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার থেকে নেমে ৬০ কিলোমিটারে চালাতে গিয়ে সময়ক্ষেপন হচ্ছে। একই অবস্থা বিরাজ করছে সড়ক পথেও। একে তো রাস্তার বেহাল দশা, তার ওপর ঘন কুয়াশা। ৭ ঘন্টার পথ এখন ১৪ ঘন্টাতে পৌছাতে পারছে না। শীতের তীব্রতায় বেড়েছে শীতজনিত রোগের। গত ৫ দিনে নীলফামারীর ছয়টি উপজেলা হাসপাতালে তিন শতাধিক ডায়রিয়া রোগী ভতি হয়েছে। এদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধদের সংখ্যাই বেশি। শীত নিবারন করতে গরম কাপড় সংগ্রহে নিম্ন আয়ের মানুষরা পৌরসভা মাঠের পুরানো কাপড়ের বাজারে ভীড় করছেন। এদিকে শীতের তীব্রতার কারণে শীতজনিত রোগের প্রার্দুভাব বেড়েছে। আর এই রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। : উল্লাপাড়া (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, প্রচন্ড শীতে কাঁপছে উল্লাপাড়ার মানুষ। দিনে মাঝে মধ্যে সূর্যের মুখ দেখা গেলেও শীতের তীব্রতা কমছে না। স্কুল কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। সন্ধ্যার আগেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর অভাবী পরিবার শীতবস্ত্রের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে। অনেক পরিবার রাতে ঘরের মধ্যেই খড়কুটো জ্বালিয়ে উত্তাপ নিচ্ছে বলে জানা গেছে। ঘনকুশায়ার কারণে পাবনা-বগুড়া ও ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে সকাল ১০টা পর্যন্ত হেড লাইট জ্বালিয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। উপজেলার কানসোনা গ্রামের কৃষক জাহিদ হোসেন খান জানান, গবাদি পশু নিয়ে এই শীতে চরম বিপাকে পড়েছেন তিনি। চটের বস্তা কেটে গরুগুলোর গায়ে চড়িয়ে রাখা হচ্ছে। নেওয়ারগাছা গ্রামের শেফালী খাতুন জানান, তার পালিত ছাগলগুলো দুদিন ধরে ঘর থেকে বেরই করতে পারেননি তিনি। শীতের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর থেকে আসা হিমেল হাওয়া মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে স্থবির হয়ে পড়েছে এখানকার জনজীবন। উল্লাপাড়ার সংসদ সদস্য তানভীর ইমাম ইতোমধ্যেই শীতার্তদের জন্য ৩ হাজার কম্বল গ্রামে গ্রামে বিতরণের ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে সাংসদের একান্ত সচিব প্রকৌশলী শওকাত ওসমান গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন।     : তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) প্রতিনিধি জানান, উত্তরের হিমেল হাওয়া ও তীব্র শীতে তেঁতুলিয়া উপজেলার সর্বত্রই জনজীবন অস্বস্তি হয়ে পড়েছে। জানা যায়, দীর্ঘ ৬ দিন যাবত ঘন কুয়াশা ও বাতাসের তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে দিনের বেলায় আকাশের সূর্যের দেখা মেলে না তাপ মাত্রা নেমে এসেছে ১১ডিগ্রি সি.সি। সাধারণত দিন মুজুর হত দরিদ্র মানুষের শীত বস্ত্র না থাকায় তারা অতি কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। তেঁতুলিয়া পাথর এলাকা থাকায় পাথর শ্রমিকরা একমুঠো ভাতের সন্ধানে সকাল থেকেই নদী, ডোবা ও পাথর অহরণের যায়গায় পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে হাড় কাঁপানো শীতের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অপরদিকে মা, শিশু ও বৃদ্ধ মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে নতুন নতুন শীতজনিত রোগের। : খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তেঁতুলিয়াসহ জেলার হাসপাতালগুলোতে শিশু ও বৃদ্ধ রোগীর সংখ্যা আশংঙ্কা জনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশুদের নিউমেনিয়া, শ্বাস প্রশ্বাস জনিত রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধদের ব্রংকাইটিস্, হাপানি, ডাইরিয়া, আমাশয় অক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে।উপজেলার গ্রাম অঞ্চলগুলোতে শীতের তীব্রতা নিবারনের জন্য ঘর থেকে মানুষ বের হচ্ছে না। তারা শীত থেকে বাচাঁর জন্য খড়ের আগুন কাঠের আগুন ও উনুনের পাশে থেকে শীত নিবারন করছে। এ যাবৎ অন্যান্য বছরের ন্যায় তেঁতুলিয়ায় সরকারীভাবে শীত বস্ত্র বিতরণ অপ্রতুল যার কারণে অতি দরিদ্র মানুষ শীতের কারণে কাজে যেতে না পারায় খেয়ে না খেয়ে জীবন জাপন করছে। অভিজ্ঞ মহল অনতি বিলম্বে হত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে সরকারী ভাবে শীত বস্ত্র বিতরণের জন্য জোর দাবি জানান। উপজেলার হাট বাজার গুলোতে পূর্বের তুলনায় শীত ও হিমেল হাওয়ার কারণে ব্যবসায়ী সহ সাধারন মানুষের চলাফেরা স্থবির হয়ে পড়েছে। চায়ের দোকান গুলোতে দুই এক জনের দেখা মিললেও তারা চায়ের চুলার আগুনের চতুরপার্শ্বে আড্ডা জমিয়ে চা পান করতে দেখা যাচ্ছে। গরু, মহিষ , ছাগল, ভেড়া সহ গৃহপালিত পশু গায়ে বস্তা পরিয়ে গোয়াল ঘরে অবস্থান করছে।  : হাতীবান্ধা (লালমনিরহাট) প্রতিনিধি জানান, এই শীতে ঘর থাকি বেরুনো যায় না। যে শীত, কায় কাজ দিবে কন? আজ ভায় (সহ) তিন দিন কাজোত (কাজ) যাংনাই (যাইনি)। কয়টা টাকা ছিলো তাও শ্যাষ (শেষ)। বউ ছাওয়া (বাচ্ছা) নিয়া কষ্টে আছি। এ ভাবে কথাগুলো বলছিলেন, লালমনিরহাট হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের তিস্তা পারের দোয়ানী গ্রামের দিনমজুর কাদের মিয়া (৪৫)। শনিবার বিকেলে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার সাধুর বাজার,নিজ গড্ডিমারী,তালেবমোড়, দোয়ানী, ছয়আনী, এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, ওই এলাকার খেটে খাওয়া মানুষ কাজকর্ম না পেয়ে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারনের চেষ্টা করছেন। কয়েক দিনের টানা শৈত্য প্রবাহে তিস্তা পারের হতদরিদ্র মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। : লালমনিরহাট জেলার ৫টি উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী এলাকার খেটে খাওয়া মানুষ কাজ কর্ম না পেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। তিস্তা পারের জনজীবন বিপর্ষস্ত হয়ে পড়েছে। ঘন কুয়াসার পাশাপাশি তীব্র শীতে ঘর থেকে বের হতে পারচ্ছে না তিস্তা পারের মানুষজন। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারনের চেষ্টা তারা। এই শীতে সবচেয়ে বেশী কষ্টে আছেন বৃদ্ধ ও কোমলমতি শিশুরা। রেল স্টেশনসহ জেলার বিভিন্নস্থানে অবস্থানকারী ছিন্নমুল মানুষগুলো শীতবস্ত্রের অভাবে কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। শীতার্ত মানুষগুলো এক টুকরো গরম কাপড়ের জন্য তাকিয়ে আছেন বিত্তবান লোকদের দিকে। গড্ডিমারী ইউনিয়নের তালেব মোড় এলাকার ভ্যান চালক, হোসেন আলী বলেন, সকাল থেকে বসে আছি কোন ভাড়া পাইনি। এই শীতে কেউ ভ্যানে উঠতে চায় না। তাই ভ্যান নিয়ে বসে আছি । লালমনিরহাট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন সুত্রে জানা গেছে, শীতবস্ত্রের চাহিদা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। এসব শীতবস্ত্র এলে তা দ্রুত বিতরন করা হবে। হাতীবান্ধা উপজেলা গড্ডিমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান জানান, তিস্তা পারের বেশী ভাগ মানুষ এই শীতে কষ্টে আছেন। দরিদ্র পরিবার গুলোর জন্য শীতবস্ত্র চেয়ে উপজেলা পর্যায়ে আবেদন করেছি। কাহারোল (দিনাজপুর) প্রতিনিধিঃ দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার শৈত্যপ্রবাহে ঘন কুয়াশা ও প্রচন্ড ঠান্ডায় নাকাল হয়ে পড়েছে জনজীবন। শীতজনিত বিভিন্ন রোগ বালাই দেখা দিয়েছে। ক্ষতি গ্রস্থ হচ্ছে বোরোর বীজতলা ও আলু সহ বিভিন্ন ফসলের। হঠাৎ করেই কমতে শুরু করেছে তাপমাত্রা। শনিবার সকালে লক্ষ্য করা গেছে ঘন কুয়াশা। প্রচন্ড কুয়াশায় চাদরে ঢাকা থাকছে চারিদিক। দিনের মাঝামাঝি সময়ে সূর্যের দেখা মিললেও কমছে না শীতের তীব্রতা। সেই সাথে ৩ দিন ধরে বইছে সৈত্যপ্রবাহ। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানুষ। শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় বিপযস্ত হয়ে পড়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। আর শীতে নাকাল হয়ে পড়েছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। তীব্র শীতে সবচেয়ে র্দুভোগে পড়েছে ছিন্ন মূল ও নি¤œ আয়ের মানুষ, আর বিপাকে পড়েছে দৈনন্দিন খেটে খাওয়া কর্মজীবিরা। ঘন কুয়াশার কারণে সকালে ১৫ ফিট দুরেও কোনকিছুই দেখা যাচ্ছে না। যানবাহন হ্যাট লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে। এরপরেও বাড়ছে দূর্ঘটনা। শীত বস্ত্রের আশায় গরীব ছিন্নমূল মানুষ চেয়ে আছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

20 − 6 =